শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোজা ও তার মর্মকথা

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০৫ এএম

মহান আল্লাহ পাক আল-কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারাহ) রোজা হচ্ছে ইসলামী ইবাদতের তৃতীয় রোকন। আরবী ভাষায় রোজাকে সাওম বলা হয়। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে চুপ থাকা, বিরত থাকা। কোনো কোনো মুফাচ্ছিরীনের বিশ্লেষণ মোতাবেক, সাওমকে কখনও কখনও ছবরও বলা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে, নিজেকে দৃঢ়তার সাথে নিবৃত্ত রাখা এবং সুদৃঢ় পন্থায় দৈহিক চাহিদাসমূহকে সংযত রাখা। এই অর্থসমূহের দ্বারা বোঝা যায় যে, ইসলামী পরিভাষায় রোজার প্রকৃত অর্থ ও মর্ম কী। বস্তুত রোজা হচ্ছে নফসের খাহেশ ও আশা-আকাক্সক্ষাসমূহকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সংযত রাখা এবং লোভ-লালসা উৎসাহব্যঞ্জক রঙিন পরিমন্ডলে নিজের দেহ-মন-প্রাণকে সংযত, সুদৃঢ়ভাবে বিমুক্ত রাখা। ব্যবহারিক জীবনে প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের মাঝে সাধারণত নফসানী খাহেশসমূহ এবং মানবিক লোভ-লালসা ও উচ্চাকাক্সক্ষাসমূহের বিকাশস্থল হচ্ছে তিনটি। যথা- খাদ্য, পানীয় এবং নারী। এই তিনটি উপকরণ এবং উপায় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দৈহিক ও আত্মিক সম্পর্কসমূহকে সংযত ও সুসংহত রাখার নামই শরীয়ত মোতাবেক রোজা। কিন্তু একই সাথে এ সকল বাহ্যিক খাহেশের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ খাহেশসমূহ ও অমঙ্গল চিন্তা-ভাবনা হতে অন্তর ও যবানকে হেফাযত রাখার নাম বিশেষ শ্রেণীর নিকট রোজার মর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
ইসলামের মূল উৎস কুরআনুল কারিম নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়েত, পথ প্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। কোরআনে বলা হয়েছে, তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় কিংবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোজা অন্যান্য দিনসমূহে আদায় করবে। আল্লাহপাক তোমাদের আসানী কামনা করেন এবং তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপিত হোক তা কামনা করেন না। যেন তোমরা রোজার নির্দিষ্ট পরিমাণকে পরিপূর্ণ করতে পার এবং (এই রোজা এজন্য ফরজ হয়েছে) যাতে করে তোমরা এই হেদায়েত মোতাবেক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার। (সূরা বাকারাহ: রুকু-২৪)
কুরআনুল কারীমে সুস্পষ্টভাবে এ কথা তুলে ধরা হয়েছে যে, বর্তমান ইসলামের সাথেই শুধু কেবল রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়; বরং কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী মাযহাবগুলোতেও রোজাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্ধকার যুগের আরবদের সামনে রাসূলুল্লাহ সা. উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের মাঝে রোজা অবশ্যই ফরজ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন আরবের বিরুদ্ধবাদী সম্প্রদায় এমনকি বর্তমান যুগের কোনো কোনো পন্ডিত ব্যক্তিও মনে করেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাবি যদি সর্বাংশে সত্য ও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তাহলে এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা- সংকোচের অবকাশ মোটেই থাকবে না যে, তিনি উপাদানভিত্তিক জ্ঞানবত্তার ঊর্ধ্ব পরিমন্ডলে অবশ্যই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দাবির সত্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের অধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি আমরা পেশ করছি, যা অনুসন্ধানীদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার রোজার প্রবন্ধ লেখক (ঋধংঃরহম) উল্লেখ করেছেন যে, ‘রোজার বিধিবিধান ও আদায় পদ্ধতি, আবহাওয়া, সামাজিক ব্যবস্থা এবং সভ্যতা বিবর্তনের দরুন যদিও বিভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হয় তথাপি আমরা অতি কষ্টে এমন কোনো ধর্মের নাম উপস্থাপন করতে পারব না, যেখানে রোজাকে ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়নি।’ সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, ‘বস্তুত রোজা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সকল স্থানেই স্বীকৃত আছে।’
আরববাসীরা ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কম-বেশি ওয়াকিবহাল ছিল। মক্কার কোরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ই মুহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখত যে, এই দিনে খানায়ে কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল : ষষ্ঠ খন্ড, ২৪৪ পৃ:) মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করত। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সাওম, ১ম খন্ড, ১৬২ পৃ:) অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে ৭ম মাসের ১০ম দিনে রোজা রাখত। এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, কুরআনুল কারীমের নির্দেশ, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল’ কতখানি ঐতিহাসিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
মানুষের সকল প্রকার আত্মিক অবনতি ও দুর্ভাগ্যসমূহকে এবং তার অসফলতার কার্যকারণসমূহ যদি পুঙ্খনুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সর্বশেষ পরিণাম ফল এই দাঁড়াবে যে, পৃথিবীর বুকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনীয়সমূহের প্রতি মুখাপেক্ষী এবং তারা বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে চলে। তাদের অন্তরের যে কোনো অনুকম্পন এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বস্তুত যাবতীয় চেষ্টা ও তদবীর কোনো প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্য থেকে খালি নয়। নৈতিক অবস্থা যার সার্বিক সম্পর্ক আত্মিক অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি এর তাহকীক করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, এর ভিত্তিও সাধারণত কোনো না কোনো প্রয়োজন অথবা গরজে নফসানীর ওপর অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত। এ জন্য আমাদের সকল প্রকার দুর্ভাগ্য, অপবিত্রতা এ সকল কারণেরই ফলশ্রুতি মাত্র। সুতরাং প্রয়োজন এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষী ও বিমুক্ত হয়ে যায় তাহলে সে আর মানুষরূপে বরিত হবে না, বরং তাকে ফেরেশতা বলাই সমীচীন হবে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রয়োজনসমূহ এবং তাদের বিভিন্নমুখী আশা-আকাক্সক্ষা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা একটি বৃহত্তর পরিসরে সীমাহীনরূপে পরিদৃষ্ট হয় এগুলোর আসল হাকীকত কি? আমাদের অন্তরে রয়েছে আশা-আকাক্সক্ষার একটি খনি এবং ইচ্ছা ও অভিব্যক্তির সুবিশাল প্রান্তর এবং সেখানে অবস্থান করছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অসংখ্য প্রয়োজনীয়তার সম্ভার। কিন্তু তাই বলে কি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকাদি, আলীশান ইমারতরাজি, সুস্বাদু আহার্য সামগ্রী এবং দ্রুতগামী যানবাহনসমূহ ছাড়া আমার বেঁচে থাকতে পারি না? আমাদের সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ এবং আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও চাকর-বাকরদের পরিবেষ্টিত অবস্থার বিপরীত পরিমন্ডলে আমাদের জীবনীশক্তি ও ব্যক্তিসত্তার কি সমাধি রচিত হয়ে যাবে? অনেক রাজা-বাদশাহ ফকীরদের মতো জীবন অতিবাহিত করেছেন। সাধারণ্যে প্রচলিত কথায় জানা যায়, ইব্রাহীম আদহাম বাদশাহ হয়েও ফকীরী গ্রহণ করেছিলেন এবং আনন্দ ও পরিতৃপ্তির সাথে রূহানী জিন্দেগী অতিবাহিত করেছিলেন।
কুরআনুল কারীমে সিয়াম সাধনার হাকীকত ও মানদন্ডকে শুধুমাত্র একটি শব্দের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে শব্দটি হলো তাকওয়া বা পরহেজগারী। রোজার হাকীকত ও বিশেষত্ব সুলভ তাকওয়া ও পরহেজগারী পৃথিবীর সকল ধর্মেই একইভাবে অবলম্বন করা হয়েছে। এ কারণে কুরআনুল কারীম ও অন্য ধর্মগুলোকে রোজার এই অভ্যন্তরীণ হাকীকতের সাথে সম্পৃক্ত করে ঘোষণা করেছে, ‘তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারাহ: রুকু ২৩)
প্রকৃতপক্ষে রোজার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করা। অর্থাৎ নিজের খাহেশাতকে নিজের আওতাভুক্ত রাখা এবং দৈহিক কামনা-বাসনার তীব্র প্রভঞ্জনের ছোঁয়াচ হতে নিজেকে বিমুক্ত রাখা। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, রোজা আমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে এক প্রকার রুহানী চিকিৎসা হিসেবে। শুধু তই নয়, আল-কুরআনে ইসলামে রোজার ওপর দুটো সুনির্দিষ্ট বিশেষত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যেন আল্লাহপাক তোমাদেরকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন সে মোতাবেক তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং আল্লাহার শোকর গুজারী আদায় করো। (সূরা বাকারাহ: রুকু- ২৩)
এই মৌলিক দিকনির্দেশনার বিশ্লেষণ করার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই রমজানুল মুবারকের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, রমজানের মূল হাকীকত অনুধাবন না করা পর্যন্ত এই বিশেষত্বটি আমরা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন