শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনা রাজনীতি ও ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে পারে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০২ এএম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা নিচ্ছে করোনাভাইরাস বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। গত ৩১ মার্চ তিনি আরও বলেছেন, নতুন করোনাভাইরাস সমাজের মূলে আঘাত করছে, জীবন নিচ্ছে এবং মানুষের জীবিকায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। নিকট অতীতে এরকম আর কিছুই দেখা যায়নি। এর আগে গত ২৭ মার্চ হুর মহাপরিচালক বলেছেন, বিশ্বজুড়ে ছড়াতে থাকা করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির কোনো সহজ পথ নেই। এই মহামারী থেকে বাঁচতে হলে আমাদের লড়াই করতে হবে, একতাবদ্ধ থাকতে হবে এবং আরও সক্রিয় হতে হবে। বিশ্বে মন্দা শুরু হয়ে গেছে। গত তিন মাসের অধিক যাবত করোনার কারণে বিশ্ববাসী কল্পনাতীত নানা সংকটে নিপতিত হয়েছে। যেমন: আক্রান্ত হওয়া, মৃত্যু, লকডাউনে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়া,আর্থিক সংকট, মৃত্যুভয়, গৃহবিবাদ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি। এর মধ্যে সর্বাধিক হচ্ছে, মৃত্যুভয় ও আর্থিক সংকট। মৃত্যুভয়ে কাতর হয়েছে রাজা-বাদশা, ধনী-গরীব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই। করোনা কাউকেই রেহাই দিচ্ছে না। ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কারণে বিশ্ব মন্দায় পড়েছে বলে বিজ্ঞজনদের অভিমতের সাথে বিশ্ববাসী একমত। তার জ্বলন্ত প্রমাণ তারা পাচ্ছে প্রতিনিয়তই। এই মন্দাকে মোকাবেলার জন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধ্যমত আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেছে এবং কার্যকর করছে। কিন্তু গরীব ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলো? তারা তেমন কিছুই করেনি। সাধ থাকলেও সাধ্য নেই তাদের। জাতিসংঘ ও কতিপয় সংস্থা কিছু সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তাই এই দেশগুলোর ভবিষ্যৎ কী, তা অজানা। তবে, এদের এবং বিভিন্ন দেশের গরীব মানুষের ভবিষ্যৎ যে ঘোর অন্ধকার, তা প্রায় নিশ্চিত। যেমন: ভারতে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণার পর গত ২৫ মার্চ প্রকাশিত বারনাসীর ছয় শিশুর মাটিতে বসে ঘাস ছিঁড়ে খাওয়ার ছবি দেখে ভারতসহ বিশ্ববাসী চরম মর্মাহত হয়েছে। খবর মতে, ওই শিশুগুলির বয়স পাঁচ বছর। কৈরিপুরের মুসাহার বস্তিতে ওরা থাকে। ওই ৬ শিশু খিদে সহ্য করতে না পেরে ঘাস খাচ্ছিল, যা সাধারণত গবাদি পশুর খাদ্য। আরেকটি ভিডিওতে শিশুগুলিকে একটি প্লেট থেকে ‘ফালিয়ান’ নামক মটরদানা খেতে দেখা যায়। এটিও গবাদি পশুর খাবার। এদের মধ্যে কয়েকটি বাচ্চার বাবা দিনমজুর। কয়েকজনের বাবা ভিক্ষা করে। ভারতে এখন অনেক পরিবারেরই এই অবস্থা। এর বিপরীত খবর হচ্ছে: ভারত বিপুল অংকের ইসরাইলী অস্ত্র ক্রয় করছে। হায়রে মানবতা! মানুষের জীবনের চেয়ে যুদ্ধাস্ত্রের গুরুত্ব বেশি! অবশ্য, গরীব মানুষদের এ চরম দুর্দশায় নিপতিত হওয়ার জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্ষমা চেয়েছেন গত ২৯ মার্চ এক রেডিও বার্তায়।
গত ২৫ মার্চ এএফপির খবরে প্রকাশ: মরক্কোর নাগরিক হাকিম বলেন, আমরা ঘরে আটকা পড়ে গেছি। কোনও কাজ নেই, উপার্জনও নেই। ৩০ বছর বয়সী এ ব্যক্তি গত সপ্তাহেও মরক্কোর রাবাতের একটি বারে কাজ করেছিলেন। মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়াসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউন করা হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দোকানপাট, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ বন্ধ। পুলিশের পাশাপাশি সেনা সদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে। ফলে ফুটপাতের দোকানদাররাও তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়েছে। এই তিন দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। তাদের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। এদের অনেকে বলছেন, করোনাভাইরাসে মরার আগে আমাদের না খেয়েই মরতে হবে। একই অবস্থা উন্নত দেশ ইটালিতেও। অভাবের তাড়নায় দিশেহারা জনগণ। লুটপাট শুরু হয়েছে সিসিলি দ্বীপে। দ্বীপজুড়ে শপিংমল ও সুপারমার্কেটগুলোতে হামলা চালাচ্ছে স্থানীয়রা। রয়টার্সের খবরে প্রকাশ, ভারতে কভিড-১৯ সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। মাঝেমধ্যেই লকডাউন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়ছেন তারা। লিপ্ত হচ্ছেন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে। এদের আটকও করা হচ্ছে। গত ৩০ মার্চও সুরাটে এ অভিযোগে ৯৩ শ্রমিককে আটক করেছে পুলিশ। অন্যদিকে, উত্তর প্রদেশের বেরেলিতে রাস্তায় বসে থাকা শ্রমিকদের ওপর জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতির শিকার বিশ্বের বেশিরভাগ গরীব মানুষই। জাতিসংঘের মতে, বিশ্বে এখনো ৮০ কোটি মানুষ দরিদ্র। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা রিপোর্ট মতে, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলার ব্যাপারে সারা বিশ্বেই সরকারগুলোর ওপর আস্থা হারাচ্ছে সিংহভাগ মানুষ। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও বিশ্বাস রাখতে পারছে না তারা। দেশে দেশে সরকার ও প্রশাসনগুলো মহামারী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম নয় বলে বিশ্বাস তাদের।’ এই আস্থাহীনতার কারণে কোথাও কোথাও সরকারের পতন হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অস্থিরতার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। যেমন: কসোভো সরকারের পতন হয়েছে গত ২৫ মার্চ। করোনা মহামারী প্রতিরোধ নিয়ে কয়েক দিন ধরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বর জেরে দেশটিতে এই অবস্থা হয়েছে। গত ২৮ মার্চ জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার আত্মহত্যা করেছেন। জার্মান মিডিয়ার খবর মতে, করোনাভাইরাসের পরিণতিতে অর্থনৈতিক চাপ কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে তা নিয়ে মন্ত্রী শেফার খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ছিলেন। এএফপি খবরে প্রকাশ, বিশ্বের প্রায় অর্ধেকের মতো মানুষ এ লকডাউনের আওতায় থাকায় পারিবারিক সহিংসতার আশঙ্কা বেড়েছে বলে মনে করছে নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন। জাতিসংঘ বলেছে, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ঘরে যারা নিপীড়নের শিকার হন, তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। আবার টেনশনে ও আতঙ্কে মাদক সেবন ব্যাপক বেড়েছে। অপরদিকে, এ মহাদুর্যোগের কারণে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ইত্যাদি ভেদাভেদ ভুলে মানুষ এক হয়েছে। সকলেই একত্র হয়ে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করছে স্রষ্টার কাছে। গত ২৬ মার্চ করোনা থেকে মুক্তির জন্য খ্রিস্টান, মুসলিম ও ইহুদিরা একসঙ্গে প্রার্থনা করেছে জেরুজালেমে। সেখানে অন্য ধর্মের প্রতিনিধিরাও উপস্থিতি ছিল। এভাবে গরীব ও শ্রমিকরাও কোথাও কোথাও এক হয়েছে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তাদের সমস্বরে এক আওয়াজ: খাবার দাও, বাঁচতে চাই। অপরদিকে, কোথাও কোথাও করোনায় মৃত্যু ব্যাপক হওয়ায় গণকবর দেওয়া হয়েছে, লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও কবর দিতে আপত্তি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, কোথাও কোথাও বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। আবার কোথাও কোথাও কারাগারে ব্যাপক দাঙ্গা হয়েছে করোনা আতঙ্কে। তাতে অনেক নিহত-আহত হয়েছে। করোনা সংশ্লিষ্ট গুজব, মিথ্যা, ভুল ইত্যাদি খবরের অন্ত নেই। এসব নানা কারণে বিশ্ব পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ কী তাই এখনই বলা কঠিন।
করোনার কারণে বাংলাদেশও চরম সংকটে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেমন আর্থিক ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি কাজ-কর্ম বন্ধ হওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। যাদের সংখ্যা ৬ কোটির অধিক। বিবিএস’র সর্বশেষ ‘শ্রমশক্তি জরিপ’ প্রতিবেদন মতে, ‘দেশের মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৮ লাখ। তন্মধ্যে ১৪.৯% প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। বাকী ৮৫.১% (৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার) মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরী স্বল্প এবং অন্য কোনো সুবিধা নেই। উপরন্তু কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অর্থাৎ আইএলও স্বীকৃত কোনও সুবিধাই পায় না তারা। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলমের অভিমত: ‘বিশ্ব বিপর্যয়কারী করোনা বাংলাদেশেও ভয়ঙ্করভাবে এগোচ্ছে। এর অর্থনৈতিক ক্ষতি কত হবে, সেটি এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যেই সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এমনিতেই এ খাতের শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার। কোনও চুক্তি ছাড়াই কাজ করেন।’ গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ‘ঘরে-ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ দেওয়া হবে। ভাসানচরে এক লাখ মানুষের থাকা ও কর্মসংস্থান উপযোগী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে চাইলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ ও ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একইভাবে বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছি। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে।’ সরকার সেবা ও বাণিজ্যিক খাতে আরও কিছু অফিসিয়াল সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এসব সহায়তা হচ্ছে মালিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য। যাদের সংখ্যা খুবই কম। দ্বিতীয়ত: সেই সহায়তাও যথেষ্ট নয় বলে অনেকের অভিমত। যেমন: করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় বেসরকারি সবগুলো খাতকেই আর্থিক সহায়তার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। শুধু রফতানি খাত যার সিংহভাগই গার্মেন্ট শিল্প, সে খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিলের কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা এতে হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, অন্য খাতেও করোনার সমান প্রভাব পড়েছে। সঙ্কট মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন, জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশের সমপরিমাণ বিশেষ তহবিল গঠন এবং এই কৌশল বাস্তবায়ন ও তহবিল ব্যবহারে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের আহবান জানিয়েছে টিআইবি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এক লাখ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও ঢাবির অধ্যাপক আবুল বারকাত। এসব পরামর্শ বিবেচনা করে দেখা দরকার বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারণ, দেশে টাকার তো কোনো অভাব নেই। দ্বিতীয়ত: দেশের অর্থনীতি পুনরায় চাঙ্গা করে তুলতে এর কোনো বিকল্প নেই।
খেটে খাওয়া মানুষের জন্য বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ ও ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ এবং টিসিবির ন্যায্যমূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এর সুবিধাভুক্ত মানুষ সামান্য। ১০ টাকা কেজি দরে চালের ক্ষেত্রেও তাই। আর টিসিবির খাদ্যদ্রব্য সবার জন্য অবারিত। কিন্তু এই ১০ টাকা কেজি দরে চাল ও টিসিবির খাদ্যদ্রব্য কেনার সামর্থ্য তো নেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। কারণ, তাদের তো এখন কোন কাজ নেই, তাই উপার্জন নেই। যেখানে কাজ থাকতেই সংসার চলে না, সেখানে কাজ না থাকতে চলবে কীভাবে? গত ২৯ মার্চ এক দৈনিকে প্রকাশ, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে অঘোষিত লকডাউনের শুরুতেই বিপাকে পড়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক লাখ হতদরিদ্র মানুষ। পাটকল ও মাছ কোম্পানিসহ উৎপাদনমুখী কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় কর্মহীন শ্রমিক পরিবারে দেখা দিয়েছে হতাশা। রিক্সা-ভ্যান ইজিবাইকচালক, রাজমিস্ত্রি, সবজি বিক্রেতা, দিনমজুরসহ অসংখ্য মানুষ সীমাহীন কষ্টে দিন পার করছে। একইভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের শহর ও গ্রামে-গঞ্জে কর্মহীন অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে অভুক্ত থাকছে’। এরূপ করুণ চিত্র কম-বেশি সারাদেশেই! এই অবস্থায় দেশে কাজ সৃষ্টি করতে হবে। সে লক্ষ্যে সারাদেশে কাবিখা ইত্যাদি এবং রাস্তাসমূহের সংস্কার কাজ শুরু করতে হবে অবিলম্বে। তাহলে অনেক দরিদ্র মানুষের কর্ম সৃষ্টি হবে। তেমনি গৃহ নির্মাণ ঋণ ব্যাপক হারে প্রদান করা হলে বহু নির্মাণ শ্রমিকের কাজ সৃষ্টি হবে। লকডাউন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে দেশের সব খাতের কর্ম শুরু করতে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা দরকার। কৃষি ও কৃষি খাতের শ্রমিকদের রক্ষার লক্ষ্যে কৃষির উন্নতির জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, এই করোনায় কৃষি খাতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যোগাযোগ বন্ধ থাকায়। যেমন: খবরে প্রকাশ, পাবনায় দুগ্ধখামারী চরম বিপাকে পড়েছে। দুধের কেজি ৫ টাকা। কুষ্টিয়া থেকেও এরূপ খবর প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে শাক-সবজী ও তরকারী মাঠে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন স্থান থেকে খবর পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলে খামারের একেকটা ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ৪-৫ টাকা করে। আর মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪৪-৫৫ টাকা করে। অথচ ব্রয়লার মুরগির কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ ৯০ টাকার বেশি। বিপিআইসিসি’র সভাপতি বলেছেন, বাচ্চা এখন মেরে পুঁতে ফেলা হচ্ছে। কারণ, এক টাকা দাম দিয়েও কেউ নিচ্ছে না। ফলে পোলট্রি খাতে দিনে ক্ষতি শত কোটি টাকা। স্মরণীয় যে, দেশে করোনা সংক্রমণ যদি এখনই বন্ধ হয় যায়, তবুও এ পর্যন্ত যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটাতে অনেকদিন লেগে যাবে। এই সময়ের মধ্যে গরীব মানুষরাই সর্বাধিক ক্ষতির মুখে থাকবে। বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হবে। হু বলেছে, এশিয়ায় করোনাভাইরাস মহামারী শেষ হতে এখনো বহু দেরি আছে। জাতিসংঘ গত ২৯ মার্চ বলেছে, অতি দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশে। এই অবস্থায় পশ্চিমারা ঢাকা ছেড়ে দেশে, যা কিনা মৃত্যুপুরী, সেখানে চলে যাচ্ছেন ভালো চিকিৎসার আশায়। এ দেশে করোনার ভালো চিকিৎসা থাকলে হয়তো তারা যেতেন না।
সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশের গরীব ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে আপদকালীন তহবিল গঠন করে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ ক্ষুধার্ত মানুষদের বাঁচাতে হবে। এটাই সর্বাধিকারযোগ্য। এটা মানবিক দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত: দেশের উন্নতির চালিকা শক্তিও তারা। পবিত্র রমযান আসন্ন। এই সময় তাদেরকে রক্ষা করা না হলে তাদের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে এই ফরজ এবাদত পালন করা কঠিন হবে। তাই শ্রমিকদের রক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মালিকদেরও বিশেষ ভূমিকা পালন করা দরকার। কারণ, গাভী বাঁচলে দুধ পাওয়া যায়। শ্রমিকদের রক্ষা করা না হলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যেই তার আলামত স্পষ্ট। যেমন: গত ২৯ মার্চ কারখানা বন্ধ ও বেতনের দাবিতে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ চলেছে আশুলিয়ার দুই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের। এর আগে ঈশ্বর্দীর ইপিজেডে ও দিনাজপুরে পাটকলের শ্রমিকরা বকেয়া বেতন পরিশোধ ও কারখানা বন্ধ করার দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। তাছাড়া, অভাবের তাড়নায় অনেকে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদি কর্মেও লিপ্ত হতে পারে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই কর্মহীন মানুষদের তালিকা করে সহায়তা করার নির্দেশ দিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে। একই নির্দেশ তিনি ডিসিদেরও দিয়েছেন গত ৩১ মার্চ। কিন্তু এ কাজটি কতদিনের মধ্যে শেষ হবে, কতজনের তালিকা করা হবে, কতদিন সহায়তা দেওয়া হবে, কতটুকু করে সহায়তা দেওয়া হবে, দলীয়করণ, দুর্নীতি হবে কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। তাদের এ প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ দিকে কড়া নজর রাখা আবশ্যক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Md Riaz ৫ এপ্রিল, ২০২০, ১:৩১ এএম says : 0
ইনশাআল্লাহ করোনা ভাইরাস একমাসের মধ্যে চলে যাবে।শুধু নামায পড়ে আল্লাহর কাছে কাঁদেন।
Total Reply(0)
মোহাম্মদ কাজী নুর আলম ৫ এপ্রিল, ২০২০, ১:৩১ এএম says : 0
কার মৃত্যু কোথায় হবে, কিভাবে হবে! সেটা শুধু আল্লাহ পাক জানেন!! তাই ভাইরাস কে ভয় না করে যদি ভাইরাস দিয়েছেন সে মহান আল্লাহ তায়ালা-কে ভয় করুন।
Total Reply(0)
Shah Shahjahan ৫ এপ্রিল, ২০২০, ১:৩৪ এএম says : 0
ক্ষমতাসীদের সাহায্য নিয়ে যে সব দুর্নীতিবাজ ডাকাতরা ৯লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে ,সময় এখন টাকা গুলো ফিরিয়ে এনে এই দুর্যোগে কাজে লাগানো। জনগন এত দিন দুর্নীতির মহা উৎসব দেখেও কার্যকর কোন প্রতিবাদ না করার ফল এখন দেখা যাচ্ছে খাদ্য অভাবে মানুষের হাহাকারে ।
Total Reply(0)
Tanmoy Kumar ৫ এপ্রিল, ২০২০, ১:৩৭ এএম says : 0
বাংলাদেশে এমন অনেক লোক আছে যারা দিনে আয় করে দিনে খাই সে সকল লোকের মুখে খাদ্য তুলে দিতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার
Total Reply(0)
মোহাম্মদ মোশাররফ ৫ এপ্রিল, ২০২০, ১:৩৭ এএম says : 0
আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করুন, আমিন
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন