মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাভাইরাসের অভিশাপ থেকে মুক্তি এবং বিশ্ব শান্তি কামনায়

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০৫ এএম

পত্রিকা খুললে সর্বত্র একই বিষয়। করোনাভাইরাস। বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসের দ্বারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৩০ লাখের বেশি মানুষ, মৃত্যুবরণ করেছে দুই লাখের বেশি। পৃথিবীর তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত ও পরাশক্তিগুলোও এর আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষও তাদের কোনো সুফল দিতে পারছে না অদৃশ্য এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে। তুলনা করলে দেখা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের মানুষরাই বেশি বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। করোনার মতো প্রাণঘাতী রোগের প্রথম উৎপত্তি হয় চীনে। এতদিন এটাই শুনে এসেছি। কিন্তু সম্প্রতি এনিয়ে চীনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে, এ রোগের আসল উৎপত্তি স্থল চীনে ছিল না। ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এনিয়ে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উদীয়মান শক্তি চীনের মধ্যে ইতোমধ্যে তর্কযুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল নিয়ে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধ-সম্পর্কিত বিভিন্ন সংবাদ।
তবে করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী রোগের মূল উৎপত্তিস্থল চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে তর্ক আজ আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এরোগ যে এখন সারা বিশ্বের জন্য মহা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাই বড় কথা। সুতরাং এই ভয়াবহ রোগের উৎপত্তি কেন ও কীভাবে হয় এবং কীভাবে এর প্রকোপ থেকে সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করা যায় সেটা নিয়েই চিন্তা-গবেষণায় মনযোগী হওয়াটাই এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক মনীষী-চিন্তাবিদ মনে করেন, আধুনিক বিশ্বে মানুষ এত অধিক অন্যায় ও মানবতা বিরোধীকাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে যে, আল্লাহর কাছে দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে, মানুষের আর কোনই প্রয়োজন নেই বিশ্বপ্রতিপালকের কাছে। আমাদের বিশ^াস এ বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির যথেষ্ট সঙ্গতি রয়েছে। দেশে দেশে আজ অর্থহীন যুদ্ধ, রক্তপাত, অন্যায়, অনাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, উদ্ভাস্তু হচ্ছে, অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। এ সম্পর্কে আমরা পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে প্রকৃত সত্যের সন্ধান পেতে পারি। পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে আমরা জানতে পারি, মানব সৃষ্টির প্রাক্কালে সর্ব শক্তিমান আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। ফেরেশতাগণ তাঁর এ ইচ্ছা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে বা যারা দুনিয়াতে ঝগড়া-ফ্যাসাদ ঘটিয়ে রক্তপাতের কারণ হয়ে উঠবে? আমরা তো আপনারই গুণ-গান প্রচার করে চলেছি। এর পর আপনার আর নতুন সৃষ্টির প্রয়োজন আছে কি?
প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে এমন এক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হতে পারে যারা দুনিয়াতে ঝগড়া-ফ্যাসাদ ঘটাতে পারে এ আশঙ্কা ফেরেশতাদের মধ্যে কীভাবে এসেছিল? হ্যাঁ, এ আশঙ্কা ফেরেশতাদের মধ্যে এসেছিল ইতোপূর্বে সৃষ্ট জিন্ সম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে। কেননা মানবজাতি সৃষ্টির আগে আল্লাহপাক জিনজাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে মারামারি, রক্তপাতের মতো ঘৃণ্য ঘটনাসমূহ প্রায়ই লেগে থাকত। তাই ফেরেশতাদের মধ্যে মানবজাতির সৃষ্টির ব্যাপারেও এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। আল্লাহতায়ালা অবশ্য ফেরেশতাদের এ আশঙ্কা এই বলে নিবৃত্ত করেছিলেন যে, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।
এরপর আল্লাহতায়ালা আদি মানব হজরত আদম (আ.)-কে কিছু নাম শিক্ষা দেন এবং অতঃপর ফেরেশতাদের কাছে সেসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। ফেরেশতাগণ জবাবে বলেন, আপনি যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বাইরে আমরা তো কিছুই জানি না। অতঃপর আদম (আ.)-কে ঐসব প্রশ্ন করা হলে তিনি সেসবের যথাযথ জবাব দেন। আল্লাহতায়ালা আদম ও তার সঙ্গিনী বিবি হাওয়াকে বেহেশতে বাস করতে নির্দেশ দিয়ে একটি বৃক্ষের ফল ভক্ষণ না করার জন্য নির্দেশ দেন। তাছাড়া উপস্থিত সকলকে নির্দেশ দেন আদমকে সেজদা করতে। ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশ মতো আদমকে সেজদা দিলেও জিন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ইবলিশ আদমকে সেজদা করলো না। এর কারণ সম্পর্কে সে বলল, আমাকে [ইবলিশ] সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। এ কারণে আমি আদম থেকে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং, সে এভাবে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে বসল শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে। ফলে সে এবং তার অনুসারীরা অভিশপ্ত হয়ে গেল।
অতঃপর সে তার অনুসারীরা আদমের বংশধরদের বাস্তব জীবনে পথভ্রষ্ট করাকে তাদের জীবনের প্রধান করণীয় করে নিল। অন্যদিকে, আদমের বংশধর, মানুষের জন্য ভালো ও মন্দ উভয় কাজের ক্ষমতা দেয়া হলো। তবে কথা থাকলো যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চলবে, তারা পরকালে তার সর্বোত্তম পুরস্কার পাবে। আর যারা তার বিরোধিতা করবে তারা আল্লাহর অবাধ্যতার জন্য পরকালে পাবে অনন্তকালের জন্য দোজখের শাস্তি।
এরপর আদম দম্পতিকে এবং তার পাশাপাশি ইবলিশকে পাঠানো হলো দুনিয়ায় পরস্পরের শত্রু রূপে। আর আদমের বংশধরদের পার্থিব জীবনকে ঠিক করা হলো পরীক্ষাক্ষেত্র হিসাবে। এই দুনিয়ার অস্থায়ী জীবনে যে বা যারা আল্লাহর বিধান মোতাবেক চলবে সে বা তারা পরকালে পাবে অনন্তকালের জন্য বেহেশত বাসের সুযোগ পুরস্কার হিসাবে। অপরদিকে যারা দুনিয়ায় আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করবে, নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো জীবন-যাপন করবে তারা থাকবে অনন্তকালের জন্য দোযখে, ভোগ করবে আগুনের শাস্তি। সুতরাং, আমরা যে পার্থিব জীবনে আছি, তার স্বার্থকতা নির্ভর করবে আমাদের আখেরাতের জীবনে অনন্তকালের জন্য আল্লাহর পুরস্কার বা শাস্তির ওপর।
উপরের এই আলোচনার আলোকে আমরা যদি আমাদের পার্থিব জীবনকে বিচার করি তাহলে আমরা কি দেখি? বিশ্ব স্রষ্টা, বিশ্বপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান মেনে চলছি বলে মনে হয়কি? আমরা তা মেনে চলছি না। সুতরাং, আমরা পার্থিব জীবনে আমাদের অন্যায় অনাচার প্রভৃতি অপকর্মের আংশিক শাস্তি হিসাবে এ দুনিয়ায়ও আজাবের মধ্যে রয়েছি। করোনাভাইরাস সে আজাবেরই দৃষ্টান্ত। আংশিক পাওনা বলা হলো কারণ এখানে আমরা আমাদের পার্থিব জীবনের শাস্তির অংশ আমরা দুনিয়ায় ভোগ করছি। বাকীটা আমরা পরকালে ভোগ করবো। সে শাস্তি থেকে আমাদেরকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং, পার্থিব জীবনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার বিধান যদি আমরা মেনে চলি, একমাত্র তবেই তার ক্ষমা লাভ করতে পারব আমরা।
এখানে আরেকটা কথা বলে আজকের এ আলোচনার ইতি টানতে চাই। পৃথিবীতে প্রথম মানব ছিলেন আদম (আ.)। যুগে যুগে মানব জাতিকে আল্লাহর বিধান মোতাবেক চলার পথ নির্দেশনা দানের জন্য স্রষ্টা প্রচুর সংখ্যক নবী রাসূল দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পাঠানো এইসব নবী রাসূলদের মধ্যে প্রথম মানবকে (আদম আ.) আল্লাহ নবী হিসাবে পাঠিয়েছিলেন, যাতে দুনিয়ার একজন মানুষও আল্লাহর বিধান জানা থেকে বঞ্চিত না থাকে। আর শেষ নবী হিসাবে আল্লাহ পাঠিয়েছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আমরা (মুসলিমরা) যার উম্মত। হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এক লাখ বা দুই লাখ চল্লিশ হাজার নবী রাসূল এসেছেন মানব জাতির অগ্রগতির ধারা নিশ্চিত করতে। তাদের অনুসারীরা আজকের পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হিসাবে নানাভাবে বিভক্ত হয়ে নানা বিভ্রান্তির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু একটা বিষয়ে সকল প্রকৃত ধর্মের অনুসারীরাই একমত। তাহলো [এক] স্রষ্টা ও আল্লাহপাকের একত্ব তথা তৌহিদ, [দুই] বিশ^মানব বা নবী-রাসূলদের বা সত্য ধর্মের বাণীবাহকের সত্যতা, [তিন] ইহকালের ভালো বা মন্দকাজের অর্জন হিসাবে আখেরাত বা পরকালে অনন্তকালের পুরস্কার বা শাস্তি। বলা বাহুল্য, এই তিনটি বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসী হলে আমরা দুনিয়াতে আগন্তুক বিধায় আল্লাহর বিধান মোতাবেক দায়িত্বশীল জীবন চালনার অনুভূতিশীল হতে পারি। নইলে আমরা আমাদের পার্থিব জীবনে দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করে পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য। অবশ্য ইহকালের অন্যায় কাজের জন্য আমরা ইহকালেই আংশিক শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য, যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার ক্ষমা লাভ করতে আমরা ব্যর্থ হই। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ আজাব হয়তো সে কারণেই আমাদের ওপর আপতিত হয়েছে।
পরিশেষে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা জানাবো, মানবজাতির দুশমন ইবলিশের বংশধরদের প্ররোচনায় আমরা যেন আল্লাহর বিধান-বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত না হই এবং মানব সমাজের অন্যদেরও অন্যায়ভাবে ক্ষতির মুখে ঠেলে না দেই এবং স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসাবে দুনিয়াতে সকল মানুষের শান্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দেওয়া নির্দিষ্ট সঠিক পথে চলতে শিখি এবং তার মাধ্যমে দুনিয়াতে মানুষে মানুষে সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শে এক সুন্দর বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজে আল্লাহর সাহায্য ও রহমত লাভে সক্ষম হই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন