বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পৃথিবী পুনর্গঠনে করোনা মহামারীকে কাজে লাগানোর তাগিদ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

করোনা মহামারী বিশ্বের সব দেশ ও অঞ্চলকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তনিও গুতেরেস করোনাভাইরাস মহামারীর এই প্রলয়ঙ্করী সময়ে প্রথিবী ও বিশ্বব্যবস্থার পুর্নগঠনে আত্মনিয়োগ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী পুনর্গঠনের করোনা মহামারীকে কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দুইদিনের এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় গত মঙ্গলবার এন্তুনিও গুতেরেস জলবায়ু পরিবর্তনের মত বৈশ্বিক সংকট দূর করতে এবং আগামীতে শ্রেষ্ঠতর বিশ্ব গঠনে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বিশ্বনেতাদের একসঙ্গে কাজ করার উপর জোর দেন। সাহসী, স্বপ্নদর্শী ও সহযোগিতামূলক নেতৃত্ব ছাড়া এসব বৈশ্বিক সংকট দূর করে নতুন কাক্সিক্ষত পৃথিবী গঠণ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। যে সংকটে বিশ্বের সব মানুষ আক্রান্ত, যে মহামারী বিশ্বের সবচে পরাক্রমশালী জাতি সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন, তেমন একটি মহামারীর সময় ধনী-দরিদ্র সব মানুষ যখন এক অভূতপূর্ব আতঙ্কিত জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন এক সময়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই আহŸান বিশ্বমানবতায় বৈষম্য নিরসন, কল্যাণ ও সমদর্শী চিন্তার রূপরেখা প্রতিবিম্বিত হয়েছে বলে মনে হয়। করোনাভাইরাসের মত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসমুহও পুরো বিশ্বের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোনো একক দেশের পক্ষে করোনাভাইরাসের মহামারীর মত মহাদুর্যোগ বা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বক্তব্যে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে তা হচ্ছে, করোনা মহামারীতে বিশ্বের দেশে দেশে যে হাজার হাজার কোটি ডলার উদ্ধার তহবিলের নামে ব্যয় করা হচ্ছে, জনগণের রাজস্ব থেকে যে বিপুল ব্যয়বরাদ্দ করা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই ব্যয় হবে শিল্পকারখানা রক্ষায়। এখানে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহŸান হচ্ছে, যে সব মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিপুল দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানা বাতাস, পানি ও মাটির দূষণ ঘটিয়ে বিশ্বের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তণের মাধ্যমে বিশ্বকে বিপদসঙ্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, সেসব কারখানা রক্ষায় যেন এই অর্থ ব্যয়িত না হয়।
‘মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে, হারা শশির হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।’ জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের অতি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত চলমান করোনা মহামারীতে বিশ্বের ইতিবাচক পরিবর্তনের আলো দেখতে পাচ্ছেন। গত মাসের প্রথমদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর সাধারণ ছুটি, গণপরিবহন বন্ধসহ মানুষের চলাচল সীমিত করার পাশাপাশি সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা জারির পর আমার এক ছোটভাই ফেইসবুকে একটি ব্যানার পোস্টে লিখেছিল, ‘পৃথিবী মেরামতের কাজ চলছে, এখন সবাই ঘরে থাকুন’ যতটা স্মরণে আছে এমনই ছিল বক্তব্য। স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে, এই মহামারী ও ঘরে থাকার মধ্যে নিশ্চয় কোনো অঘোষিত কল্যাণ আছে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, বিশ্বের যে শহরের বাতাস সারাবছর সব সময় ধোঁয়া-ধূলিতে আচ্ছাদিত থাকতো, বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে বেইজিং, দিল্লীসহ বিভিন্ন শহরের নাগরিকদের মধ্যে নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি দিনের বেলায়ও সূর্যের আলোর স্বল্পতার কারণে ধূলিময় আকাশ ঘন কুয়াশায় রূপ নিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে, শহরের কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই প্রাইভেটকার ও গণপরিবহণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার মধ্য দিয়ে সেই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তনে সক্ষম হয়। এটি ছিল গত বছরের মাঝামাঝি সময়ের অবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বৈশ্বিক প্রস্তাবগুলো প্রধান প্রধান শিল্পোন্নত শক্তিগুলোর দ্বারা অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বারবার। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে যে সব প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল, তাতে কাবর্ন নি:সরণ কমিয়ে আনতে সাধারণভাবেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মুখাপেক্ষি হয়ে দাঁড়ায়। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কৌশলি ও গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে আসছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শুধু কিউটো প্রটোকল বা প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে মানতেই অস্বীকার করেননি, বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী, ক্লাইমেট এক্সপার্ট এবং দৃশ্যমান পরিবর্তন ও সম্ভাব্য সংকটের সব সাবধান বাণীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ক্লাইমেট চেঞ্জের ধারণাকে হোক্স বা ধাপ্পাবাজি বলে এক নতুন গুজবের জন্ম দেন। বিশ্বের প্রধান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংকটগুলো নিয়ে বিশ্বশক্তির মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া এবং অমিমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানের জন্য কৌশলগত আলোচনা ও শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব অমিমাংসিত ও বিতর্কিত ইস্যুর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো অঙ্গীকার অস্বীকার করে অনেক কিছুই এলোমেলো করে দিয়ে বিশ্বশান্তিকে নতুন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সাথে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা চুক্তি, আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের মার্কিন অঙ্গীকার ও মধ্যস্থতার ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে জায়নবাদি ইসরাইলের দখলবাজির পক্ষে প্রকাশ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মত ঘটনা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৃষ্টি।
আমেরিকা ফার্স্ট শ্লোগানকে সামনে রেখে মূলত একটি বর্ণবাদী অবস্থান থেকেই ডোণাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনী জনসভাগুলোতে ট্রাম্প যখন অভিবাসন বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, সেসব বক্তব্য সাদা চামড়ার কনজারভেটিভ মার্কিনীদের যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করে ভোটের মাঠে কিছুটা হলেও মজবুত ভিত্তি নির্মানে সক্ষম হয়েছিল। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ মিডিয়া জরিপ ও এক্সিটপোল জরিপে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনই এগিয়ে ছিল। সেসব জরিপ ও মাঠের বাস্তবতার বিপরীতে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে যে শুভঙ্করের ফাঁক সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে সৃষ্ট কনস্পিরেসি থিউরিকে কেউ কেউ ‘রাশিয়া গেট স্ক্যান্ডাল’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ হিলারি ক্লিন্টনকে হারাতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়া গোয়েন্দা হস্তক্ষেপ করেছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত শত শহরে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের দুইশ বছরের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগানধারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেট দল থেকে ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রতিদ্ব›দ্বী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমেই নিম্মমুখী। গত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আবারো শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, নাকি রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলো ধসিয়ে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এম্পায়ারকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছেন আগামী ভোটের ফলাফলের মধ্য দিয়ে মার্কিন জনগণ তারই রায় দিবেন। তবে মার্কিন নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও ফলাফল এখন শুধুমাত্র মার্কিন জনগণের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে কিনা, নাকি কর্পোরেট মিডিয়া, জায়নবাদি লবি ও থিঙ্কট্যাঙ্ক এবং রাশিয়া বা চীনের গোপণ হস্তক্ষেপের প্রভাব থাকে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিগত নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের আনুকুল্য পাওয়ার অভিযুক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী নির্বাচনে জো বাইডেনের পক্ষে চীনের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
করোনা মহামারী পুরো বিশ্বকে আক্রান্ত করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি এক অভাবনীয় কঠিন পরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বিশাল যুদ্ধব্যয় বহন করতে গিয়ে এমনিতেই বিশ্বের একনম্বর অর্থনৈতিক শক্তির ভেতরটা ফোঁকলা হয়ে গেছে। বিগত দশকের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার উপর এখনকার করোনা মহামারীতে মার্কিন অর্থনীতি দেউলিয়া হতে বসেছে। ইতিপূর্বে মন্দার সময় যে হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম নেয়া হয়েছিল তাতে কিছু সংখ্যক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও মার্কিন করদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাত সঙ্কুচিত হয়েছে। চলমান করোনাভাইরাস মহামারীর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে যে দৈন্যদশা প্রকাশ পেয়েছে তা অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়েও নি¤œমানের। করোনাভাইরাস মহামারী রোধে চীনের পর ইরান, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, কিউবা, থাইল্যান্ড যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নি:সন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের চেয়ে অগ্রসর ও কার্যকর বলে প্রমানীত হয়েছে। তবে করোনা মহামারী বেইল-আউটের নামে ইতিমধ্যেই তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শিল্প ও কর্মসংস্থান রক্ষার নামে এই বিপুল পরিমান অর্থের বেশিরভাগ আবারো কতিপয় কপোর্রেট জায়ান্টের তহবিলে জমা হবে। ইউরোপের দেশগুলোর পক্ষ থেকেও কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের বেইলআউট তহবিলের যেসব ঘোষণা এসেছে সামাজিক নিরাপত্তা খাত বাদ দিলে একইভাবে এসব অর্থের বেশিরভাগ শিল্প রক্ষার নামে গতানুগতিক দূষণের জন্য দায়ী পুরনো কলকারখানাগুলোর পেছনে ব্যয় করা হবে। জনগণের রাজস্ব থেকে ব্যয় করা বিশালাকার উদ্ধার তহবিল যেন বাতাস, পানি , মাটি ও ভূ-প্রকৃতিতে দূষণ সৃষ্টিকারী এবং বিশ্বের উষ্ণায়ণের জন্য দায়ী পুরনো কারখানাগুলোর পেছনে ব্যয় করা না হয় সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
করোনা মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ভাঙ্গা-গড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে পাশাপাশি অনেক হতাশাব্যঞ্জক ও আশা জাগানিয়া বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রধান বাজার সউদি আরব, আরব আমিরাত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খারাপ খবর পাওয়া যাচ্ছে। সউদী আরব থেকে ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিকের দেশে ফেরত আসার আলামত দেখা যাচ্ছে। করোনা মহামারীর সময়েও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধরপাকড়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে। অন্্যদিকে অর্থনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের জরিপ প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা মহামারীর প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের মধ্যেও বিশ্বের ৬৬টি শক্ত অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশ শীর্ষ দশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। চীনের অবস্থান ১০ নম্বর হলেও ভারতের অবস্থান তালিকার ১৮ নম্বরে। জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারের ঋণ, বৈদেশিক ঋণ, ঋণের সুদ এবং ফরেক্স রির্জাভ অনুসারে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা যায়। এসব দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুবই শোচনীয় হওয়ার কথা। সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে দেয়া বক্তৃতায় অ্যারিজোনা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান এন্ডি বিগ্স আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণের পরিমান ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যা মার্কিন মোট জিডিপির প্রায় দেড়গুণ। গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত মার্কিন জাতীয় ঋণ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি অনুপাতে জাতীয় ঋণের হার ছিল ১০৫.১৭ভাগ। একই সময়ে বৃটেন এবং ফ্রান্সের জাতীয় ঋণের পরিমানও জিডিপি’র শতভাগের কাছাকাছি ছিল। গত তিন বছর এবং চলতি করোনা মহামারীর লক-ডাউনে ধসে পড়া অর্থনীতির তাÐবে তা হয়তো ইতিমধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতি ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। পাশাপাশি পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে অনৈক্য অসহযোগিতা এবং ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের করদাতা সাধারণ নাগরিকরা। করোনা পরিস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অনৈক্য নিয়ে আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্বের আসনে থাকা পশ্চিমাদের পক্ষে হয়তো আর সম্ভব হবে না।
লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত নেতা ঐক্য ও সহযোগিতার বদলে এখনো বেøইম গেম ও কনস্পিরেসি থিউরি আওড়ে চলেছেন। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং বিপর্যস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে বিশ্বনেতাদের ঐক্য, সহযোগিতা ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এন্তনিও গুতেরেস যে স্বপ্নদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বের কথা বলেছেন, তা পশ্চিমা বিশ্বে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায়ও বাংলাদেশের যে অবস্থানের কথা দ্য ইকোনমিস্টের জরিপে উঠে এসেছে তাতে আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থা পুনর্গঠনের বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান থাকার কথা ছিল। কিস্তু করোনা মহামারী মোকাবিলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সব টানপোড়েন ও আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতার প্রকাশ ঘটেছে, তাতে সে সম্ভাবনা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। করোনা মহামারীতে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সমাজবাস্তবতার মধ্যে এক ভয়াবহ অবক্ষয় ও ভঙ্গুরতার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার রোগীদের উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ, মৃত রোগীকে আত্মীয় পরিজনদের পরিত্যাগ করার বেশ কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। করোনাকালে কর্মহীন লাখ লাখ মানুষ যখন অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন একশ্রেণীর জনপ্রতিনিধি দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত চাল-ডাল, তেল-লবন চুরিতে বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এর বিপরীত দৃশ্যও আছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের একজন ওর্য়াড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণই করা হয়নি, তারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে করোনাভাইরাসে মৃত রোগীদের সৎকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাহসী সমাজসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থ্াপন করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আরো অনেক ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। শত শত পুলিশ সদস্য এবং ডাক্তার করোনা যুদ্ধে সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তহীনতা, দীর্ঘসুত্রিতা ও দুর্নীতির কারণে করোনা মহামারী মোকাবিলায় প্রথম সারির যোদ্ধারা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে মানহীন মাস্ক, পিপিই ও চিকিৎসা সরঞ্জামের কারণে অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাস সংক্রমনের শিকার হয়েছেন। দেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতে দীর্ঘদিন ধরে পুকুর চুরির ধারাবাহিক তৎপরতারই খÐচিত্র এসব। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ইতিমধ্যে করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক উদ্ধারে হাজার কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণ্ াকরেছে সরকার। এই তহবিলের সদ্ব্যবহার নিয়ে এরই মধ্যে নাগরিক সমাজে অনাস্থা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর ড. সালেহ উদ্দিন সরকারের প্রণোদনা বরাদ্দ শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক ধনী ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করবে। করোনা লক-ডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতির আজকের এই বিপর্যয়ের জন্য এমন কোটারি স্বার্থের তৎপরতাই দায়ী। কর্পোরেট পুঁজিতাস্ত্রিক ব্যবস্থার পরির্বতন ছাড়া মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলা অসম্ভব।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন