শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে নতুন ষড়যন্ত্র

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০২০, ১২:৩৭ পিএম

ভারতের রাজধানী দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাবলিগ জামাতের একটি সমাবেশে যোগ দেওয়া অন্তত তিনশো জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ পাওয়ার পরে ওই ঘটনাটিকে ঘিরে ভারতজুড়ে প্রচণ্ড উদ্বেগ, ক্রোধের প্রকাশ ঘটছে। বিশেষ করে, হিন্দুত্বাবাদী বিভিন্ন রাজনীতিক ছাড়াও ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ মানুষ ভারতে করেনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য তাবলিগ জামাতকে দায়ী করছেন। মারকাজে অংশ নেওয়া লোকজনের খোঁজে বিভিন্ন রাজ্যে তাবলিগিদের মসজিদে মসজিদে, বাড়িতে-বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে দিল্লির পাশে একটি হাসপাতালকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তুলকালাম। উত্তর প্রদেশ রাজ্যের গাজিয়াবাদ জেলায় যে ১৫৬ জন তাবলিগ সদস্যকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে, তাদের বেশ কজন রয়েছেন সেখানকার এমএমজি নামে একটি হাসপাতালে।
তাদের কজনের বিরুদ্ধে আজ স্থানীয় পুলিশ কোয়ারেন্টিনের নিয়মকানুন অবজ্ঞা করা এবং হাসপাতালের নারী নার্সদের সাথে অশোভন আচরণ করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে।
শুধু মামলাতেই ঘটনা থামেনি। উত্তর প্রদেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মামলার আসামি তাবলিগ সদস্যদের তিনি "মানবতার শত্রু" বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেইসাথে তাদের বিচারের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারী করেছেন। এর অর্থ, বিচার ছাড়াই তাদেরকে কয়েকমাস আটক করে রাখা যাবে।
হাসপাতালের প্রধান মেডিকেল অফিসার পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন বেশ কজন তাবলিগ সদস্য কোয়ারেন্টিনের শর্ত না মেনে হাসপাতাল কর্মীদের বিপদগ্রস্ত করছে, তারা ডাক্তার-নার্সদের লক্ষ্য করে কটূক্তি করছে, ওয়ার্ডের ভেতর খালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কর্মীদের কাছে থেকে সিগারেট চাইছে। এ ধরনের কিছু ভিডিও ফুটেজও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে।
এর পরই গাজিয়াবাদ পুলিশ বেশ কজন তাবলিগ সদস্যের বিরুদ্ধে মামরা দায়ের করে, এবং সাথে সাথে সরব হয়ে উঠেছেন উত্তর প্রদেশের কট্টর হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
তিনি ঐ তাবলিগ সদস্যদের "মানবতার শত্রু" বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, "তারা আইন মানে না, নির্দেশ মানে না। তারা নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে যে আচরণ করেছে তা জঘন্য অপরাধ। তারা মানবতার শত্রু।"
ওদিকে গত মাসে দিল্লিতে সম্মেলনের পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া তাবলিগ সদস্যদের খুঁজতে মসজিদে, বাড়িতে হানা দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) হরিয়ানা রাজ্যের পালওয়াল নামে একটি মসজিদে হানা দিয়ে পুলিশ বেশ কজনকে কোয়ারেন্টিনে নিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে এদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস নিশ্চিত হয়েছে। দিল্লির তাবলিগ সম্মেলনে অংশ নেওয়া লোকজন এবং তাদের মাধ্যমে ভারতে অন্তত চারশ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। তাদের বেশ কজন মারাও গেছে।
এভাবেই গণমাধ্যমের একটা অংশ এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা মুসলিম বিদ্বেষী হ্যাশট্যাগ তৈরি হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে নানা ভুয়া খবর। করোনা জিহাদ বা নিজামুদ্দিন ইডিয়টস নামে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগও ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতের মুসলমান নেতৃত্ব যদিও স্বীকার করছেন যে তাবলিগের ত্রুটি নিশ্চই হয়েছে, কিন্তু রাজধানীতে পুলিশ আর সরকারই বা কেন এই সময়ে ঐ সম্মেলন (মারকাজ) হতে দিল? খবর বিবিসির।
দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাবলিগ জামাতের মারকাজে যোগ দিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়া কয়েকজনের শরীরে করোনা সংক্রমণ প্রমাণিত হওয়ার পরে ভারতের গণমাধ্যমে ওই ঘটনা খুবই গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
ওই ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য জাফরিয়াব জিলানি বলেন, 'ভুল দুই তরফেই হয়েছে। ওই সমাবেশে যারা গিয়েছিলেন, তাদের উচিত ছিল নিজের থেকেই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া এবং চিকিৎসকদের আর সরকারের পরামর্শ নেওয়া। কিন্তু উল্টোদিকে, সরকারই বা ব্যবস্থা নেয়নি কেন? সমাবেশটা তো হয়েছে যখন দেশে কোনো লকডাউন ছিল না, সেই সময়ে। তারপরে যারা ফিরতে পারেননি, লকডাউনের ফলে তাদের জন্য তো সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল।'
তিনি বলেন, 'এরকম একটা কঠিন সময়ে বিষয়টাকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে, সেটা একেবারেই কাম্য নয়। মুসলমানদের প্রায় সবাই কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথা মেনেই চলছে, উলামারা নির্দেশ দিয়েছেন জমায়েত না করতে।'
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী এবং রাজ্যের মুসলমান সমাজের অতি পরিচিত নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীও একই প্রশ্ন তুলছেন যে তাবলিগ জামাত যদি ভুল করে থাকে সমাবেশ করে, তাহলে সরকার কী করছিল? তিনি বলেন, 'মার্কাজে নিজামুদ্দিনের পাশেই থানা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ আছে দিল্লিতে। তারা কি সমাবেশে হাজির মানুষকে কোনোভাবে সচেনতন করেছিলেন? একবারও মাইকিং করেছিলেন এলাকায়? সেটা করলেই তো এরকম পর্যায়ে যেত না বিষয়টা! আবার মাওলানা সাদ সাহেবও কার সঙ্গে কী পরামর্শ করেছিলেন জানি না -ওদেরও একগুঁয়ে মনোভাব নেওয়াটা উচিত হয়নি। এরকম একটা ঘটনার ফলে গোটা দেশের মুসলমান সমাজকে একটা পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছেন তারা'।
পশ্চিমবঙ্গ থেকেও অনেকে গিয়েছিলেন ওই সমাবেশে। তিনি বলেন, 'কারা গিয়েছিলেন সেখানে, সেটা জানা গেছে। আমি বলব তারা নিজের থেকেই এগিয়ে এসে পরীক্ষা করিয়ে নিন। ডাক্তারি পরীক্ষা করানো ইসলাম বিরোধী কাজ তো নয়।'
মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে হিন্দু আর মুসলমান পক্ষের মধ্যে বিতর্কের মধ্যেই ওই ঘটনার পর মুসলমানদের লক্ষ্য করে নানা ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
ভুয়া খবর যাচাই করে দেখে, এমন একটি ওয়েবসাইট অল্টনিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বলেন, 'নিজামুদ্দিনের ঘটনাটার পর থেকে এরকম অনেক ভিডিও আর পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, যেগুলোর টার্গেট মুসলমানরা। আমরা একটা ভুয়া ভিডিও খুঁজে পেয়েছি, যেখানে একদল মুসলমানকে থালা-বাটি চাটতে দেখা যাচ্ছে। বলা হয়েছে এভাবেই মুসলমানরা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা যাচাই করে দেখি যে ওটি আসলে বোহরা মুসলমানদের একটি রীতি- খাওয়ার পরে যাতে থালায় একটিও খাদ্যকণা অবশিষ্ট না থাকে, সেজন্য তারা চেটে পরিষ্কার করে দেন। দুদিন আগে আরেকটি ভিডিও আসে আমাদের কাছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি মসজিদের ভেতরে একদল মুসলমান কোনো একটা আওয়াজ বার বার করছেন। ভুয়ো পোস্টটিতে বলা হয় ওভাবেই হাঁচি দিয়ে নাকি মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছে। অথচ এটি আসলে একটা সুফি আচার, যেখানে তারা শ্বাস-প্রশ্বাসের একটা অভ্যাস করেন- সেটাই তারা করছিলেন।'
তার কথায়, 'এইসব ভুয়া ভিডিওগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ভারতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য মুসলমানরাই দায়ী, এরকম একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।'

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ ৪ এপ্রিল, ২০২০, ১:০৭ পিএম says : 0
এটা আল্লাহর আযাব। এখন সময় আল্লাহ তায়ালর দিকে ফিরে আসার। তা না করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইসলামের বিরোদ্ধে অবস্থান নিলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন