শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বালা-মুসিবত, তাওবা-ইস্তিগ্ফার ও দোয়া-মোনাজাত

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দোয়া-প্রার্থনা আমাদের উত্তরাধিকার। আদিপিতা হযরত আদম আ. আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে দোয়া ও মোনাজাত করেছেন। বলেছেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব’। সূরা আরাফ: ২৩। এভাবে সকল নবী রাসূল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করেছেন। আমরা তার মধ্যে থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃত করছি। যেমন হযরত নূহ (আ.) দোয়া করেছেন, হে আমার প্রতিপালক আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার পিতা-মাতা এবং যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে এবং সকল মোমেন নর-নারীকে ক্ষমা করুন। সূরা নূহ: ২৮।
হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আল্লাহর সমীপে পেশ করা অনেক দোয়া পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে কয়েকটি এরূপ:
তিনি মক্বা নগরীর নিরাপত্তা এবং তার মুমিন অধিবাসীদের জন্য জীবিকার ফরিয়াদ জানিয়ে দোয়া করেন: ‘হে আমার রব! আপনি মক্বাকে নিরাপদ শহর করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদেরকে ফল-মূল জীবিকা প্রদান করুন।’ সূরা বাকারাহ: ১২৬।
প্রবল প্রতাবান্বিত জালিম বাদশা নমরুদ হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে পুড়িয়ে মারার জন্য ভীষণ অনল কুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল। তাঁর ঈমান ও আত্মবিশ্বাসের শক্তি দেখে মহান আল্লাহ সেই ভয়াল অগ্নিকুন্ডকে কুসুম কাননের মতো শান্তিপূর্ণ ও আরামদায়ক করে দিয়েছিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা সীমাহীন। তিনি সে দিন যেমন ইবরাহীমের জন্য ভয়াল অগ্নিকুন্ডকে ফুলবাগিচায় পরিণত করেছিলেন, তেমনি তিনি আজও করোনাভাইরাসের এই গজব থেকে আমাদেরকে মুহূর্তেই রক্ষা করতে পারেন। কবি আল্লামা ইকবাল বলেন: ‘আগার হো ফেঁর ইবরাহীমকা ঈমান পয়দা/আগ কর সিকতি হায় ফেঁরা গুলিস্তান পয়দা।’ ‘আজও যদি পয়দা হয় ইবরাহীমি ঈমান তেমন/নিমিষে এ অগ্নিকান্ড হয়ে যাবে কুসুম কানন।’
হযরত মূসা (আ.) হস্ত দারাজ করে দোয়া করলেন: ‘রাব্বি নাজ্বিনি মিনাল কাউমিজ জলিমিন।’ সূরা কাসাস: ২১। অর্থাৎ ‘হে আমার রব! আপনি জালিম সম্প্রদায় থেকে আমাকে রক্ষা করুন।’ ইতিহাস সাক্ষ্য, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করলেন এবং ফিরাউনকে সদলবলে ধ্বংস করে দিয়ে তার কবল থেকে মূসা (আ.) ও তাঁর কওমকে রক্ষা করলেন।
এক সুবিশাল মাছ হযরত ইউনূস (আ.)-কে গ্রাস করল। তিনি মাছের পেটে বসে পাঠ করলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলিমিন’। সূরা আম্বিয়া: ৮৭। অর্থাৎ (হে রব) আপনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই; আপনি পবিত্র মহান! আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহ তার কাতর মিনতি শুনলেন এবং তাঁকে উদ্ধার করলেন। আল্লাহর ভাষায়: ‘ফাস্তাযাবনা লাহু ওয়া নাজ্জাইনাহু মিনাল গাম্মি ওয়া কাজালিকা নুনজীল মু’মিনিন।’ (আল্লাহ বলেন) তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা হতে এবং এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। সূরা আম্বিয়া: ৮৮।
মোট কথা, আল্লাহ তাঁর নিকট দোয়া ও মোনাজাত করার আহবান করেছেন, নিজে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। আদম (আ.) থেকে সব নবী রাসূল নিজেরা দোয়া মোনাজাত করেছেন, তাদের উম্মতদের দোয়া করার উপদেশ দিয়েছেন। দোয়া-মোনাজাত প্রার্থনা সকল যুগে সব নেক লোকেরা করে এসেছেন, করতে থাকবেন। তবে এক শ্রেণির পথভ্রষ্ট, বিকৃত, ঘোর অদিষ্টবাদী লোক আগেও বলেছে এবং এখনও বলে, তকদিরে যা আছে তা তো হবেই, কোনো চেষ্টা-তদবির, দোয়া-মোনাজাত দ্বারা ভাগ্য বদলাবে না। আর একদল বলেছে, তকদির বলতে কিছুই নেই, সব হয় মানুষের চেষ্টা দ্বারা। পরস্পরবিরোধী এ দু’দলই ভ্রান্ত। ইসলামী দর্শনের কিতাব থেকে (আকায়েদ) এদের মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এদের মধ্যে যারা ঘোর অদিষ্টবাদী তাদের নাম ‘জাবারিয়া’। আর যারা বলে মানুষের কাজের সর্বময় কর্তা মানুষ নিজেই, তকদির বলতে কিছুই নেই তাদের নাম ‘কাদারিয়া’। উভয় দলেরই অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। যারা বলে মানুষের কর্মের কোনোই ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা নেই, তারা অবশ্যই ভ্রান্ত। আমাদের দেশেও তাদের অস্তিত্ব আছে। গানের সুরে সুরে তারা বলে : ‘ছায়াকফি পুতুল সম বানাইয়া মানুষ/যেমনি নাচাও তেমনি নাচে পুতুলের কি দোষ’। মানুষকে আল্লাহপাক জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন, শারীরিক শক্তি-সামর্থ দিয়েছেন, আর তা ব্যবহারের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি ও কর্মশক্তি দান করেছেন। তবে তা নিরঙ্কুশ নয়। যেমন আমরা দাঁড়িয়ে নিজ ইচ্ছায় একটি পা তুলতে পারি কিন্তু সে পা-টি জমিনে না রেখে আর একটি পা উপরে তুলতে পারি না। একই সাথে দু’টি পা উপরে তুলতে পারি না। হঠাৎ লাফিয়ে উপরে উঠতে পারি বটে, কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্যই শুধু, আবার নিচের জমিনে পড়ে যেতে হয়। মানুষকে এই সীমিত স্বাধীন শক্তি দিয়েছে বলেই তার উপরে হুকুম-আহকাম।
তকদির সত্য, তার সাথে তদবিরের ইখতিয়ারও দেয়া হয়েছে মানুষকে। আমাদের কাছে কাল তিনটা। আল্লাহপাকের কাছে কাল একটা, শুধু বর্তমান। আল্লাহর অনাদি অনন্তকালে রয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা কী করব। আর তিনি তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন- তাই এর তকদির। লিপিবদ্ধ তাই আমরা করছি, তা নয়, বরং আমরা যা করব তা তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন এবং তা-ই লিখে রেখেছেন। কেউ কেউ ব্যাপারটা এভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞ শিক্ষক, ছাত্রটি প্রত্যক্ষ করেই বুঝতে পারলেন যে, এ ছাত্র পরীক্ষায় পাস করতে পারবেন না, তাই তিনি গুপ্তভাবে লিখে রাখলেন যে, এ ফেল করবে। বছর শেষে পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল সে ফেল করেছে। তাই এ কথা বলা যাবে না যে, শিক্ষক লিখে রেখেছিলেন বলেই ছাত্রটি ফেল করেছে বরং এটা বলাই সঙ্গত যে, ছাত্রটির অমনোযোগিতা এবং অবহেলাই ফেল করার কারণ। তাই এ কথা বলা ঠিক নয় যে, তকদিরে যা লিখা আছে তা-ই তো হবে, দোয়া করে আর কি হবে, দোয়া করার আহবান তো আল্লাই জানিয়েছেন এবং দোয়া শিখিয়েও দিয়েছেন।
তকদির দু’রকম হতে পারে, মোবরাম ও মোয়াল্লাক। অপরিবর্তনীয় ও পরিবর্তনীয়। যা পরিবর্তনীয় তা শর্ত সাপেক্ষে। যদি রোগীটির উপযুক্ত চিকিৎসা করা হয় তবে তার রোগ আরগ্য হবে, যদি ছাত্রটি ভালভাবে পড়াশোনা করে তবে পাস করবে। আমাদের জানা নেই কোনটি মোবরাম আর কোনটি মোয়াল্লাক। তাই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। তাওবা, দোয়া-মোনাজাত অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহই তো বলেছেন: ‘উদউনী আস্তাজিব লাকুম’ ‘তোমরা আমাকে ডাক আমি সাড়া দেব’। তিনিই তো বলেছেন, ‘লা-তাকনাতু মির রহমাতিল্লাহ- তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে না।’
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি দোয়া করে, যে দোয়াতে কোন রূপ গুনাহ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় না থাকে তখন আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে তার দোয়া কবুল করেন।
(১) যেই দোয়া করেছে তা তাৎক্ষণিক কবুল করে নেন, (২) অথবা তার দোয়া আর প্রতিদান আখেরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন, (৩) কিংবা দোয়ার মাধ্যমে তার কোনো কষ্ট বা বিপদ দূর করে দেন। সাহাবীগণ বললেন, আমরা যখন বেশি বেশি দোয়া করব (তখন কি এ রূপ প্রতিদান দেয়া হবে?) নবী (সা.) বললেন, আল্লাহ তো বেশি দানকারী। (তিরমিযি)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে উত্তম কোনো ইবাদত নেই’ (তিরমিযি)। হযরত সাওবান (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল্লাহ (সা.) বলেছেন, দোয়া ছাড়া কোনো কিছু তকদিরকে পরিবর্তন করতে পারে না এবং সৎ আমল ছাড়া কোনো কিছুই হায়াত বৃদ্ধি করতে পারে না। (মুস্তাদরাকে হাকিম)।
হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: নিশ্চয়ই দোয়া বর্তমান বিপাদাপত এবং ঐ মুসিবতের ক্ষেত্রেও উপকারী যা এখানো আপতিত হয়নি। অতএব, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা দোয়ার গুরুত্ব অনুধাবন কর।’ (তিরমিযি)।
হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি বিষয় বলে দেব না, যা তোমাদেরকে তোমাদের শত্রু দের হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তোমাদের রিজিক বৃদ্ধি করবে? আর তা হচ্ছে- তোমরা দিন ও রাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকবে। কারণ দোয়া মুমিনের অস্ত্র সমতুল্য। (মুসানাদে আবু ইয়ালা)।
দোয়ার আদব হচ্ছে- একমাত্র আল্লাহর কাছেই দোয়া করা; নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন এমন বিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়তার সাথে দোয়া করা; বিনয় ও একাগ্রতার সাথে দোয়া করা, দোয়ার পূর্বে আল্লাহ প্রশংসা ও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ পড়া; সমস্ত পাপ ও অপরাধ থেকে খালিস তাওবা করা, নেক আমলের উসিলা দিয়ে দোয়া করা; বার বার দোয়া করা, দোয়ার শেষে আমীন বলা।
সমগ্র পৃথিবী আজ করোনাভাইরাসের মহামারীতে আক্রান্ত। কোনো বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিহত করা যাচ্ছে না এ মহামারী। জীবন হারাচ্ছে- লাখ লাখ মানুষ, আক্রান্ত হচ্ছে- আরও অগণিত মানুষ। যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সবচেয়ে উন্নত সেসব দেশে এর প্রকোপ আরও বেশি। এমমাত্র আল্লাহই দূর করতে পারেন এই বালা। আসুন, আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তন করি তাঁর শরণাপন্ন হই, খালেস তওবা করি, মাফ চাই এবং একনিষ্ঠভাবে সবিনয়ে তাঁর দরবারে দোয়া-মোনাজাত করতে থাকি।
‘রাব্বানা, শোনা শোনো মোদের মোনাজাত
যদি ভুল করি- ভুলি যেও চাই যে মাগ্ফিরাত’
আগের দিনের লোকেরা তোমার
বহন করেছে যেই গুরুভার
সে ভার মোদের মাথায় আবার দিওনা হে পাক-জাত।
দিওনা সে ভার- যে ভার বহিতে শক্তি মোদের নাই
কমজোর মোরা-মাফ করো তুমি তোমার করুণা চাই।
তুমি আমাদের মাওলা হে প্রভু
এই কথা যেন ভুলি নাকো কভু
কুফ্রী হইতে বাঁচাও মোদের-ধরো আমাদের হাত।
সূরা বাকারা. ২৮৬। কাব্যনুবাদ : গোলাম মোস্তাফা।
[সমাপ্ত]

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন