বরাবরই পবিত্র রমজান আসার আগেই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবন অসহনীয় করে থাকেন। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে প্রতি বছর অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের আর্বিভাব ঘটে। এসব ব্যবসায়ী চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চাল, সয়াবিন খেজুর, পাঞ্জাবী, শাড়ি ইত্যাদি পণ্য বিক্রী করে থাকে।
কথিত আছে, এসব ব্যবসায়ী বলে থাকে, রমজানের একমাস ব্যবসা করব, সারা বছর আরামে কাটাব। পবিত্র রমজান মাস মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বিশেষ নিয়ামত। এটি সংযম ও নাজাতের মাস, পাপমুক্তির মাস হলেও এসব মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মের কারণে জনজীবন হয়ে উঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক।
পবিত্র রমজান উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজানের আহার্য-ব্যবহার্য সব পণ্য এবং পবিত্র বড় দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে পণ্য বাজারে বিশাল মূল্য হ্রাস করে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। রমজান ইত্যাদি উৎসব এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মেতে উঠে। ফলে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে।
রমজান মাস নাজাতের মাস হলেও আমাদের দেশে তা আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়। পবিত্র ইসলামে অতিরিক্ত মূল্য আদায় কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য আদায় করে এ সুযোগে যে, ক্রেতা পণ্যের মূল্য জানে না; তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ হিসাবে গণ্য হবে।’ আবার মজুদদারী সর্ম্পকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মজুদদার খুব নিককৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর দাম বেড়ে গেলে আনন্দিত হয়।’ (মেশকাত)।
রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের অমীয় বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে মাহে রমজান। কিন্তু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা রমজানের আগেই পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজান মাসে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নানা রকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি থাকে। কিন্তু বরাবর দেখা গেছে, কোনো বিশেষ উপলক্ষে বাজারের নাটাই থাকে অশুভ চক্রের হাতে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ব্যবসায়ীরা থোড়াই কেয়ার করে, তারা পণ্যমূল্য ইচ্ছামত বাড়িয়ে দেয়। তাই বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়। সে কারণে পবিত্র রমজান মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সহনীয় পর্যায় রাখার জন্য সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সব মহল ব্যবসায়ীদের বার বার অনুরোধ করার পরও তাদের সেই প্রতিশ্রুতি কাজে আসে না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে পুরো দেশ অন্য দেশের বাজারে পরিণত হয়েছে। পাউরুটি বিস্কুট, পরাটা, থেকে শুরু করে আমদানি করা হয় না এমন পণ্যের তালিকা হয়ত দেশে নেই। মাছও আমদানির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সরকারের কিছু কর্তাব্যক্তি নিজেদের আখের গোছাতে আমদানিকৃত পণ্যে শুল্কহ্রাস ও ভর্তুকি প্রথা চালু করে দেশীয় উৎপাদক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রায় পথে বসিয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে প্রচলিত জেলা প্রশাসন, ডিএমপি, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার অভিযান পরিচালিত হলেও এর সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা।
রমজানে হয় কারসাজি পিঁয়াজ নিয়ে। এবার অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে আদার দাম। যদিও সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো থাকায় রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা। এটা সত্য মানুষের আয়ের চেয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। ফলে সঞ্চিত অর্থে হাত পড়ে। মূল্য বৃদ্ধির কারণে ১৬ কোটির মধ্যে ১২ কোটি মানুষকেই অর্থাৎ মোট জন সংখ্যার ৭৫ শতাংশ জন সংখ্যা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ কথা জানা গিয়েছিল গত বছর বাংলাদেশ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) প্রতিবেদনে। খাদ্যসহ নিত্য পণ্যের চড়া মূল্যে মানুষের বাড়তি আয় খেয়ে ফেলছে। সর্বাধিক বিরূপ প্রভাব পড়ছে অতি দরিদ্র দুই কোটি মানুষের উপর।
ভোক্তাদের সঙ্গে আর একটি অধিকার লংঘন হচ্ছে, তা হলো ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো নীতি নির্ধারণীমূলক ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ থাকে নামে মাত্র। কখনো একেবারেই থাকে না। যেমন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ, মূল্য নির্ধারণে বিষয়ক যে কোনো সভায় শুধু ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের সরকারি কর্মকর্তারা অংশ নিয়ে থাকে। এখানে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নেই। এসব নীতি নির্ধারণী সভায় শুধু ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব থাকার কারণে সাধারণ ভোক্তারা তাদের সমস্যা ও ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরতে পারে না। এখন প্রয়োজন ভোক্তাদের সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়ন। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে নিজেদের ইচ্ছামত, আসল নকল পরখ করে পণ্য ক্রয়ের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে ভোক্তা হিসেবে তাদের সচেনতার ও পণ্যের মান সর্ম্পকে সঠিক তথ্য প্রদান করা গেলে এ ভোগান্তির মাত্রা অনেকাংশে লাঘব হবে।
প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও শিক্ষার অভাবে দেশের অধিকাংশ ক্রেতা-ভোক্তা তাদের অধিকার, দায়িত্ব কর্তব্য সর্ম্পকে সচেতন নয় অধিকন্তু অধিকাংশ ভোক্তা আসল-নকল চিহ্নিত করে সঠিক পণ্য পছন্দ করার যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। সরকার ও বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ে সুস্থ ধারার বিকাশ সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে এখানে ফটকাবাজ, মৌসুমি ব্যবসায়ী, অসৎ ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটছে ব্যাপকহারে। ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা ও শিক্ষা প্রদান করতে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ভিতরকার ব্যবধান হ্রাস করতে পারে। এ ছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, সেবা সার্ভিসসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংগঠনের সম অংশগ্রহণ ভোক্তা স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন