শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাকালে নিষ্ঠুরতা বনাম নৈতিকতা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

করোনাভাইরাস শনাক্ত ও করোনা উপসর্গে মৃত্যুর সংখ্যা গোটা বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে বেড়ে চলার সংবাদে দেশবাসী যেমন আতঙ্কিত, পাশাপাশি ইউপি চেয়ারম্যান, সরকারি ডিলার, ক্ষমতাবান নেতা, পাতি নেতাদের ত্রাণের চালসহ সামগ্রী চুরির সংবাদ মানুষকে করেছে ক্ষুব্ধ ও বীতশ্রদ্ধ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ডাক্তারদের দায়িত্বে অবহেলার সংবাদে অনেকেই হতাশ। অন্যদিকে গত ২১ এপ্রিল একটি সংবাদ দেশবাসীকে করেছে উৎফুল্ল। আশার সঞ্চার হয়েছে এই ভেবে যে, এ দেশে শুধু নরপশু বাস করে না, বরং সংখ্যায় কম হলেও মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেকসম্পন্ন কিছু মানুষেরও জন্ম দেশে হয়েছে।
সংবাদটি নিম্নরূপ: ‘শেরপুর জেলাধীন ঝিনাইগাতী উপজেলার নাজিম উদ্দিন নামে একজন ভিক্ষুক করোনাভাইরাসের কারণে বন্দি হওয়া কর্মহীন মানুষের খাদ্য সহায়তার জন্য ভিক্ষা করে জমানো ১০ হাজার টাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবেল মাহমুদের হাতে তুলে দিয়েছেন।’ সংবাদটি কেউ হয়তো মনে রাখবে বা রাখবে না, অথবা কেউ গুরুত্ব দেবে বা দেবে না। তবুও বলতে চাই, মানবতা, নৈতিকতা ও সভ্যতার স্বার্থে এটা সমাজে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার জন্য এ ধরনের সংবাদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক। একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির ভিক্ষা করে উপার্জিত ১০ হাজার টাকা ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য দান করার বিষয়কে খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। পুঁজিপতিরা যেখানে দেশ লুটে খাচ্ছে, ভূমিদস্যুরা সরকারি মদদে কৃষিজমি গিলে খাচ্ছে, ভোট ছাড়া নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানরা ত্রাণের চাল চুরি করছে, সেখানে একজন ভিক্ষুক ভিক্ষা করে জমানো টাকা ত্রাণের জন্য তুলে দেয়ার ঘটনা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
একটি যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য নবী করিম সা. সাহাবিদের সাহায্য কামনা করলে হজরত আবু বকর রা.-এর কাছে যা কিছু ছিল, সবই নবী সা.-এর যুদ্ধ তহবিলে দান করেছিলেন, যা ছিল পরিমাণে অন্য সাহাবিদের সাহায্যের তুলনায় অনেক কম। তথাপি নবী সা. তার দানকেই সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কারণ তিনি তার সর্বস্ব দান করেছিলেন, নিজের জন্য কোনো সম্পদ রাখেননি। ১৯৭২-৭৩ সালে মুসলিম মোল্লা ওরফে কানাই ফকির নামে একজন হতদরিদ্র ব্যক্তি তিলে তিলে জমানো টাকা এবং পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার বাড়ইভোগ বটতলা এলাকায় দুটি কাঠের পুল ও একটি মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন। পুলগুলো এখন পাকা, কিন্তু জনগণ কানাই ফকিরের পুল নামেই চেনে। মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বাইতুল মুসলিম জামে মসজিদ’। তার দান করা ৩৯ শতাংশ জমির ওপর বাঁশের বেড়া দিয়ে মসজিদটি চালু হয়েছিল। জনগণ পাকা করে মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন করেছে। সম্পদশালী ব্যক্তির সম্পদের দিকে তাকিয়ে তার মানবিক গুণাবলি বিবেচনা করা যায় না। বিবেচনায় নিতে হবে একজন মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে, ব্যক্তিটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে যত ‘ক্ষুদ্র বা নিম্ন’ অবস্থানের হোক না কেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতির মূল শত্রু হচ্ছে, চালচোর, মজুদদার ও মুনাফাখোর। ‘দেশে খাদ্যঘাটতি’ নেই বলে সরকার বারবার ঘোষণা দিচ্ছে। যদি খাদ্যঘাটতি না থাকে, তবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে কেন? সরকার ও প্রশাসন জাতীয় শত্রুদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতা দুর্ভিক্ষ ডেকে আনতে পারে। একবার যদি ভূখামিছিল শুরু হয়ে যায়, তা ঠেকানো সরকারের জন্য কঠিন হবে। এমনিতেই বর্তমান ‘সরকার অনির্বাচিত’ অভিযোগে অভিযুক্ত, তদুপরি জাতীয় শত্রুদের কবল থেকে গণমানুষকে যদি রক্ষা করতে না পারে তবে দুর্নাম ও ব্যর্থতার প্রশ্নে এটা হবে ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’। তাই মন্ত্রীরা যতই বাগাড়ম্বর করুন না কেন, প্রধানমন্ত্রীকে হতে হবে আরো আরো সতর্ক ও দূরদর্শী।
অর্ধমৃত অবস্থায় শিশুসন্তানসহ সাগর থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধারের চিত্র যখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়, জীবিকার অন্বেষণে কাঠের নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে যখন সাগরে সলিল সমাধি ঘটে, এখনো ৫০০ রোহিঙ্গা কোথাও তীরে উঠতে না পেরে সমুদ্রে ভাসার সংবাদ যখন চাউর হতে থাকে, তখন মনে হয়, আধুনিক এ যুগে বর্বর শাসকদের হাতে বিশ্বসভ্যতা আজ বন্দি ও বিপন্ন। এটাই অনস্বীকার্য সত্য যে, বিশ্ব নিয়ন্ত্রকদের কাছে মানবতা বলতে কিছুই নেই, যা আছে কাগজ-কলমে। তা শুধু ফরমায়েশি বক্তৃতার কোটেশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গোটা বিশ্বে মিয়ানমারের বৌদ্ধরা চরম অসভ্য জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বশাসকরা (ক্ষুদ্র গাম্বিয়া ব্যতীত) কার্যত কোনো ভূমিকা না রেখে শুধু বিবৃতি দিয়েই তাদের দায় চুকিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে গণহত্যার বীজ শাসকরা রোপণ করেছে, শাসকরাই জনগণের রক্তে হোলি খেলেছে। সব শাসকের চরিত্র এক ও অভিন্ন। আসলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।
নারায়ণগঞ্জের স্বনামধন্য ও সম্পদশালী পরিবারের একজন মুরব্বি দীর্ঘদিন ঐতিহ্যবাহী ও প্রসিদ্ধ দেওভোগ সিনিয়র কওমি মাদরাসার সভাপতি, যিনি দীর্ঘকাল মসজিদ ও স্কুল পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই ইদ্রিস আলীর গত ২৫ এপ্রিল শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তখন পরিবারের লোকজন রাজধানী অ্যাপোলো ও ইউনাইটেডসহ অনেক হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করলেও কোনো হাসপাতাল তাকে ভর্তি করেনি। অনেক হাসপাতাল ঘুরে হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তাকে শুধু আইসিইউতে ঢুকিয়ে রাখে, কোনো ডাক্তার তার কাছে যাননি, বিনাচিকিৎসায় ভোররাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মুখে মাস্ক পরে বাসায় বসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যত কথাই বলুন না কেন, প্রকৃত ব্যাপার এই যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যপ্রশাসন ভেঙে পড়েছে। কিছু ডাক্তার একপ্রকার কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ, এমন মন্তব্য হাইকোর্ট একবার করেছিলেন। এ সব অমানবিক ও নির্মম সংবাদ দেখে একজন মানুষ হিসেবে নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার জন্মে, তখন কিছু সংবাদ আশার সঞ্চার করে।
যেমন: লকডাউনের কারণে ক্ষেতমজুর না পাওয়ায় ধান কাটার জন্য কৃষক পরিবারকে স্বেচ্ছাশ্রমে সাহায্য করার জন্য ছাত্রসহ বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে এসেছে। নিন্দুকেরা বলতে পারেন, এটা এক ধরনের ফটোসেশন। কিন্তু আমি বলব, এটা মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহায্য করেছে। এ দুঃসময়ে বাঁচার জন্য সবারই সহযোগিতা ও সহানুভূতিশীল ভূমিকা থাকা দরকার। কবির ভাষায় ‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ নীতি অবলম্বনে অগ্রসর হতে হবে। দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে এগোতে হবে, যাতে করে সম্ভাবনার দরজা বন্ধ না হয়। সচ্ছল-অসচ্ছল সবাই এগিয়ে আসবেন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এবং এটাই বর্তমান সময়ের দাবি। আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এক না হওয়ার কারণে দেশে শ্রেণিবৈষম্য আকাশ-পাতাল সাদৃশ্য। একই গ্রামে একজন ৫০০ বিঘা জমির মালিক। অন্য দিকে, বাকিরা দিনমজুরি করে চলতে পারছে না। কারো স্ত্রীর লিপস্টিকের খরচের টাকায় একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার বোঝার উপশম হতে পারে।
কিন্তু সেই বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণেই দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন চরম আকার ধারণ করেছে। গোটা দেশের সম্পদ একটি লুটেরা গোষ্ঠির হাতে বন্দি। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র এটা ছিল না। সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবিতেই স্বাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত। তখন স্লােগান ছিল ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না’। এখন স্লােগান হোক, ‘আমরা কাউকে না খেয়ে মরতে দেবো না, করোনাকে প্রতিরোধ করব সম্মিলিতভাবে, একত্রিত হয়ে, ইনশাআল্লাহ।’
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ ১১ মে, ২০২০, ৬:০৭ পিএম says : 0
মাশাআল্লাহ। চমৎকার লেখা। আল্লাহ বরকত দান করুন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন