শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

স্কুল ব্যাংকিংয়ের সাফল্য

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সিনথিয়া পারভীন কাকলী : বিশ্বের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ব্যাংক’। আর্থিক লেনদেকে সহজ ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে শুরু হয় ব্যাংকিং কার্যক্রম। ব্যাংক মানুষকে অধিক সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। মানুষের বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করা-ই ব্যাংকের অন্যতম কাজ। এই ক্ষুদ্র অর্থ একসময় পরিণত হয় বৃহত্তর অংকে। বিনিয়োগ করা হয় উৎপাদনশীল কাজে। এসব কার্যক্রম থেকে যে মুনাফা আসে তারই একটি অংশ দেয়া হয় সঞ্চয়কারীকে। এতে ব্যক্তির অর্থিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে।
মানুষ তার কষ্টার্জিত অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য ব্যাংকে সংরক্ষণ করে। শুধু অর্থ নয় মূল্যবান অলঙ্কারাদিও এখানে রাখা হয়। ব্যাংকিং সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ব্যাংক নানা প্রকার কর্মসূচি বা সেবা প্রদান করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকিং কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে এটিএম, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো সেবা পদ্ধতি। যা মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ ও গঠনমুখী করে তুলেছে। লেনদেনে ঝুঁকির পাশাপাশি জাল-জালিয়াতিও কমেছে। মানুষ ঘরে বসেই ব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে। দিন দিন ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রতি মানুষের আস্থাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যাংক শুধু অর্থ সঞ্চয় ও সংগঠিত করে না। বেকারত্ব দূরীকরণেও রয়েছে ব্যাংকের অগ্রণী ভূমিকা। তাছাড়া ব্যাংক যেসব জায়গায় বিনিয়োগ করে থাকে সেখানে নতুন কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ব্যাংক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিয়ে থাকে। এটাকে কাজে লাগিয়ে ঋণগ্রহীতা নিজ উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দিতে পারেন।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। আর বেশিরভাগ কৃষকই দারিদ্র্যসীমার মধ্যে রয়েছে। ফলে অর্থাভাবে সময়মত বীজ বপন, সেচ, সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারে না। এতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয় কৃষকরা। ব্যাংক এসব দরিদ্র কৃষকরে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে কৃষি কর্মেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চাকরিজীবীরাও ব্যাংকগুলোর ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না।
১৮ বছরের বেশি বয়সের অর্থাৎ সাবালক ছাত্র-ছাত্রীদেরও বর্তমানে কিছু ব্যাংক শিক্ষা ঋণ দিচ্ছে। যা শিক্ষা কার্যক্রমে পজেটিভ প্রভাব রাখছে। ব্যাংকিং কার্যক্রমে এতদিন সর্বসাধারণ অন্তর্ভূক্ত থাকলেও এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশুরা। এই শিশুদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ‘স্কুল ব্যাংকিং’ নতুন সেবা কার্যক্রম চালু হয়েছে। এটি আর্থিক অন্তর্ভূক্তিমূলক কার্যক্রম বা ফিনান্সিয়াল ইনক্লশনের একটি বিষয়। এই কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশুদের অর্থাৎ স্কুলগামী শিশুদের। সংযুক্ত করা হয়েছে পথশিশুদেরও। এরই মধ্যে দেশের প্রায় সকল ব্যাংক’ই এই ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু করেছে।
স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের সঞ্চয়ে আগ্রহী করতে ২০১০ সালে দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে স্কুল ব্যাংকিং সেবা চালু করার পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই আলোকে বিদ্যালয়গামী শিশুদের জন্য চালু করা হয় আকর্ষণীয় মুনাফাসহ বিভিন্ন স্কিম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বর্তমানে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ। গত জুন শেষে এ সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৫২ হাজার। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে ক্ষুদে সঞ্চয়ীদের মোট জমার পরিমাণ প্রায় ৮শ’ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই বিরাট পরিমাণ অর্থ দিয়ে নতুন আরো দুইটি ব্যাংক চালু করা সম্ভব। স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক অপেক্ষা বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে রয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে আরো তৎপর হলে অধিক সাফল্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম এমন একটি কার্যক্রম যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারবে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে জমাকৃত অর্থ লভ্যাংশসহ উত্তোলন করতে পারবে। পূর্বে শিশুরা মাটির ব্যাংকে টাকা জমা রাখত। সামান্য প্রয়োজন হলেই অভিভাবকরা ব্যাংক ভেঙে টাকা বের করে নিত। প্রায়ই দেখা যেত তারা বিশ্বস্ত কারো কাছে টাকা জমা রাখত। এখানে একটা ঝুঁকি থেকেই যেত। সময়মত টাকা ফেরৎ না পেয়ে এবং ব্যাংক ভেঙ্গে ফেলায় তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের আগ্রহ কমে যেত। স্কুল ব্যাংকিং শিক্ষার্থীদেরকে এই ঝুঁকি বা অবিশ্বাস থেকে বের করে এনে একটা নিরাপদ ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
হিসাবী এবং সঞ্চয়ী জাতিই কেবল সচ্ছলতা লাভ করতে পারে। শিশুরা ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাই শিশুকাল থেকেই তাদের মধ্যে সঞ্চয়ী হওয়ার প্রবণতা তৈরি করতে হবে। কোন অভ্যাস হঠাৎ করে হয় না। শিশুকাল থেকেই এ অভ্যাস তৈরি করতে হবে। স্কুল ব্যাংকিংয়ে জমাকৃত অর্থ একসময় শিশুটির উচ্চ শিক্ষায় সহায়ক হতে পারে। চাইলে এই অর্থ সে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকা-েও লাগাতে পারবে। অনেক সময় দেখা যায় লেখাপড়া শেষ না হতেই দরিদ্র পিতা-মাতা তার লেখাপড়ার সংস্থান করতে অক্ষম হয়ে যায়। এই জমাকৃত অর্থ তখন তাকে সহায়তা করবে। জমা অর্থের বিপরীতে ব্যাংক ঋণও সে পেতে পারে।
আমাদের দেশে স্কুল ব্যাংকিং বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তারই ফলস্বরূপ চাইল্ড এন্ড ইয়্যুথ ফাইনান্স ইন্টারন্যাশানাল (সিওয়াইএফআই) প্রদত্ত ‘চাইল্ড এন্ড ইয়্যুথ ফাইনান্স ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’ অর্জন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম বিশেষ করে শিশুদের আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং স্কুল ব্যাংকিংয়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। ভারত ও ফিজিকে পিছনে ফেলে আমাদের দেশ এই পুরস্কার লাভ করেছে। অর্থিক শিক্ষা কর্মসূচিতে অবদান রাখার জন্য ২০১৪ সালে এ অঞ্চল থেকে সিঙ্গাপুরকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। ‘চাইল্ড এন্ড ইয়্যুথ ফাইনান্স ইন্টারন্যাশনাল’ ইউরোপের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান। আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সারা বিশ্বের ১২৫টি দেশের ৩ কোটি শিশু ও যুবককে নিয়ে কাজ করে। তারা বৃহৎ পরিসরে আর্থিক অন্তর্ভূক্তিতে অবদান রাখার জন্য ব্যক্তি, সরকারি সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সুধী সমাজের সংগঠনকে পুরস্কৃত করে থাকে। পুরস্কার প্রদানের সময় শিশুদের ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রসংশা করা হয়েছে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আন্দোলনে বাংলাদেশের সফলতা, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঈর্ষণীয় সাফল্য ইতমধ্যেই দেশকে বিশ্ববাসীর নিকট ‘রোল মডেল’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। দেশের সব শিশুকে এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরো শক্তিশালী হবে। ‘স্কুল ব্যাংকিং’য়ের সফলতা অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
ষ লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন