বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

হাইড্রোলিকে সুখের ঠিকানায় তারেক

প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. আমিনুল হক, মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে
২০০২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে নিজের তৈরি করা হাইড্রোলিক পাম্পের সাহায্যে নিজের বাড়িতে প্রথমে পানি উঠান। এ পাম্প দেখে ধীরে ধীরে চারিদিকের মানুষ ভিড় জমান তার বাড়িতে। বেড়ে যায় এ হাইড্রেলিক পাম্পের চাহিদা। এভাবে শুরু হয় তারেকের এই পাম্পের যাত্রা। ২০০৪ সালে আসে সাফল্য। এর ফলে এক সময়ের শ্যালো মেকার তারেক ইসলামের জীবন চিত্র পাল্টে গেছে। এভাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে তৈরি করেন ৪টি পাম্প টিউবওয়েল। দেশের মধ্যে প্রথম ৪টি আধুনিক পাম্প টিউবওয়েল উদ্ভাবন করে খুঁজে পেয়েছেন সুখের ঠিকানা। তারেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, একের পর এক অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন সংগ্রামের সৈকতসম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে হিমশিম খায়। তখন শুরু করেন শ্যালো মেশিনের মেকানিকের কাজ। ৫ বছর মেশিনের কাজ করে এলাকাজুড়ে সুনাম অর্জন করেন শ্যালো মেকার হিসেবে। এ কাজ করার পাশাপাশি তারেক চিন্তা করতে থাকে নতুন কিছু তৈরি করার। ভাবতে ভাবতে মাথায় বুদ্ধি আসে নতুন রূপে দেশীয় মেশিনের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে টিউবওয়েল তৈরি করার। পুরনো শ্যালো মেশিনের যন্ত্রপাতিগুলো ফেলে না দিয়ে কাজে লাগানো। তারপর বাড়িতে বসেই শুরু করেন পুরনো শ্যালো মেশিনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা। শ্যালো মেশিনের পুরনো লায়নার, রিকশা-ভ্যানের পুরনো এক্সএল, বেয়ারিং, পুরনো লোহার পাইপ, মেশিনের ওয়ারগ্যালন প্রভৃতি সংগ্রহ করেন। লায়নার দিয়ে টিউবওয়েলের বডি, রিকশার এক্সেল দিয়ে হাতল, পাইপ দিয়ে টিউবওয়েলের গোড়ার অংশ এয়ারগ্যালন দিয়ে উপরের অংশ তৈরি করে ঝালাই দিয়ে বেয়ারিং লাগিয়ে তৈরি করেন টিউবওয়েল। প্রথমে নিজের বাড়িতে লাগান এই টিউবওয়েল। টিউবওয়েলে পানি উঠে বেশি, শব্দকম, খরচ কম, দেখতে ভালো। দেখার কারণে আশপাশের গ্রামের মানুষ দেখতে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে টিউবওয়েলের খবর। নিজের পরিবার ও এলাকার মানুষের উৎসাহ বেড়ে যায়। প্রতিবেশীরা তারেকের তৈরি টিউবওয়েল পছন্দ করে। চারদিকে বাড়তে থাকে টিউবওয়েলের চাহিদা। এভাবে ৬ মাসে টিউবওয়েল তৈরির কাজে সুনাম কুড়াতে থাকে তারেক। তার একটি টিউবওয়েলের নাম রাখেন তারেক পাম্প। এভাবে ডায়বেটিস পাম্প, ফায়ার সার্ভিস পাম্প, সাধারণ পাম্প ও পরে হাইড্রলিক। এরমধ্যে হাইড্রোলিক পাম্প বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই সে এলাকায় ইটের বিল্ডিংয়ের একশ’ ফুট উঁচু পর্যন্ত এই টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি ¯েপ্র করে ভিজানো যায়। হাটবাজার, বাড়ি-ঘর, দোকানপাটসহ কোথাও আগুন লাগলে এই পাম্পের সাহায্যে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা ছাড়াই অতিসহজে পাইপের মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপন করা যায়। এতে যে এলাকায় রাস্তাঘাট খারাপ সে এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গাড়ি নিয়ে যেতে পারে না এবং পানির উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় সে এলাকায় তারেকের তৈরি ফায়ার সার্ভিস পাম্প ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। এ পাম্প বিভিন্ন হাটবাজার ও বসত বাড়িতে সাশ্রয়ী মূল্যে স্থাপন করে গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি আগুন নিভানো কাজে ব্যবহার করছে। বন্যার সময় পাম্পের ভিতরে দূষিত পানি ঢুকে না। বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। এতে রোগ বালাই থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর শহর থেকে ১০ কিঃমিঃ উত্তরে অরণখোলা ও মির্জাবাড়ি ইউনিয়নের মধ্যবর্তী ভবানীটেকি গ্রামে ১৯৭৫ সালে তারেক জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আঃ ছামাদ। মাতার নাম জহুরা বেগম। ৬ ভাই ১ বোনের মধ্যে তারেক সবার ছোট। সরেজমিন ভবানীটেকি গ্রামে গেলে জানা যায়, তারেকের পাম্প টিউবয়েল তৈরির মজার কাহিনী। ১৯৮৮ সালে তারেক পুরনো শ্যালো মেশিনের ব্যবসা করতেন। পুরনো নষ্ট মেশিন কিনে তা মেরামত করে বিক্রি করতেন। এতে তার যে আয় হতো তা দিয়ে তারেকের সংসারের অভাব দূর হতো না। এভাবে কিছু দিন ব্যবসা করার পর তারেক চিন্তাকরে বের করেন বন এলাকার মানুষের জন্য পানীয় জলের আধুনিক পাম্প টিউবওয়েল তৈরির। তার পাম্প তৈরি দেখে প্রথমে এলাকার মানুষ তাকে অবহেলার চোখে দেখত। রাত দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রথমে তৈরি করেন সাধারণ পাম্প টিউবওয়েল (তারেক পাম্প)। এ পাম্প দিয়ে বেশি পরিমাণে পানি, দামে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্য থাকা ও টিউবওয়েল চাপতে শক্তি কম লাগায় এর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তারপর ২০০২ সালে তার নিজ গ্রাম ভবানীটেকি চোরাস্তা মোড়ে খুলে বসেন ছোট আকারের ওয়ার্কসপ। এরপর তৈরি করেন ২ পা দিয়ে চেপে পানি ওঠানোর আধুনিক টিউবওয়েল। তার নাম দেন ডায়াবেটিকস পাম্প টিউবওয়েল। যাদের ডায়াবেটিক আছে তাদের জন্য এ টিউবয়েল ব্যাপক উপকারী। তারেক জানায়, এ টিউবওয়েল প্রতিদিন ১০/২৫ মিনিট চেপে পানি উঠালে গৃহস্থালির পানির চাহিদা মিটবে এবং ডায়াবেটিকস অনেকটা আয়ত্বে আসবে। এ পাম্প থেকে প্রতিমিনিটে ৩০-৪০ লিটার পানি উঠানো সম্ভব। এ টিউবওয়েলের দাম ১০ হাজার টাকা। এভাবে ১ বছরের মধ্যে মাথা খাটিয়ে বের করেন যে এলাকায় বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা নেই সে এলাকার বিল্ডিংয়ের ছাদের ট্যাংকিতে পানি উঠানোর জন্য তৈরি করেন হাইড্রোলিক পাম্প। যত বেশি প্রেসার দিয়ে ফায়ার সার্ভিস পাম্পটি চাপা হবে তত বেশি উপরে পানি উঠবে। টিউবওয়েলের মুখে রাবারের পাইপ লাগিয়ে হাতলে প্রেসার দিতে থাকলে ১Ñ২শ ফুট উপরে পানি উঠানো সম্ভব বলে তারেক জানান। এ তিনটি টিউবওয়েলেই ১শ থেকে ২শ ফুট গভীর থেকে পানি উঠনো যায়। স্থান উঁচু হলেও কোন সমস্যা নেই। পাম্প টিউবওয়েল তৈরির জন্য অক্সফাম সহায়তায় মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ ও মধুপুর গড় ক্যাম্পেইন গ্রুপ আয়োজিত “গ্রামীণ জীবনযাত্রা মেলা-২০১২” তে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক হিসেবে কৃষি সম্মাননা পেয়েছেন। তারেকের এ চারটি পাম্প টিউবয়েল তৈরির ওয়ার্কসপের নাম দিয়েছেন হাসান ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ। তার ইঞ্জিনিয়ারিং ওর্য়াকসপে ২ জন কর্মচারীকে মাসিক বেতন হিসেবে কাজ করে। প্রথমে এলাকায় পাম্প টিউবয়েলগুলো বিক্রি হলেও এখন আশপাশের জেলাগুলোতেও বাড়ছে তারেকের টিউবওয়েলের চাহিদা। মমিনপুর গ্রামের চন্দন জানান, আমি তারেকের পাম্প ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছি। আমাদের এলাকায় হাইড্রোলিক পাম্পের ব্যপক চাহিদা। এ পাম্প শিশুরা চাপতে পারে। কম শক্তিতে বেশি পানি ও পরিবেশবান্ধব। এক সময়ে অভাবী বেকার যুবক তারেকের এখন আর পিছে ফিরে তাকাতে হয় না। এখন তার মাসে আয় ১৫/২০ হাজার টাকা। বিভিন্ন উপজেলার কৃষি ও প্রযুক্তি মেলায় স্টল দিয়ে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন