ডায়াবেটিসে খাদ্য ব্যবস্থাপনার অর্থ কোনভাবেই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বোঝায় না; কিন্তু ভ্রান্তভাবে অনেকে সেরূপ ভেবে থাকেন। বরং খাদ্য ব্যবস্থাপনা সকল ব্যক্তিকে প্রয়োজনমত স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার নিমিত্তে প্রয়োগ করা হয়। সুষম খাদ্য হলো সেটাই যেখানে খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান (শর্করা, আমিষ, চর্বি, আঁশজাতীয় খাদ্য, ভিটামিন, খনিজ লবণ, পানি ইত্যাদি) পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় পরিমাণে এবং অনুপাতে থাকে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হলো-
সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা
নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করা
আদর্শ ওজন অর্জন করা ও ধরে রাখা
রক্তের গ্লুকোজ, চর্বির মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার ভেতর রাখা, রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা
গর্ভাবস্থা ও স্তন্যদানকালীন সময়ে পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করা
বয়স্কদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা
খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান
শর্করা, যেমন- ভাত, রুটি ইত্যাদি
আমিষ, যেমন মাছ, মাংস, ডাল, দুধ ইত্যাদি
চর্বি, যেমন- ঘি, তৈল ইত্যাদি
ভিটামিন
খনিজ লবণ, পানি, আঁশ জাতীয় খাদ্য
শর্করা : শর্করা জাতীয়গুলোকে মূলত: দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- সরল শর্করা - চিনি, গ্লুকোজ, কোমল পানীয়, জেলী, মধু, মিষ্টি, কেক, চকোলেট ইত্যাদি সরল শর্করা এ ধরনের শর্করা খুব তাড়াতাড়ি পরিপাক ও শোষিত হয় বলে রক্তের গ্লুকোজ হঠাৎ করে খুব বেশি বেড়ে যায়; তাই ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এগুলো পরিহার করা ভালো।
জঠিল শর্করা - এ জাতীয় শর্করা ধীরে ধীরে পরিপাক ও শোষিত হয় বলে রক্তের গ্লুকোজ হঠাৎ করে খুব বেশি বাড়ে না; তাই ডায়াবেটিক ব্যক্তির শর্করার উপাদান হিসেবে এগুলো পরিমাণ মতো গ্রহণ করা যেতে পারে। ভাত, রুটি, গম, আলু, ভুট্টা ইত্যাদিতে এ ধরনের শর্করা পাওয়া যায়।
আমিষ : আমিষ জাতীয় খাদ্য শরীর গঠন করার পাশাপাশি রক্তকোষ, হরমোন ইত্যাদি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের অবশ্যই পর্যাপ্ত আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। আমিষ জাতীয় খাদ্যের ভেতর প্রাণীজ আমিষ অধিকতর ভালো আমিষ বলে বিবেচিত যা ডিম, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদি হতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে উদ্ভিজ আমিষ যা আসে ডাল, বাদাম ইত্যাদি।
চর্বি : খাদ্যের সবচেয়ে অধিক ক্যালরি সমৃদ্ধ উপাদান হলো চর্বি। সম্পৃক্ত চর্বি প্রধানত প্রাণীজ খাদ্যোপাদান থেকে আসে আর অন্যদিকে অসম্পৃক্ত চর্বি পাওয়া যায় উদ্ভিজ উপাদান থেকে। সম্পৃক্ত চর্বিজাতীয় খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ করলে রক্তের চর্বির মাত্রায় মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং হার্ট এটাক ও স্ট্রোক এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ধরণের চর্বি জাতীয় খাদ্য এবং এদের উৎস নিম্নরূপ-
সম্পৃক্ত চর্বি - নারকেল তেল, ঘি, মাখন, মার্জারিন, পামতেল ইত্যাদি
গটঋঅ - জলপাই তেল, সরিষার তেল, ক্যানোলা তেল, বাদামের তেল ইত্যাদি
চটঋঅ - সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল, মাছের তেল, ক্যানোলা তেল ইত্যাদি
ট্রান্স ফ্যাট - মার্জারীন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ডোনাট, কেক, পেস্ট্রি, বি¯ু‹ট, পিজপ ইত্যাদি
কোলেস্টেরল - মাখন, ঘি, ডিমের কুসুম ইত্যাদি
ভিটামিন : ভিটামিন হলো এক ধরনের জৈব পদার্থ যা খাদ্যে খুব অল্প পরিমাণে থাকে। ভিটামিন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় এবং সুষম খাদ্য তালিকায় অবশ্যই সব ধরনের ভিটামিন থাকা জরুরি।
খনিজ লবণ : খনিজ লবণ শরীরের বিভিন্ন অংগ যেমন হাড়, দাঁত, মাংসপেশী, স্নায়ু কোষ এবং রক্তে থাকে। এরা শরীর সুগঠিত করতে ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে জরুরি।
আঁশ জাতীয় খাদ্য : খাদ্যে আঁশের প্রধান উৎস হলো গম, ফল, সব্জি, আলু। আঁশ জাতীয় খাবারের উপকারিতা হলো-
গ্লুকোজের শোষণ মন্থর করা
খাদ্যের চর্বির শোষণ কমিয়ে দেয়া
অন্ত্রে পানি ধরে রেখে পায়খানা নরম রাখা
দেহের ওজন নিয়ন্ত্রিত রাখা
হার্ট এটাক ও কোন কোন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো ইত্যাদি
ডায়াবেটিক ব্যক্তির খাদ্য ব্যবস্থা : ডায়াবেটিস ব্যক্তির খাদ্যব্যবস্থা কতগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। যেমন:
বয়স, লিঙ্গ
ডায়াবেটিসের ধরন
ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের ধরন
অন্য কোন শারীরিক অসুস্থতা বা জটিলতা আছে কিনা
গর্ভাবস্থা, স্তন্যদানকারী অবস্থা ইত্যাদি
খাদ্য থেকে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় তার একককে ক্যালরি বলা হয়। যেমন- শর্করা ও আমিষ জাতীয় খাদ্যের প্রতি গ্রাম থেকে ৪ কিলোক্যালরি এবং চর্বি জাতীয় খাদ্যের প্রতি গ্রাম থেকে ৯ কিলোক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়।
ডায়াবেটিক ব্যক্তির খাদ্যের বিভাজন : প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় মোট ক্যালরি একজন ডায়াবেটিক ব্যক্তি গ্রহণ করবে ৩টা মূল খাবার (সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার) এবং ২-৩ টা টিফিন (মধ্যসকাল, বিকেল, শোবার আগে) হিসেবে।
সেক্ষেত্রে
সকালের নাস্তায় খাবে মোট ক্যালরির ২০%
দুপুরের খাবারে খাবে মোট ক্যালরির ৩৫%
রাতের খাবারে খাবে মোট ক্যালরির ৩০%
বাকি ১৫% ক্যালরি ২-৩টা টিফিনে বিভক্ত করে নেবে। একজন ডায়াবেটিক রোগীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকা জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে যে একই বিষয় কখনই সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োজনীয় নয়। তাই খাদ্য ব্যবস্থা নির্ধারণের আগে সে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন সেগুলো হলো:
ডায়াবেটিক ব্যক্তির ডায়াবেটিসের ধরন
বর্তমান শারীরিক, মানসিক ও খাদ্য ব্যবস্থা
জীবন যাত্রার ধরন
ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও পছন্দ
খাদ্য ব্যবস্থা বিষয়ক জ্ঞাতব্য উপাদানগুলো-
(ক) সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা, (খ) খাদ্য পিরামিডের ধারণা, (গ) স্বাস্থ্যকর খাদ্য বাছাই- সিগন্যাল পদ্ধতি, (ঘ) থালা মডেল, (ঙ) তরসনধনবি ঐধহফ ঔরাব, (চ) খাদ্য পরিবর্তন ব্যবস্থা, (ছ) শর্করা গণনা, (জ) গাইসেমিক সূচক পদ্ধতি ইত্যাদি
সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা
ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের অবশ্যই স্বাস্থ্যকর খাদ্যভ্যাসের মূলনীতিগুলো মেনে চলা উচিত। যেমন : বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ করা
রুটি, শস্যদানা থেকে তৈরি খাবর, ফল, শক-সব্জির উপর গুরুত্ব দেয়া
কম চর্বিযুক্ত খাবার বা কম তেলে তৈরি খাবার পছন্দ করা
আদর্শ ওজন নিশ্চিত করা ও ধরে রাখা - সুষম খাদ্যভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে
লবণ, ক্যাফেইন ও এলকোহলের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত করা, খাবার সময় ধীরে ধীরে খাওয়া যা অধিক খাদ্যগ্রহণ থেকে রক্ষা করবে, প্রচুর পানি পান করা
সর্বদা বাড়ির বিভিন্ন কাজে, খেলাধুলায় সক্রিয় থাকা, খাবারে ম্যায়োনেজ, মাখন, ঘি ইত্যাদি পরিহার করা, খাবার পরিবেশনের সময় আইসক্রীম, কেক ইত্যাদির পরিবর্তে টাটকা ফল পরিবেশন করা
ষ ডা. শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা
ফোন : ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭
ঊসধরষ : ংবষরসংযধযলধফধ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন