ইনকিলাব ডেস্ক : বাংলাদেশে তাজরিন গার্মেন্টে অগ্নিকা-ে অন্তত ১১৭ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক প্রাণহানি সবাইকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় এর আগে এত বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা আর ঘটেনি। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে আশুলিয়ায় তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্ট ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ভস্মীভূত হয়। এতে বিপুল প্রাণহানি ছাড়াও দুই শতাধিক শ্রমিক আহতও হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ভয়াবহতম অগ্নিকা- সারা বিশ্বের মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করে। পোশাক শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার আশু প্রয়োজনীয়তা বিশ্বব্যাপী আলোচনায় চলে আসে। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, বাংলাদেশের চেয়েও আরও বড় অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। সেখানে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকা-ে দেড়শোর মতো শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল। সেই ঘটনার জেরে আমেরিকায় শ্রম আইন ও শ্রমনীতি আমূল বদলে গিয়েছিল। যার সুফল আজ আমেরিকার শ্রমজীবি মানুষ ভোগ করছে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্কে পোশাক কারখানায় বিশাল এক অগ্নিকা- গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছিল।ওই অগ্নিকা-ে মারা যান কারখানার ১৪৬ জন পোশাক শ্রমিক, যাদের বেশিরভাগই অভিবাসী তরুণী।
ওই ঘটনা আমেরিকার শ্রমখাতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের বিষয়টা সামনে এনেছিল।
ওই ঘটনার পর আমেরিকান শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল যুগান্তকারী শ্রমনীতি। নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট পোশাক কারখানায় ওই আগুন লেগেছিল ১৯১১ সালে। শহরের প্রায় ৫০ লক্ষ জনসংখ্যা ওই সময় প্রতিদিন দ্রুত বাড়ছে। হাজার হাজার অভিবাসী এসে বসতি গড়ছে নিউ ইয়র্ক শহরে। বহু নবাগত অভিবাসী তখন কাজ নিচ্ছে শহরের ফুলেফেঁপে ওঠা পোশাক শিল্পে।
ওই কারখানায় যেসব মেয়ে কাজ করতেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন অল্পবয়সী- অনেকে ইতালীয়, অনেকে পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা ইহুদী। বেশিরভাগ শ্রমিকই থাকতেন অন্ধকার ঘুপচি ঘরে, যেখানে আলো বাতাস ঢুকত নাÑএসব বাসস্থান ছিল রোগিব্যাধির আখড়া। কিন্তু প্রতিদিন সকালে তারা যে ট্রায়াঙ্গেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যেতেন সেখানে ছিল উন্নত কাজের সাজসরঞ্জাম ও ব্যবস্থা। কারখানায় কাজ করতেন পাঁচশর মত শ্রমিক।
ঐতিহাসিক মাইকেল হার্শ বিবিসিকে বলেছেন নিউইয়র্কের নতুন একটি বহুতল ভবন যেখানে আটতলা, ন’তলা আর দশতলা জুড়ে ওই পোশাক কারখানা ছিল, সেখানে এমন ধরনের সুযোগসুবিধা ছিল যা শ্রমিকরা নিজেদের আবাসিক এলাকায় স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতেন না। প্রচুর খোলামেলা জায়গা, জানালা দিয়ে প্রচুর আলোবাতাস, বিদ্যুৎ, কলে চব্বিশ ঘণ্টা গরম ও ঠা-া পানি। ভেতরেই টয়লেটের ব্যবস্থা।
ওই কারখানার আটতলায় আগুন লাগে ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ। দিনের কাজের শেষে ছুটির সময় প্রায় হয়ে এসেছে। হঠাৎ বর্জ্য কাপড়ে ভরা এক ঝুড়ি থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কারখানা ঘরের একপাশ থেকে অন্য পাশে। চোখের পলকে তা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সেই সময় ওই কারখানার কর্মী পলিন পেপে পরে বলেছেন শত শত শ্রমিক আগুন লাগতেই দৌড় দেন লিফট আর সিঁড়ির দিকে। কিন্তু প্রায় দেড়’শ শ্রমিক সেখান থেকে নামার জন্য ঠেলাঠেলি করছে। কিন্তু মানুষের চাপে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার দরজা অতি দ্রুত আটকে যাওয়ায় শ্রমিকরা প্রাণভয়ে ছোটেন লিফটের দিকে। লিফটচালকদের সহায়তায় ও তাদের সাহসিকতায় বেশ কিছু শ্রমিক প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু বের হতে যারা পারেননি, তাদের অনেকে আতঙ্কে ঝাঁপ দেন একশ ফুট উঁচু জানালা থেকে। আগুনে মারা যান ১৪৬ জন শ্রমিক।
ট্রায়াঙ্গেল পোশাক কারখানায় যারা কাজ করতেন আগুন লাগলে কী করতে হয় সে বিষয়ে তাদের কোনো ট্রেনিং ছিল না। আগুন লাগলে কোন পথ দিয়ে কীভাবে নিরাপদে বের হতে হবে সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। আগুনের সময় বেরুনোর দরজাগুলো কোথায় তাও তারা জানতো না।
ওই ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের শাসনকালে আমেরিকার শ্রমনীতিকে যখন ঢেলে সাজানো হয়েছিল, তখন ওই শ্রমনীতি আমেরিকায় শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও কর্মজীবনে আমূল পরিবর্তন আনে।
নতুন যেসব আইন পাশ হয় তাতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়, শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে সরকারকে দায়বদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সূত্র : বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন