বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

করোনায় বাংলাদেশও আক্রান্ত। সারাদেশে চলছে লকডাউন। প্রায় সব কাজ বন্ধ। এতে চরম দুর্দিনে পড়েছে কর্মজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষ। সকলের উপার্জন বন্ধ। একই অবস্থা কম-বেশি বিশ্বব্যাপীই। বৈশ্বিক মহামন্দা কার্যত শুরু হয়েছে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি মাইনাসে যাবে বলে আইএমএফ জানিয়েছে। বাংলাদেশেও মন্দার ভাব দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে অনেক। পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র যৌথ গবেষণাপত্রেও বলা হয়েছে, করোনার কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষ। সারাদেশেই বাড়তে থাকবে দারিদ্র্যের প্রবণতা। ইতোমধ্যে রফতানি, আমদানি, শিল্পোৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, পর্যটন, রেমিটেন্স, রাজস্বসহ সব খাতই চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষির অবস্থা কিছুটা ভালো আছে। পোলট্রিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। সার্বিকভাবে হিসাব করে চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২-৩% হবে এবং আগামী বছর আরও কমবে বলে বিশ্বব্যাংক গত ১২ এপ্রিল জানিয়েছে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের এই পূর্বাভাসকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রকৃত পক্ষে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ। এ থেকে উদ্ধার হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত গার্মেন্ট ও প্রবাসী আয়। এই দু’টিই সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ, আমাদের গার্মেন্ট রফতানি মূলত: পশ্চিমাদেশ ভিত্তিক। করোনার আঘাতে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। সহজে সোজা হতে পারবে না। ফলে আমাদের গার্মেন্টের উন্নতি চরমভাবে ব্যাহত হবে। এর মধ্যেই বিপুল অংকের অর্ডার বাতিল/স্থগিত হয়েছে। তাতে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে ২২ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। আরও হবে। কারণ, শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত আছে। রেমিটেন্সেও ভাটা পড়েছে। প্রবাসীদের বেশিরভাগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। যারা জ্বালানি তেল রফতানি নির্ভর দেশ। কিন্তু সে দেশগুলোতে করোনা সৃষ্ট সংকট ছাড়াও তেলের মূল্য দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন হওয়ায় মন্দা শুরু হয়েছে। আইআইএফ বলেছে, তেলের দাম কমায় এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সৌদি আরবে ০.৭%, কুয়েতে ০.৮% এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ০.৬%। এছাড়া ইরানের অর্থনীতি যেখানে ৫.১% প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, তা উল্টো সংকুচিত হবে ৮.৪%। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের চাহিদা কমে গেছে। অবশ্য গত ১২ এপ্রিল ওপেক প্লাসের তেলমন্ত্রীরা দৈনিক ৯৭ লাখ ব্যারেল তেল কম উৎপাদন করতে সম্মত হয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত টিকে থাকবে কি-না, টিকে থাকলেও তেলের মূল্য বাড়বে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, সারাবিশ্বে চলছে মহামন্দা। তাই তেলের চাহিদা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। অন্য যেসব দেশে আমাদের প্রবাসীরা আছে, সেখানেও প্রায় একই অবস্থা চলছে। তাই প্রায় ৭ লাখ প্রবাসী ফেরত এসেছে। তার মধ্যে ৫ লাখ শ্রমিক। আরও অনেক ফেরত আসবে। তাই রেমিটেন্স সহজে বাড়বে না। দেশের প্রায় সবকিছুতেই নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে বের হয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরতে হবে। নতুবা মানুষকে বাঁচানো যাবে না। উন্নতিও পূর্বাবস্থায় ফিরবে না। তাই মানুষ ও অর্থনীতিকে একসাথে বাঁচাতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন কর্মযজ্ঞ শুরু করা এবং তা হতে হবে দেশীয় সম্পদভিত্তিক।
দেশীয় সম্পদভিত্তিক উন্নতির প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। আমাদের দেশটিও মূলত: কৃষিনির্ভর। দেশের প্রায় ৬০-৭০% মানুষ এখনো কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। জিডিপিতে কৃষির অবদান বর্তমানে ১৩.৩১%। সেই কৃষিকে অবহেলায় রেখে শিল্পায়নের দিকে আমরা অধিক ঝুঁকে পড়েছিলাম। কিন্তু শিল্পায়ন তেমন হয়নি। যেটুকু হয়েছিল, তারও বেশিরভাগ মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্বায়ন মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে। মাঝখানে শিল্পায়নের নামে কয়েক লাখ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে, যার বেশিরভাগ আদায় হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, আমদানি-রফতানির নামে প্রায় দশ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা আর ফেরত আসবে বলে মনে হয় না। অবশ্য কৃষির প্রতি অবহেলার পরও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর হাইব্রিডের কারণে দেশের কৃষির অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। কিছু রফতানিও হচ্ছে। তবে মসল্লা জাতীয় পণ্যের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য মতে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১১তম। ফসলভিত্তিক উৎপাদনের দিকে দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান: চাল- চতুর্থ, ফল-২৮তম, আম-সপ্তম, চা-দশম, মাছ-অষ্টম (খোলা পানিতে তৃতীয় ও ইলিশে শীর্ষ)। এছাড়া, দেশে বর্তমানে দিনে ১২০-১৪০ লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদিত হচ্ছে। আলুর উৎপাদন কোটি টনের অধিক, যা চাহিদার চেয়ে বেশি। উল্লেখ্য যে, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মানুষের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। হু ২০১৯ সালে বলেছে, খাদ্যশক্তি গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ গত ২০ বছরে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ২,২৮৫ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ করত। আর এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৫১৪। ডিম খাওয়া আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছেছে বলে ফাও জানিয়েছে।
এই অবস্থায় দেশের টেকসই উন্নতির জন্য এবং প্রান্তিক লোকের কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উন্নতি আবশ্যক। স্মরণীয় যে, করোনার কারণে উৎপাদন ব্যাহত ও সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বৈশ্বিক খাদ্য সংকট আসন্ন বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। এফএও বলেছে, বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে এবং তাতে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে প্রান্তিক মানুষ। ইতোমধ্যেই ভারতে তা শুরু হয়েছে। আগ্রায় রাস্তায় পড়ে থাকা দুধ কামড়াকামড়ি করে খাচ্ছে মানুষ ও কুকুর এমন সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়েছে। বাংলাদেশেও ত্রাণ লুট করছে, ত্রাণের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করছে অভাবী লোকরা। যা’হোক, বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের কারণে খাদ্যের মূল্য আকাশচুম্বী হবে বলে অনুমেয়। কিন্তু সেই মূল্য দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করার সামর্থ্য নেই আমাদের। তাই দেশের চাহিদা মোতাবেক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। কৃষক যদি ফসলের ন্যায্যমূল্য না পায়, তাহলে ফসল উৎপাদনে নিরুৎসাহ হয়। কৃষকের আর্থিক অবস্থাও খারাপ হয়। এতদিনে এসব হয়েছেও। তাই বহু কৃষক পেশা পরিবর্তন করেছে। তাই ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ধান-চালের। তাহলে কৃষকের উন্নতি হবে। তারা চাষে উৎসাহী হবে। সরকার ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অনেকদিন থেকে ধান কাটা মওসুমে ধান-চাল ক্রয় করছে। কিন্তু তাতে কৃষকের তেমন লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে ফড়িয়াদের। তাই সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান-চাল ক্রয় করতে হবে এবং তা ধান কাটা মওসুম শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যেই। কারণ, এবার আমন মওসুমে ৬-৭ মে. টন ধান-চাল ক্রয় করা হয়েছে ৪-৫ মাসে। এই সামান্য ধান-চাল ক্রয় করতে এতদিন লাগে? দ্বিতীয়ত: এতদিন বেশিরভাগ কৃষকের ঘরে ধান থাকে না। ধান কাটার সাথে সাথে তারা ধান বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করে ও সংসারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে। তাই ধান কাটা শুরুর এক মাসের মধ্যে চাহিদা মাফিক ধান-চাল ক্রয় করতে হবে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে। অন্যদিকে, কৃষির উন্নতি জন্য স্বল্প সুদে প্রয়োজনীয় কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে স্বল্প মূল্যে কৃষি উপকরণ প্রদান করতে হবে। কৃষিকেও যান্ত্রিকরণ করতে হবে। এসব করা হলে কৃষি উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। অন্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে। কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার যত বাড়বে, তত এর মেকানিকের দরকার হবে। কারণ, মেশিনারির কোনো গ্যারান্টি নেই। এই ভালো তো এই নষ্ট। তাই এটা মেরামত করতে হয়। তদ্রুপ অবস্থা কৃষিযন্ত্রেরও। তাই কৃষি যন্ত্র মেরামত করার জন্য কয়েক লাখ দক্ষ মেকানিক গড়ে তোলা দরকার। সরকার এ সবরের প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে। তাই প্রধানমন্ত্রী কৃষি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন গত ১২ এপ্রিল। তিনি বলেছেন, ‘কৃষি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল তৈরি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের সর্বোচ্চ ৫% সুদে ঋণ দেওয়া হবে। কৃষি, ফুল, ফল, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতে যারা নিয়োজিত, তারা সবাই এই প্রণোদনার আওতায় আসবেন।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ধান কাটা ও মাড়াই কাজে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে কৃষি মন্ত্রণালয়কে এরই মধ্যে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বীজ-চারা বিতরণের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। সারের ভর্তুকিতে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে আগামী অর্থবছরে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ধান উঠবে। কৃষক যেন এ ফসলের ন্যায্য দাম পায় সেদিকে লক্ষ রেখে গত বছরের তুলনায় আরও ২ লাখ মেট্রিক টন বেশি চাল ক্রয় করা হবে।’ তিনি পরের দিন বলেন, ‘এই দুঃসময়ে আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু সচল রাখা নয়, আরও জোরদার করতে হবে। সামনের দিনগুলিতে যাতে কোনপ্রকার খাদ্য সঙ্কট না হয়, সেজন্য আমাদের একখন্ড জমিও ফেলে রাখা চলবে না।’ কৃষকদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা কৃষক ও কৃষির উন্নতির জন্য কিছুটা হলেও কল্যাণকর। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কৃষির মতো বিরাট খাতে ঘোষিত প্রণোদনা কম হয়েছে। এটা তিনগুণ বেশি করা দরকার। উপরন্তু এটা সুদমুক্ত করা প্রয়োজন। যা’হোক, ঘোষিত প্রণোদনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন তথা যেন প্রকৃত কৃষকরা পায় সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। উল্লেখ যে, পরের দিন ঘোষিত কৃষি প্রণোদনার সুদ হার ১% কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অপরদিকে, দেশে প্রায় সব ফসলের ব্যাপক অপচয় ছাড়াও পচে যায় সংরক্ষণের অভাবে। যেমন: বিভিন্নভাবে ফল নষ্ট হয় ২৫%। তাই সব কৃষি পণ্যের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার দরকার। তেমনি দরকার সব ধরনের ফলের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র। অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা দরকার। কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারও বাড়াতে হবে। উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করতে পারলে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অভিমত। মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট-২০১৯ মতে, বর্তমানে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন হচ্ছে: বোরো ধান- ৫.৮৫ টন, যা ১১.৭ টনে উন্নীত করা, আমন ধান ৩.৪ টন, যা ৬.৫ টনে উন্নীত করা এবং আউশ ২.৯ টন, যা ৭.৮ টনে উন্নীত করা সম্ভব। একইভাবে ফলন বাড়ানো সম্ভব গম ও ভুট্টারও। তাই এদিকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের পাট একদা সোনালি আঁশ বলে খ্যাত ছিল। কালক্রমে পাটের বিকল্প সিনথেটিক আবিষ্কার ও ব্যবহার হওয়ায় সেই পাট কৃষকের গলার ফাঁসে পরিণত হয়। উপরন্তু পাট সংশ্লিষ্ট কল-কারখানাও বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা বেকার হয়েছে। সাম্প্রতিককালে পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের কারণে সিনথেটিকের ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে আর পাট পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। কারণ, সিনথেটিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। কিন্তু পাটের এই সুদিনকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এমনকি, দেশের প্রখ্যাত এক বিজ্ঞানী পাট থেকে পলিব্যাগ তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন (দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীনও আবিষ্কার করেছেন), যা তৈরি করা হচ্ছে ঢাকার একটি সরকারি জুটমিলে প্রায় ২-৩ বছর যাবত। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোনালী ব্যাগ’। কিন্তু এতদিনেও দেশের আর কোন জুট মিলে এটা চালু করা হয়নি। হলে পাটের চাহিদা ব্যাপক বাড়তো, পাট চাষিদের উন্নতি হতো, জুট মিলগুলো চালু হতো, বহু শ্রমিকের কাজ জুটতো, পরিবেশের উন্নতি হতো। দেশের সব জুট মিলে সোনালী ব্যাগ উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। একই অবস্থা চামড়া শিল্পেও। পরিবেশ রক্ষার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা থেকে সাভারে আধুনিক শিল্প নগরী গড়া হয়েছে। কিন্তু যে লাউ সেই কদুই রয়েছে। কারণ, কয়েক বছরে মাত্র কয়েকটি কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তাও পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই। বাকী কারখানা কবে প্রতিষ্ঠা হবে তা অনিশ্চিত। তাই মূল্যবান চামড়া এখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। গত কুরবানির সময় মানুষ চামড়া মাটিতে পুতে ফেলেছে দাম না পেয়ে। এ শিল্পের কর্মীরাও বেকার হয়েছে। বিদেশি সিনথেটিকের জুতা-ব্যাগ দেশের বাজার সয়লাব হয়েছে!
দেশের কর্মযজ্ঞের দ্বিতীয় খাত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সিএমএসএমই’র অবদান মোট জিডিপির ২৫%, মোট কর্মসংস্থানের ৪০% ও মোট শিল্প কর্মসংস্থানের ৮০%। দেশে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে ৫০ হাজার ক্ষুদ্র ও ১০ হাজার এসএমই কারখানা আছে। এসবে ৩৮০০ যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হয়, যার মূল্য ৯ হাজার কোটি টাকা (দেশের চাহিদা ২৬ হাজার কোটি টাকা), এসবে কারখানায় সরাসরি ৮ লাখ লোক কর্মরত। জিডিপিতে এর অবদান ২৩%। ১৭টি দেশে ১৩৭টি আইটেম রফতানি হয়। প্রধানমন্ত্রী রফতানি স¤প্রসারণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার জন্য লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যকে ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২০ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। যা’হোক, বর্তমানে দেশে হালকা প্রকৌশল খাতের পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। আর বাংলাদেশে এর চাহিদা ৩.১২ বিলিয়ন ডলারের, বাংলাদেশি টাকায় যা ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে দেশে তৈরি হয় মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকার। বাকি প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করতে হয় নিয়মিত। এছাড়া, দেশে বর্তমানে মোট তাত আছে ১২ লাখ। এখানে কর্মরত লোকের সংখ্যা ৩০ লাখ, যার বেশিরভাগ বন্ধ আছে। অবশ্য সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন ৫% সুদে। এটা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে কিছু কল্যাণ হবে। স্মরণীয় যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পণ্য উৎপাদিত হয় দেশজ কাঁচামাল দিয়ে। পুঁজিও লাগে সামান্য। অপরদিকে, বৃহৎ শিল্পের, এমনকি গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদন হয় বিদেশি কাঁচামাল দিয়ে (প্রায় ৭০%)। পুঁজিও লাগে ব্যাপক। কিন্তু বৈশ্বিক মহামন্দার কারণে বিদেশি বড় বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন। আংটাড বলেছে, করোনায় বিশ্বে বিনিয়োগ কমবে ৪০%, যার রেশ পড়বে এ দেশেও। এমনকি গত ২৯-৩০ জানুয়ারি ঢাকায় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার নীতিনির্ধারকদের বৈঠকে ৪২৫ কোটি ডলার সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, তার সব অর্থ পাওয়া যাবে কি-না সংশয় রয়েছে বৈশ্বিক মহামন্দার কারণে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে দেশে কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। স্মরণীয় যে, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সব অর্থ অবিলম্বে প্রদান করা আবশ্যক। কারণ, এটা হলে লকডাউন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে। দেশের কল্যাণ হবে। পাশাপাশি প্রণোদনার অর্থ যেন সঠিকভাবে বিতরণ ও ব্যবহার হয়, সে জন্য কড়া মনিটরিং দরকার। নতুবা প্রণোদনার লক্ষ্য ব্যর্থ হবে, যা কাম্য নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন