শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

পৃথিবীতে কমেছে মানুষের আস্ফালন অহঙ্কার (এক)

করোনাভাইরাসে লকডাউনের প্রভাব : দেশে দেশে শত শত কোটি মানুষ ঘরবন্দি- পৃথিবী এখন কাঁপছে কম : বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২০, ১:৫১ পিএম | আপডেট : ২:৫০ পিএম, ৮ এপ্রিল, ২০২০

করোনার ভয়-আতঙ্কে কাবু তাবৎ বিশ্ববাসী। তাই পৃথিবীকে সারাক্ষণ অস্থির করে রেখে মানুষ এখন আর দাপিয়ে বেড়ায় না। কমেছে মানুষের অহঙ্কার আস্ফালন সদদ্ভে বিচরণ। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বৈশ্বিক মহামারি সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বিশ্বজুড়ে শত শত কোটি মানুষ এখন কাজকর্ম ছেড়ে বাড়িঘরে ঠায় বসে আছে। নিজেকেই বন্দি করে নিয়েছে সে।
এরফলে এই পৃথিবীর গতিবিধি বদলে গেছে। অবিরত যাচ্ছেও। কারণ মানুষ বাইরে যাচ্ছেনা বলেই গাড়ি ট্রেন ভারী যান্ত্রিক সব বাহন চলছে খুবই কম। লাখ লাখ ভারী শিল্প-কারখানা এখন বন্ধ। এর সুপ্রভাবে ভূ-পৃষ্টের উপর চাপ কমে গেছে অনেক। এরফলে পৃথিবী এখন কাঁপছে কম। বিশ্বখ্যত বিজ্ঞানীদের চলমান গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ তথ্য সূত্রে একথা জানা গেছে।
সমগ্র পৃথিবীর ওজন ছয় বিলিয়ন ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন। আর সেই পৃথিবী নামক বাসযোগ্য গ্রহটি সাড়ে ৭ শ’ থেকে আটশ কোটি মানুষকে ধারণ করে আছে। সেই বিবেচনায় পৃথিবীর কম্পন হ্রাস ও অন্যান্য ইতিবাচক নাটকীয় পরিবর্তন বিস্ময়কর বলছেন বিজ্ঞানীগণ।


বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ‘করোনাভাইরাসের প্রভাবে পৃথিবীর কম্পন অনেকটাই কমে গেছে’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন অবস্থা চলছে। আর সেই সুবাদে ভারী শিল্প-কারখানার যন্ত্রপাতির চলাচল, ভারী যানবাহন গাড়িবহরের মতো বিশাল এক পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় পৃথিবীপৃষ্ঠ এখন কাঁপছে কম। ভূকম্প বা ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করছেন, মানুষের অবাধ বিচরণ, কোলাহল এবং তাদের ব্যবহৃত সব যান্ত্রিক সরঞ্জামের চলাচল অনেকটাই এখন বন্ধ। এরফলে মানুষেন ঠিকানা পৃথিবী নামক এই গ্রহটির পিঠের উপর সিসমিক আওয়াজ তথা ভূতাত্ত্বিক কম্পনজনিত আওয়াজ এখন অনেকাংশেই কমে গেছে।
হান্নাহ অবসবর্ন-এর লেখা এই বিজ্ঞান-ভিত্তিক নিবন্ধে ‘নিউজউইক’ এসব তথ্য তুলে ধরেছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, বর্তমান সময়গুলোতে বিশ্বজুড়ে যানবাহনের বহর, শিল্প-কল, কারখানাসহ হরেক যন্ত্রপাতির চলাচল বা ব্যবহার বন্ধ থাকার ফলে পৃথিবীতে গত ২০১৯ সালের তুলনায়ও অন্ততপক্ষে ৫০ শতাংশ বিষাক্ত কার্বন গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস পেয়েছে।
আর সেই সঙ্গে বিশাল আকারে বিশ্বে শিল্পখাতের যন্ত্রপাতির ব্যবহার থমকে যাবার ফলে ভূপৃষ্ঠের কম্পন হার অনেকাংশে কমে গেছে। বেলজিয়াম রয়্যাল ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বিজ্ঞানী থমাস লেকখ বলছেন, ‘ভূকম্পন মাত্রা হ্রাসের বিষয়টি আমরা বেলজিয়ামেও লক্ষ্য করছি’।


যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানী স্টিফেন হিকস বলেছেন, ‘গত বেশ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, ভূপৃষ্ঠের কম্পনমাত্রা এখন নিচের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। কেননা সকালবেলা থেকেই মানুষের সেই আগের কোনো কোলাহল ও জনজট আর নেই।
যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তাত্ত্বিক ও পাথুরে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়ান মেইন বললেন, মানুষের যানবাহন ও শিল্প-কারখানার যান্ত্রিক ব্যবহার লকডাউনের কারণে বন্ধ থাকায় পৃথিবীতে আওয়াজ-কম্পন হ্রাস পেয়েছে। এটি সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা।
বিজ্ঞানীদের এ নিয়ে গবেষণা চলছেই। চরমান গবেষণার বরাত দিয়ে বিবিসির অপর এক সংবাদ ভাষ্যে বলা হয়, পৃথিবীর কাঁপুনি যে কমে গেছে তা প্রথম লক্ষ্য করেন বেলজিয়ামের রয়্যাল অবজারভেটরির বিজ্ঞানীগণ। তারা বলছেন- ‘লকডাউনের আগের তুলনায় ১-২০ হার্টস ফ্রিকোয়েন্সিতে (বডসড় একটি অর্গানের আওয়াজের যে ফ্রিকোয়েন্সি) ভূ-পৃষ্ঠের দুলুনি এখন অনেক কম।’
শুধুই বেলজিয়াম নয়। পৃথিবী পৃষ্ঠের এই পরিবর্তন সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভূকম্পন কমার বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ব্যাধিকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণার পর থেকেই মানুষের বেপরোয়া বিচরণ, কোলাহল বেশ থমকে যেতে থাকে।


এমনকি বাংলাদেশের খুব কাছের দেশ হিমালয়কন্যা নেপালের ভূকম্প-বিদরা একই প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন। প্যারিস ইন্সটিটিউট অব আর্থ ফিজিক্সের একজন গবেষক বলেন, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভূকম্পন ‘নাটকীয় মাত্রায়’ কমে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস শহরে কাঁপুনি কমে যাওয়ার মাত্রা দেখে বিস্মিত হয়েছেন ক্যাল টেক ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ।
এখানেই শেষ নয়। মানুষের বেপরোয়া দাপাদাপি অনেকটা বন্ধ কিংবা হ্রাসের সুবাদে এখন আগের চেয়ে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাতাস, বায়ুমণ্ডল। শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে সাগর-মহাসাগর রাজ্য্রে। লকডাউনে যে ভূকম্পন কমেছে তাই নয়, প্রকৃতিও বদলে গেছে।
স্যাটেলাইটের চিত্রে দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণের পেছনে যার বড় দায় বা কারণ সেই নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাস এখন বাতাসে অনেক কম। কারণ বাস-ট্রাক-গাডি-লরি কল-কারখানার ধোঁয়া এখন অনেক কম। জাহাজ চলাচল কমে গেছে অনেকটাই। এরফলে সাগর-মহাসাগরে এখন শব্দ অনেক কম।
সারা পৃথিবীতে শব্দও এখন অনেক কম। যে বিজ্ঞানীগণ শব্দদূষণ মাপেন বা মহাসাগরের শব্দ নিয়ে গবেষণা করেন, তারা একবাক্যে বলছেন পৃথিবীতে আওয়াজ এখন অনেক কম। পরিষ্কার সিগন্যাল।
অবশ্য পৃথিবীর কম্পন মাত্রা কমলেও একদম যে স্থির হঢে গেছে তা বলা যাবে না। তবে গতিবিধির এই পরিবর্তনে কৌতূহলী হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীগণ।


মানুষের নানা গতিবিধির কারণে এত প্রকাণ্ড শব্দ তৈরি হয় যে, পৃথিবী ও প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ তাদের জন্য কষ্টকর। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ৭০ কিলোমিটার পুরু। তারপরও মানুষের গতিবিধি দাপিয়ে বেড়ানোর মতো সব কর্মকাণ্ডে এটি কাঁপে।
ওঢাশিংটন ইনকর্পোরেটেড রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর সিসমোলজির বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি ফ্রাসেটো বলছেন- ‘এখন আপনি এমন সিগন্যাল পাচ্ছেন যাতে কোলাহল অনেক কম। ফলে ঐ সব সিগন্যালের ডেটা বিশ্লেষণ এখন সহজতর হচ্ছে’। কিছু বিজ্ঞানী সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পেয়েছেন যে, কেন একেকটি এলাকায় ভূকম্পন কমেছে।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের স্টিভেন হিক্স বলছেন- ‘লন্ডন এবং ওয়েলসের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মহাসড়ক এম-ফোরের উপর গাড়ি চলাচল কমে গেছে। ফলে ওই মহাসড়কের দুই ধারের এলাকাগুলোতে ভূকম্পন অনেকটাই কমেেেছ।
এখন যেটা হচ্ছে তা হলো সারা পৃথিবীব্যাপী কয়েক সপ্তাহ বা কোথাও কোথাও মাসজুড়ে মানুষের গতিবিধি অনেকটাই কম হওয়ার কারণেই। আর তাতে পৃথিবীর উপর যে চাপ কমেছে তার নজির বিরল।
*লেখক : উপ-সম্পাদক ও ব্যুরো প্রধান দৈনিক ইনকিলাব, চট্টগ্রাম ব্যুরো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন