বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস

প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাও: এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব

॥ তিন ॥
ওসমান (সা.) কুরআন মাজীদকে এক ক্বিরাতে (তেলাওয়াত পদ্ধতিতে) একত্রিতকরণ এবং সূরাসমূহের বিন্ন্যাস
ওসমান (স.)-এর শাসনামলে (২৫- ৩৫ হিঃ) জিহাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে গমনকারী সাহাবাগণ বিজিত অঞ্চলসমূহে নিজ নিজ শিক্ষা অনুযায়ী কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করত। যতদিন পর্যন্ত মানুষ ৭ ক্বিরাত তেলাওয়াত পদ্ধতি) সম্পর্কে অবগত ছিল ততদিন কোনো প্রকার প্রশ্ন দেখা দেয়নি, কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ইসলাম দূর দূরান্তের অঞ্চলসমূহে পৌঁছার পর ক্বিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতি) সম্পর্কে মানুষের ধারণা কমতে লাগল। ফলে ভিন্নজন ভিন্ন পদ্ধতিতে তেলাওয়াত করার কারণে মানুষের মাঝে একজন আরেকজনের তেলাওয়াতকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করতে লাগল। হুযাইফা ইবনে ইয়ামেন (রা.) আরমেনিয়া এবং আজারবাইজানের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ওসমান (রা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আমীরুল মুমেনীন! এ উম্মত আল্লাহর কিতাব নিয়ে মতভেদে লিপ্ত হওয়ার আগে তার একটা সুরাহা করুন। ওসমান (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? হুযাইফা (রা.) বলল, যুদ্ধ চলাকালে দেখলাম সিরিয়ার লোকেরা উবাই বিন কা’ব (রা.)-এর তেলাওয়াত পদ্ধতিতে কুরআন তেলাওয়াত করছে, যা ইরাকবাসী কোনো দিন শোনে নাই। আর ইরাকবাসী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর নিকট এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে এসেছিল। তাই তিনি সম্মানিত সাহাবাগণকে একত্রিত করে বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করলেন যে, এ বিষয়ে আপনাদের কি পরামর্শ? সাহাবাগণ ওসমান (রা.)কে জিজ্ঞেস করল, আপনি এ ব্যাপারে কী চিন্তা করেন? ওসমান (রা.)বললেন, আমার পরামর্শ হলো সমস্ত মুসলমানকে এ ক্বিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতির) ওপর একমত করে দিই, যাতে কোনে মতভেদ না থাকে। সাহাবাগণ ওসমান (রা.) এ পরামর্শকে পছন্দ করল এবং এটাকে তারা সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করল। এ সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর কাজ করার জন্য ওসমান (রা.) চারজন সাহাবার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলেন। এ কমিটির মধ্যে ছিল যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) সা’ঈদ ইবনে আস (রা.) আবদুর রহমান ইবনে হারেস (রা.)। এ কমিটিকে সহযোগিতা করার জন্য পরে আরো অন্যান্য সাহাবীগণ তাদের সাথে শামিল হয়েছিলেন। এ কমিটিকে এ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল যে, তারা আবু বকর এবং ওমর (রা.) এদের একত্রিকৃত কপি থেকে এমন একটি কপি প্রস্তুত করবে যা শুধু একটি ক্বিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতিতে) হবে। আর তা কুরাইশের শব্দ বা আয়াতের অনুযায়ী লিখতে হবে। কেননা, কুরআন কারীম তাদের ভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। সাহাবাগণের এ কমিটি “উম্ম” কে সামনে রেখে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিয়েছিল তা ছিল নি¤œরূপ ঃ
১. রাসূল (স.)-এর সময়ে সাহাবাগণের নিকট যতগুলো সহীফা ছিল তা আবার তলব করা হলো এবং এগুলোকে নতুন করে “উম্ম”-এর সাথে মেলানো হলো, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি আয়াত নতুন মাসহাফে (কুরআনে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যতক্ষণ না সাহাবাগণের ভিন্ন ভিন্ন সহিফার সাথে মেলানো হয়েছে।
২. আয়াতসমূহকে যের, যবর ও পেশহীনভাবে এভাবে লিখা হল যেন সমস্ত ক্বিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতি) এক হয়ে যায়) যেমন ঃ
অর্থ ঃ কিয়ামতের দিনের মালিক। অর্থ ঃ কিয়ামতের দিনের বাদশাহ।
এ দুটি পদ্ধতিকে নতুন মাসহাফে (কুরআনে) এভাবে লিখা হলো- এতে উভয় কিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতি) লিখার মধ্যে এসে গেছে। কিন্তু এর অর্থের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি।
৩. “উম্ম”-এর মধ্যে সমস্ত সূরাসমূহ পৃথক পৃথক সহিফায় (পুস্তকে) অগোছালোভাবে বিদ্যমান ছিল, এ কমিটি চিন্তাভাবনা করে সমস্ত সূরাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে একত্রিত করে দিল।
৪. ওসমান (রা.) সকলের ঐকমত্যে প্রস্তÍতকৃত কুরআনের এ কপি বিভিন্ন স্থানে পাঠালেন, তার মধ্যে একটি কপি মক্কায়, একটি সিরিয়ায়, একটি ইয়ামেন, একটি বসরায়, একটি কূফায় পাঠালেন আর একটি কপি মদিনায় সংরক্ষণ করলেন।
৫. কুরআন মাজীদের এ কপি বিভিন্ন ইসলামী কেন্দ্রগুলোতে পাঠানোর সাথে সাথে ওসমান (রা.) একজন বিশেষজ্ঞ এবং ক্বারীও ঐ সমস্ত ইসলামী কেন্দ্রগুলোতে পাঠিয়েছেন। যারা লোকদেরকে সকলের ঐকমত্যে প্রস্তÍতকৃত করআনের তেলাওয়াতের পদ্ধতি মোতাবেক যথাযথভাবে লোকদেরকে কুরআন শিক্ষা দিত। তাদের মধ্যে যায়েদ (রা.) ছিলেন মদিনায়, আর আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) ছিলেন মক্কায়।
এ সমস্ত কর্মগুলো শেষ করার পর ওসমান (রা.) সাহাবাগণের নিকট বিদ্যমান ভিন্ন ভিন্ন তেলাওয়াত পদ্ধতি সম্বলিত কপিগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। আর “উম্ম” হাফসা (রা.)-এর নিকট ফেরত দিলেন, যা হাফসা (রা.) মৃত্যুর পর মারওরান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।
এ সাত ক্বিরাতকে (তেলাওয়াত পদ্ধতিকে) একটি পদ্ধতি একটি মাসহাফে (কুরআনে) সমবেত করার মধ্যে ওসমান (রা.) কুরআন মাজীদের ঐ বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিলেন যার ফলে আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা ঐ পদ্ধতিতেই কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করছে। যে তেলাওয়াত পদ্ধতিতে এ কুরআন মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। সাহাবাদের এ কষ্টের পর আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে কুরআন মাজীদের এক একটি অক্ষর, একটি শব্দ, এক একটি আয়াত কীভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত করে রেখেছেন তার কিছু উদাহরণ নিচে পেশ করা হলো-
কুরআন মাজীদে ইবরাহীম শব্দটি ৬৯ বার এসেছে এর মধ্যে সূরা বাকারার সর্বত্র এ শব্দটি “ইয়া” ব্যতীত লিখা হয়েছে। আবার অন্যান্য সূরাসমূহে ইবরাহীম শব্দটি “ইয়া” অক্ষরসহ লিখা হয়েছে। কুরআন মাজীদ লিখার ক্ষেত্রে এ পার্থক্য কুরআন মাজীদের প্রতিটি কপিতে ১৪ শত বছর থেকে চলে আসছে যা আজ পর্যন্ত কোনো মুসলমান বা অমুসলিম প্রকাশক তা পরিবর্তন করতে পারেনি, না কিয়ামত পর্যন্ত তা করতে পারবে।
সামূদ শব্দটি কুরআন মাজীদে দুইভাবে লিখা হয়েছে, যেমন- প্রথম আরবী “দালঃ” অক্ষরটিতে যবর দিয়ে সূরা হুদ ৬১ নং আয়াত আবার কুরআন মাজীদের চারস্থানে এই শব্দটি আলিফ যোগে এভাবে লিখা হয়েছে। সূরা হুদ ৬৮ নং আয়াত-
১৪শ বছর থেকে কুরআন মাজীদের চারটি স্থানে সামূদ শব্দটি আলিফ যোগে লিখিত আছে, যেমন নবী (স.)-এর যুগে লেখা হয়েছিল, আজও পৃথিবীর সমস্ত মাসহাফে (কুরআনে) এভাবেই লিখিত আছে। কোনো প্রকাশকই সামূদ শব্দে অতিরিক্ত আলিফ অক্ষরটি উঠিয়ে দিতে পারেনি এবং কিয়ামত পর্যন্ত পারবেও না।
৩. “কাওয়ারীর” শব্দটিও কুরআনে দু’ভাবে লিখিত হয়েছে-
একস্থানে আরবী “রা” অক্ষরটির ওপর যবর দিয়ে যেমন - সূরা নামলের ৪৪ নং আয়াতে, আবার অন্য এক স্থানে সূরা সূরা ইনসানের ১৫ নং আয়াতে “রা” অক্ষরের পরে আলিফ যোগে লিখা হয়েছে। কিন্তু নবী (স.)-এর যুগে যেখানে “কাওয়ারিরা” শব্দটি “আলিফ” অক্ষর ব্যতীত লিখা হয়েছিল, আজও প্রতিটি মাসহাফে (কুরআনে) আলিফ ব্যতীতই লিখা হচ্ছে, আর যেখানে নবী (স.)-এর যুগে “আলিফ” যোগে লিখা হয়েছিল ওখানে আজও “আলিফ” অক্ষর যোগেই লিখা হচ্ছে। অবশ্য তেলাওয়অতকারীদের সুবিধার্থে “আলিফ” অক্ষরের ওপর একটি গোল (০) চিহ্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। আর শিক্ষকগণ তাদের ছাত্রদেরকে শিখিয়ে দেন যে, এ “আলিফ”টি অতিরিক্ত যা পড়ার সময় উচ্চারণ হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন