বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যাকাত দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় নিম্ন আয়ের এবং দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ এখন খুবই কষ্টে আছে। তিন বেলা ডাল-ভাত যোগাড় করতে তারা এখন হিমশিম খাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষদের জীবনে এখন কেবল হাহাকার। এ অবস্থায় সামর্থ্যবান প্রত্যেক মানুষের উচিত বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সবার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে যাকাত হতে পারে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার যোগানোর উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। একই সাথে এই সময়টা হতে পারে আপনার যাকাত প্রদানের উৎকৃষ্ট সময়। সুতরাং আসুন আমাদের মধ্যে যাদের ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তারা সবাই যাকাতের অর্থটা এই সময়ে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করি। তাতে যাকাতও আদায় হবে আবার মানবতারও কল্যাণ হবে। আর এটাই কিন্তু ইসলামের শিক্ষা।
ইসলামে নামাজ-রোজার মতই যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। যাকাত হচ্ছে অর্থের ইবাদত। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের ওপর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। আর আর্থিক সচ্ছলতার মাপকাটি ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়ের ফর্মুলাও ইসলাম বলে দিয়েছে। আর যাকাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে, সেটাও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলামি পরিভাষায় যাকাত হচ্ছে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ কোনো অসহায়কে মুসলমানকে দুনিয়াবী স্বার্থ ছাড়া প্রদান করা। যাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠির সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মূল হাতিয়ার। যাকাত হচ্ছে একটি মানবিক সমাজ গঠনের হাতিয়ার এবং মানবকল্যাণই যাকাতের মূলমন্ত্র। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে, আর সেই যাকাতের অর্থ দিয়ে বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধান হয়। যাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার, যা আদায় করতে ধনী ব্যক্তি বাধ্য। মহান আল্লাহ কোরআন শরিফে সালাত আদায়ের সাথে সাথে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআন শরীফে তিনি মোট ৩২ বার যাকাত আদায়ের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ এককভাবে ৭ বার আর সালাতের সাথে ২৫ বার যাকাত আদায়ের কথা বলেছেন। প্রকৃত পক্ষে যাকাত হচ্ছে মুসলমানদের জন্য একটি ফরজ ইবাদত।
ঈমান আনার পর ইসলামের বিধানসমূহকে পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং পালন করতে হবে। আপনি কিছু বিধান পালন করলেন আর কিছু বিধান পালন করলেন না- এ রকম সুযোগ ইসলামে নেই। স্বাভাবিকভাবেই নামাজ আদায়ের মতো যাকাতও আদায় করতে হবে। যাকাত আদায়ের পর সেই অর্থ যাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য নির্ধারিত খাতসমূহে ব্যয় করতে হবে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত যাকাত আদায় সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে এখানে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করা হচ্ছে। তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রকুকারীদের সাথে রুকু কর (বাকারা: ৪৩)। তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ (মুজাম্মিল: ২০)। তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর (মুজাদালাহ: ১৩)। যারা যাকাত দেয় না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, যারা যাকাত দেয় না, তারাই আখিরাতের অস্বীকারকারী কাফির (হা-মীম সাজদা: ৭)। কোরআন শরীফে আল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত এই কয়েকটি আয়াত থেকে আমরা সহজেই যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। মনে রাখতে হবে, যাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিধান। আর এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের অধিকার। এটা বঞ্চিতদের প্রতি ধনীদের কোনো করুণা বা অনুগ্রহ নয়। আবার এটা দানও নয়। এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবদের এমনই একটা অধিকার, যেটা প্রতি বছর ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের প্রদান করতে বাধ্য এবং সেটা গরিবদের ঘরে পৌঁছে দেয়াটা ধনীদের দায়িত্ব। এভাবে যাকাত প্রদানকে আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন, যাতে একদিকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করবে, অপরদিকে যাকাতের অর্থ দিয়ে অটোমেটিক্যালি সমাজ থেকে দারিদ্র্য এবং সমস্যা দূর হবে। এভাবে যাকাত সিস্টেমের মাধ্যমে ইসলাম সার্বজনিন এবং কল্যাণমুখী অর্থনীতি চালু করেছে, যার মাধ্যমেই কেবল একটি আলোকিত এবং মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।
অনেকে মনে করে, যাকাতের টাকা প্রদান করলে সম্পদ কমে যাবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্রটা ঠিক উল্টো। এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন, যাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন, তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাবার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাই বৃদ্ধি পায় এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত হয় (রূম: ৩৯)। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন একজন মানুষ সুদ খায় সম্পদ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে সুদের কারণে যে সুদ খায় তার সম্পদ বাড়ে না। কারণ সুদি সিস্টেমে গরিবের টাকা ধনীদের হাতে চলে আসে। ফলে যারা সুদ প্রদান করে তাদের হাতে টাকা থাকে না, ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা থাকে না। এ অবস্থায় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয় এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ে। অপরদিকে যাকাত আদায়ের ফলে ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের হাতে যায়। ফলে গরিবদের হাতে টাকা থাকে এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হয়, সমাজে দরিদ্রের সংখ্যা কমে এবং ধনী-গরিবের বৈষম্যও কমে। সমাজে সাম্য সৃষ্টি হয়। এভাবে যাকাত ব্যবস্থার কল্যাণে সমাজ উন্নত হয়। অপরদিকে সুদ গ্রহণের ফলে মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করে আর যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জন করে। এভাবে সুদের কারণে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল- উভয় অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল- উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা র্অজন করে। যাকাতের অর্থ প্রদানের পর সেই অর্থ আবার যেন তেন খাতে ব্যয় করা যাবে না। কারণ যাকাত প্রদানের আটটি খাত আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই সদাকা হচ্ছে (যাকাত পাবে আট প্রকার লোক) ১. ফকীর, ২. মিসকিন, ৩. ঐসব লোক যারা সদাকা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত, ৪. ঐ সমস্ত কাফির, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, ৫. দাস আযাদ করা, ৬ ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা, ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী এবং ৮. মুসাফিরদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্ধারিত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, তিনি প্রজ্ঞাময় (তওবাহ: ৬০)। সুতরাং যাকাতের আদায়কৃত অর্থ সঠিক খাতেই ব্যয় করতে হবে।
আসুন, আমরা সবাই যাকাত প্রদান করি। যাদের ওপর যাকাত ফরজ হয়নি তারাও যে কোনো পরিমাণ অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্ত মানুষকে সহযোগিতা করি।
লেখক: প্রকৌশলী ও আহবায়ক, যাকাত ফর হিউমিনিটি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন