বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

ফিরিয়ে দেয়া হোক মাতামুহুরীর যৌবন

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলাউদ্দিন কবির : এখনকার মাতামুহুরী আর আমার শৈশব-কৈশোরের মাতামুহুরীতে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ইদানীং মাতামুহুরীর চেহারাটা দেখলেই মনটা বিষণœতায় ভরে যায়। আনমনেই নস্টালজিক হয়ে পড়ি। স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে এককালের প্রমত্তা মাতামুহুরীর উচ্ছল অবয়ব। মাতামুহুরীর সঙ্গে আমার বন্ধন যে আত্মার এবং অনেক পুরনো !
নানার বাড়ি মাতামুহুরীর তীরবর্তী এলাকায় হওয়ায় সেই ছোট্ট বয়স থেকেই তাকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। মায়ের সঙ্গে যখন নানার বাড়ি বেড়াতে আসতাম, তখন মাতামুহুরীর স্বচ্ছ জলরাশির প্রেমে পড়ে নির্ধারিত দিনের চেয়ে কয়েকদিন বেশিই থেকে যেতাম। প্রতিদিন দুপুরে সাঁতার না জানা আমি মামাদের পিছু পিছু ছুটে যেতাম ¯œান করতে। কী স্বচ্ছ জলরাশি আর কী প্রবহমান ¯্রােতই না ছিলো তখন মাতামুহুরীর! ভাবলেই অবাক লাগে। নদীরও যে মানবজীবনের মতো যৌবনের জোয়ার আর বার্ধক্যের ভাটা থাকতে পারে, তা ছিলো কল্পনাতীত। আমার সেই অকল্প কথাটাই আজ দুঃখজনকভাবে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের সমবয়সী কিংবা অগ্রজদের প্রায় প্রত্যেকের মানসিক অবস্থাই এখন এমন দুঃখময়, এমন হাহাকারে মোড়া।
হবেই না বা কেনো, যে মাতামুহুরীর জলরাশি ছিলো দুই কূলের নরনারীর ¯œান-আহারের মাধ্যম হিসেবে প্রথম পছন্দ। সেই মাতামুহুরীর বুকেই যে আজ পানির হাহাকার। এ যেনো জলের অভাবে জলাধারের প্রাণই ওষ্ঠাগত! এখন কেবল মাতামুহুরী সেতুর দৈর্ঘ্য এবং দু পাশের চওড়া চরগুলোই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এককালের জলপূর্ণ যৌবনা মাতামুহুরীর।
যেসব ভদ্রলোক মাতামুহুরীর প্রমত্তা রূপ দেখেননি, তাদের কেউ যদি এখনকার মাতামুহুরী দেখে বলে উঠেন, ‘এটা কী করে নদী হয়? এটা তো মাঝারি সাইজের একটি খালমাত্র!’ হলফ করে বলতে পারি, প্রিয় পাঠক, আপনি মাতামুহুরীর যতো খাঁটি প্রেমিকই হোন না কেনো, ওই ভদ্রলোকের কথা মেনে নেয়া ছাড়া আপনার কোনো গত্যন্তর থাকবে না বা নেই। এটাই যে তিক্ত বাস্তবতা!
যে কোনো সযতœলালিত বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বস্তুর ধ্বংসকার্য বা বিলুপ্তি যেমন একদিনে হয় না; বরং বেহিসেবী আচরণ ও অস্বাভাবিক ব্যবহারের অবিরত আগ্রাসনের ফলেই একটা সময় বিলুপ্তির চূড়ান্ত চিত্র প্রকাশ পায়, তেমনি আমাদের তথা চকরিয়া, লামা ও আলীকদমবাসীর বহুবিধ বন্ধনের আত্মীয় মাতামুহুরীর অবস্থার অবনতিও ঘটেছে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলে আসা নদীবৈরী আচরণ ও কর্মকা-ের ফলে। গত ২৩ জানুয়ারি ১৬’র দৈনিক যায়যায়দিনে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট যার দুঃখজনক সাক্ষী। এ লেখায় ওই রিপোর্টের কিছুটা পুনর্পাঠ নেওয়া যাক, “...দুই দশক আগে মাতামুহুরী ৩০-৪০ ফুট গভীর এবং প্রায় ১৫শ’ ফুট প্রস্থ ছিল। নদীর উজানে লামা-আলীকদম পাহাড়ে দুই দশকে ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধন, বাঁশ কর্তন ও পাহাড়ে জুম চাষের কারণে মাটি ক্ষয়ে নদীতে পড়েছে। এ ছাড়াও পাহাড় কাটা, ঝিরি খুঁড়ে ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবাধে পাথর উত্তোলনের কারণে নদীতে মাটি পড়ে ভরাট হয়েছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই পাহাড়ি ঢলে নদীর দুই তীরে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। গত বছর কয়েক দফা বন্যায় উপজেলার আঠার ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় জেলে পরিবারগুলোর মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে।” নদীমাতৃক এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা পাবার অন্যতম শর্ত হলো এদেশের নদীগুলোর যথার্থ নাব্যতা সংরক্ষণ। তা না হলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ দেখার জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যাদুঘরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। দেশের নদীমাতৃক পরিচয় অক্ষুণœ রাখতে এবং মাতামুহুরী নদীর ওপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলোর সুদিন ফেরাতে আর চকরিয়া উপজেলার মানুষের বর্ষাকালীন বন্যাজনিত দুর্ভোগ কমাতে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা অত্যাবশ্যক। আশার কথা, পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের উদ্যোগে নদী ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হবে। মাতামুহুরী নদী ড্রেজিংয়ের জন্য ৩ কিলোমিটার জায়গা অনুমোদন হয়েছে বলে জানা গেছে।
আমরা চকরিয়াবাসী এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে চাই যে, উল্লিখিত অনুমোদিত ৩ কিলোমিটারসহ অবশিষ্ট জায়গারও অনুমোদন অতিসত্বর দেয়া হবে, এবং আগামী বর্ষার আগে আগেই ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে বার্ধক্য ও নাব্যতাহীনতায় ভোগা প্রিয় মাতামুহুরীকে ফিরিয়ে দেয়া হবে হৃত জলরাশিময় যৌবন! আমরা আরো দেখতে চাই, মাতামুহুরীর তীরের জেলে পরিবারগুলোর মুখে ফুটে ওঠেছে তৃপ্তির হাসি! সর্বোপরি, নদীর সুফল পেতে শুরু করেছে চকরিয়ার সাধারণ মানুষ।
ষ লেখক : অর্থ-সম্পাদক, জাগৃতি লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন