বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২০, ১২:০৯ এএম

আজ ১ মে। মহান মে দিবস। শ্রমিকদের আনন্দ ও সংহতির দিন। ন্যায্য দাবি আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মাহুতির মাধ্যমে শ্রমিকরা এই বিজয় অর্জন করে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগোর হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক শান্তিপূর্ণভাবে এক সমাবেশ করে। সমাবেশে বিনা উসকানিতে নির্বিচারে ব্যাপক গুলি চালায় পুলিশ। তাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ১১ জন ও শতশত শ্রমিক আহত হয়। উপরন্তু সাতজন শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। তন্মধ্যে লুইস লীন নামে একজন শ্রমিক আত্মহত্যা করে। বাকি ৬ জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। এই নারকীয় ঘটনায় আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের শ্রমিকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ৪ মে সন্ধ্যায় শিকাগোয় ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ফলে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় শ্রমিকদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১ মে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে এ ব্যাপারে একটি কনভেনশন গৃহীত হয় আইএলও-তে। তারপর থেকে এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতীয় উৎসবের মতোই (বাংলাদেশে শুরু হয় ১৯৭২ সালে)। সরকারিভাবে দিনটিতে ছুটি থাকে। পরবর্তীতে একে একে বিশ্বব্যাপী বহু আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠে। অনেক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিকরাজ। তথাপিও দীর্ঘদিনেও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিসমূহ তথা ন্যায্য মজুরি বাস্তবায়ন হয়নি। নির্যাতন বন্ধ হয়নি। ব্যাপক বৈষম্যও রয়েছে। তন্মধ্যে নারী শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য বেশি। এসব গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি। এমনকি বহু দেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবুও শ্রমিকরা মে দিবস পালন করে আসছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, ব্যাপক উল্লাসের মাধ্যমে। কিন্তু এ বছর কি তা হতে পারবে? হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে হবে। কিন্তু তাতে শ্রমিকদের স্বঃস্ফূর্ততা ও অঙ্কগ্রহণ তেমন থাকবে না। কারণ, প্রায় সারা বিশ্ব (মহাকাশ ও পানিতেও) করোনা (কভিড-১৯) মহামারীতে ক্ষত-বিক্ষত। মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেছে কল্পনাতীত। ফলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া, করোনা মোকাবেলায় লকডাউনের কারণে প্রায় সব কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতিসংঘ ও তার অধীনস্থ সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, ‘বৈশ্বিক মহামন্দা’ সৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯০৮ বা তার আগে যে কোনো মহামন্দার চেয়ে ব্যাপকতর। তাই এ বছর বৈশ্বিক গড় প্রবৃদ্ধি মাইনাসে যাবে, ১৭০টি দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন সূচক শূন্যের নিচে নেমে গেছে। দারিদ্র্য অনেক বেড়ে যাবে। মানবাধিকার সঙ্কটে পরিণত হতে পারে, খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হবে এবং ৩৬টি দেশ ও প্রায় ২৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। অনাহারে ৩ কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। আইএলও বলেছে, করোনা সৃষ্ট সঙ্কটে বিশ্বের ৩৩০ কোটি শ্রমশক্তির ৮১% শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯ কোটি শ্রমিক দীর্ঘস্থায়ী কাজ হারাবে। এর মধ্যে ১২ কোটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলেই। অক্সফাম বলেছে, ‘করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে যেতে পারে।’ এসব ক্ষতির সর্বাধিক শিকার হচ্ছে শ্রমিকরা। কারণ, এ ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সামর্থ্য নেই তাদের। শ্রমিকদের এই করুণ পরিস্থিতিতেও তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেনি কোন আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক শ্রমিক সংগঠন! কল্পনাতীত এ মহাবিপদ থেকে পরিত্রাণ কবে তা কেউ জানেন না। কারণ, এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি এখনও। তাই নিত্য নতুন এলাকায় এর বিস্তার ঘটছে। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা এখন হটস্পট বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এমনকি কোথাও কোথাও শেষ হওয়ার পর পুনরায় শুরু হচ্ছে। আবার সুস্থ হওয়ার পরের দিনও মারা যাচ্ছে অনেকেই। তাই হু প্রধান বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাস দীর্ঘসময় ধরে আমাদের সঙ্গে থাকবে। তাই লকডাউন তুলে নিলে আবার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।’ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ফাউসি বলেছেন, ‘যতদিন না করোনার বিরুদ্ধে একটা কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে এবং জনগণকে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা না যাচ্ছে, ততদিন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে না।’ কিন্তু এই প্রাণঘাতী ব্যাধি যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, মানুষের ক্ষতি তত বাড়বে। তন্মধ্যে শ্রমিকদের ক্ষতি হবে বেশি।
করোনা মোকাবেলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো পর্যন্ত হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, এতদিন তারা মানুষের জীবন রক্ষা ও মানোন্নয়নের চেয়ে মানুষকে ধ্বংস করার দিকে গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। এমনকি হাইপারসনিক ও এন্টি-হাইপারসনিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে! ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের রিপোর্ট মতে, ‘বিশ্বে গড়ে মাথাপিছু সামরিক ব্যয় ২৩৯ ডলার। এর বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় খুবই অপ্রতুল।’ ফলে কোনো দেশেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এমনকি স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই অনেক দেশে। হু বলেছে, বিশ্বে প্রয়োজনের তুলনায় নার্স ঘাটতি আছে ৬০ হাজার। তাই বর্তমান করোনার সময় বেশিরভাগ দেশ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তো দূরে থাক, প্রয়োজনীয় পিপিই দিতে পারেনি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাই পিপিই’র পরিবর্তে পলিথিন ব্যবহার করে ডিউটি করেছে ব্রিটেনের নার্সরা। ফলে তাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে করোনায়। পরাশক্তি আমেরিকা পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে সাহায্য চেয়েছে বিভিন্ন দেশের কাছে! উপরন্তু তড়িঘড়ি করে স্বাস্থ্যবিল পাশ করেছে। এরূপ করুণ পরিস্থিতি প্রায় সব দেশেই চলছে। তাই বহু দেশে অসংখ্য ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছে করোনায়। হু গত ১১ এপ্রিল জানিয়েছে, ৫২টি দেশে ২২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে মারা গেছে! এই অবস্থায় অন্য চিকিৎসা প্রায় বন্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষ চরম কষ্ট ভোগ করছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। তাই ঢাকার এক ডাক্তার বিবিসিকে বলেছে, ‘প্রণোদনার দরকার নেই, আমাদের দরকার সুরক্ষার। মরে গেলে প্রণোদনা দিয়ে কী করবো।’ আর নার্সদের দুটি সংগঠন জানিয়েছে, কর্মরত নার্সদের ৮৫.৬৬% পিপিই নেই। উপরন্তু দেশে স্বাস্থ্য খাতে ৩০ হাজার পদ শূন্য আছে। তাই করোনা সঙ্কট থেকে শিক্ষা নিয়ে সব দেশের উচিৎ সামরিক ব্যয় হ্রাস করে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বৃদ্ধি করে প্রয়োজনীয় সামর্থ্য অর্জন করা। নতুবা আবার কোনো ভাইরাসে বর্তমানের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
যা’হোক, করোনা সৃষ্টির আগেও শ্রমিকরা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়। প্রযুক্তি দখল করেছে শ্রমিকের স্থান। বিশেষ করে, অটোমেশন, রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এসবের প্রত্যেকটির উৎপাদনশীলতা শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি। কাজও নিখুঁত, ব্যয়ও স্বল্প। ফলে মালিকরা সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাই শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেয়েছে অনেক। ভবিষ্যতে আরও হবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘রোবট মানুষের অনেক কাজের ক্ষেত্র দখল করে নেবে। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এই প্রক্রিয়াকে আরও বেশি বেগবান করেছে।’ তবুও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এবং তা ধরিত্রী থেকে মহাকাশে, চাঁদে, মঙ্গলে তথা সৃষ্টির সর্বত্রই। তবুও একে রোধ করা সম্ভব নয়। এটাই প্রগতির স্বভাব। অন্যদিকে, শ্রমিকরা বিশ্বায়নের কারণেও নয়া শোষক-বহুজাতিক কোম্পানি এর যাঁতাকলে পড়ে শোষিত হচ্ছে। চাকরিও হারাচ্ছে ব্যাপক। কারণ, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। তবুও শ্রমিকরা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। সেই সক্ষমতাও নেই তাদের। কারণ, বহু মত ও পথে বিভক্ত হয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
একই অবস্থা বাংলাদেশেও। ফলে মানুষের উপার্জন বন্ধ হয়ে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গরিব ও শ্রমিকরা। তাই দারিদ্র্য বাড়ছে। ব্র্যাক বলেছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় অনেক কমে চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়েছে ৬০%। আর ১৪% (২.৩৮ কোটি) মানুষের ঘরে কোনও খাবারই নেই। দশ টাকা কেজি দরে চালে গরিব ও শ্রমিকের কিছু উপকার হতো। কিন্তু তা বন্ধ করা হয়েছে দুর্নীতির কারণে! টিসিবির পণ্য নিয়েও চলছে তেলেসমাতি কারবার। নামে মাত্র ত্রাণ, তাতেও চলছে চরম হযবরল অবস্থা। ফলে গরিব ও শ্রমিকরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বর্তমান চরম দুর্মূল্যের বাজারে। করোনা সঙ্কটে সরকার সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ। তাও ৯% সুদে। যার অর্ধেক মালিকের আর অর্ধেক সরকারের। এই প্যাকেজের ৫ হাজার কোটি টাকা রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতনের জন্য ও ৫ হাজার কোটি টাকা কৃষি খাতের জন্য। বাকী টাকা ব্যবসায়ীদের জন্য। আর এসব হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের। দ্বিতীয়ত: ঘোষিত সহায়তা পরিস্থিতি অনুযায়ী যথোপযুক্ত কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অপরদিকে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য কোনো সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়নি। অথচ এখানেই তাদের সংখ্যা অধিক। দেশের মোট শ্রমিকের ৮৫% এই খাতের। যাদের মোট সংখ্যা ৫ কোটির অধিক। এদের বেশিরভাগ দোকান, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, গৃহকর্মী ইত্যাদিতে কর্মরত। তারা দিন আনে দিন খায়। তাই তারা এখন কাজ হারিয়ে চরম দুর্দিনে পড়েছে। পরিবহন খাতের শ্রমিকরা মিডিয়ায় জানিয়েছে, ‘তাদের মোট সংখ্যা ৯০ লাখ। তন্মধ্যে সড়ক পথে ৭০ লাখ ও নৌ পথে ২০ লাখ। তাদের সকলের কাজ বন্ধ।’ ‘করোনা আইসে, হের লাইগা আমারে খেদাই দিছে। আজ চাইরদিন হইছে ঘরে খাওন নাই’-এ কথা আশকোনার গৃহকর্মী সাবিনার। এই বক্তব্য শুধু তার একার নয়- এটা সব গৃহকর্মীরই বক্তব্য। এরূপ পরিস্থিতি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের। এই অবস্থায় তারা চলবে কীভাবে? তাই নিম্ন আয়ের ২ কোটি পরিবারকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নগদে প্রণোদনার দাবি জানিয়েছে সিপিডি। অপরদিকে, অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অভিজিৎ বলেছেন, ‘টাকা ছাপাতে হবে, দরিদ্র মানুষের হাতে দিতে হবে।’ কিন্তু সরকার এসবের কোনটিতেই না গিয়ে ওষুধ, উৎপাদন ও রফতানি খাতের শিল্প খোলা যাবে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে বলে গত ২৩ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারী করেছে। কিন্তু যেখানে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশসহ প্রশাসনের লোকজনের এবং সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি, তাই তারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে- মারা যাচ্ছে, সেখানে শ্রমিকদের এই মহামারীর সময় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে? দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে, টেস্টের অবস্থা অপর্যাপ্ত, অক্সিজেনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সতর্কতার সঙ্গেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আর শ্রমিক নেতারা বলেছেন, কারখানা চালু করা হলে অনেক শ্রমিক সংক্রমিত হতে পারে। যা’হোক, জীবনের চেয়ে জীবিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই হুট করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাও ভালো নেই। বিশেষ করে গার্মেন্টের। কারণ, করোনা সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে বহু কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে বেতন না দিয়েই। তাই শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে বকেয়া বেতনের দাবিতে। অথচ তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের দুটি সংগঠন এই সময়ে শ্রমিক ছাঁটাই না করতে কারখানা মালিকদের অনুরোধ জানিয়েছিল। উপরন্তু গত ১৩ এপ্রিল শ্রম প্রতিমন্ত্রী শিল্প মালিকদের নির্দেশ দেন ১৬ এপ্রিলের মধ্যে সব পাওনা পরিশোধ করার। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। তবুও বহু কারখানায় বেতন দেওয়া হয়নি। লকডাউন উপেক্ষা করে গত ৫ এপ্রিল কারখানা খোলার খবর জানানোর কারণে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ শ্রমিক গাদাগাদি করে ট্রাকে চড়ে/পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসে। পথে ফেরিতেও প্রচন্ড ভিড় হয়। অনেকেই মাছের ড্রামের মধ্যে লুকিয়ে আসে। কিন্তু সরকারের কঠোরতার কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় তাদেরকে বাড়িতে ফিরে যেতে হয় একইভাবে! এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। তাদের এই চরম হয়রানি ও অর্থ ব্যয় চরম পৈশাচিকতার সামিল। তাই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এভাবে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ডেকে আনা কোনভাবেই ঠিক হয়নি।’ উপরন্তু এতে করোনারও সংক্রমণ বৃদ্ধি ঘটেছে। তবুও এসব হয়েছে এবং তা সংশ্লিষ্ট মালিকদের হঠকারিতার কারণেই হয়েছে। অথচ মালিকরা করোনামুক্ত নয়। এক গার্মেন্ট মালিক করোনায় মারা গেছে। করোনার কারণে বাংলাদেশের গার্মেন্টের বিপুল অংকের অর্ডার বাতিল করেছে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। তাতে ২২ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। ফলে দেশের গার্মেন্ট খাত অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা পথে বসতে পাড়ে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর এটা হলে দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, জিডিপিতে গার্মেন্ট খাতের অবদান ১৬%, আর প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে দেড় কোটি মানুষ সম্পৃক্ত, যার অধিকাংশ প্রান্তিক নারী। এছাড়া, দেশের মোট রফতানির ৮০% এর বেশি গার্মেন্ট। তাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, বিভিন্ন নামকরা ব্র্যান্ড তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেয়ায় বেশ সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, গার্মেন্ট শিল্পের সাথে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির একটি বিরাট অঙ্ক জড়িত। এই শিল্পে সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে সেটি বাংলাদেশের সমাজ এবং অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেবে। তাই এই সঙ্কট কেটে যাবার আগ পর্যন্ত শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। অন্যদিকে, এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ক্রয়াদেশ স্থগিত না করে চুক্তির শর্ত যথাযথ পরিপালনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের ৯টি পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক সংগঠন। তথাপিও কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। অর্ডার বাতিল চলছেই। স্মরণীয় যে, ইতোপূর্বে পশ্চিমা ক্রেতা সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কারখানায় পরিবেশ ও নিরাপত্তা জোরদার করার তদারকির কারণে দেশের প্রায় অর্ধেক কারখানা বন্ধ হয়ে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। অথচ হাই কোয়ালিটির পোশাক রফতানি করতে পারলে আরও বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট রফতানির মধ্যে হাই কোয়ালিটির পোশাক খুব কম। অথচ বিশ্বে এর চাহিদা বেশি। উল্লেখ্য যে, তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার এখন ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ এর মাত্র ৫% সরবরাহ করে থাকে করোনার পূর্ব পর্যন্ত। এ হার ৮ শতাংশে উন্নীত করতে পারলেই ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা এবং আরও প্রায় ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়া সম্ভব বলে এক দৈনিকে প্রকাশ। কিন্তু মালিকদের অদক্ষতা ও অন্য নানা কারণে তা হচ্ছে না।
বর্তমানে এক কোটির অধিক বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে ১৬০টি দেশে। তারা লকডাউনের কারণে বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। উপরন্তু লকডাউন শেষ হলেও বৈশ্বিক মহামন্দা ও জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণে সর্বনিম্ন হওয়ায় ছাঁটাই হয়ে দেশে ফেরত আসতে হতে পারে সে আশঙ্কায় তারা ও তাদের আপনজনরা চরম উদ্বিগ্ন। কারণ, দেশে এলেই তারা কর্মে সম্পৃক্ত হতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই। ইতোমধ্যেই গত ২-৩ মাসে বাধ্য হয়ে প্রায় ৫ লাখ দেশে ফেরত এসেছে। এদের অনেকেই বেতন ছাড়াই দেশে এসেছে। দেশে এসেও কোনো কর্মে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত আনার জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদেরকে ফেরত আনা হবে বলে জানানো হয়েছে। তাই বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ বছর বাংলাদেশের রেমিটেন্স হ্রাস পাবে ২২%। অপরদিকে, দেশের বহু শ্রমিক বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তন্মধ্যে অনেকেই মারা গেছে। লকডাউনের কারণে তাদের মরদেহ দেশে আনা যায়নি। স্মরণীয় যে, প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো অর্থেই দেশের উন্নতি স্ফীত হয়েছে। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিবাসীদের দাবি সম্বলিত একটি খোলা চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফরম মাইগ্রেন্টস।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন