শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রমজানে দুই সুহৃদের মৃত্যুতে মহানবী (সা:) শোকবর্ষ ঘোষণা করেন

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এ প্রসঙ্গে ইবনে আসাকের বর্ণনা করেন, আমি একবার মক্কায় গমন করি, মক্কাবাসীরা দুর্ভিক্ষের শিকার ছিল্ তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি বলল, ‘সবাই চল লাত-উজ্জার নিকট।’ অপর একজন বলল, ‘মানাতে মূর্তির নিকট চল।’ তাদের এ কথা শুনে একজন সুদর্শন বিজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, ‘উল্টো দিকে তোমরা কোথায় যাচ্ছ! অথচ আমাদের মাঝে ইবরাহীমের ও ইসমাঈলের বংশধর রয়েছেন।’ একজন বলল, ‘আপনি কি আবু তালেবের কথা বলছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তার কথাই বলছি।’ তখন ওরা সবাই উঠে পড়ে, আমিও তাদের সঙ্গী হলাম। সবাই তাঁর (আবু তালেবের) দরজায় আঘাত করি। আবু তালেব বের হয়ে এলে সবাই বলতে থাকেন, ‘আবু তালেব! জঙ্গল দুর্ভিক্ষকবলিত হয়ে পড়েছে, আমাদের নারী-পুরুষ সবাই দুর্ভিক্ষে পতিত, চল পানি চাই।’ অতঃপর আবু তালেব বের হন, তার সাথে একটি বালকও ছিল, যেন সূর্য। যাতে হালকা কালো মেঘ দূর হয়ে যায়। তার পাশে আরো কতিপয় বালকও ছিল। আবু তালেব ঐ ছেলেটিকে সাথে রাখেন এবং তাঁর পৃষ্ঠদেশ কাবার সাথে ঠেকান। ছেলেটি (রাসূলুল্লাহ সা.) প্রার্থনাকারীর মতো করে নিজের আঙ্গুল দ্বারা আসমানের দিকে ইশারা করা মাত্র চতুর্দিক থেকে মেঘ জমা হতে থাকে অথচ তখন পর্যন্ত আকাশে একখন্ড মেঘও ছিল না। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। জঙ্গল পানিতে সয়লাব হয়ে যায় এবং জনপদ সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে। এই ঘটনা সম্পর্কে খাজা আবু তালেব একটি বিখ্যাত কাসিদা রচনা করেছিলেন, যা সীরাতে ইবনে হিশামে উদ্ধৃত হয়েছে। তার একটি কবিতার অর্থ হচ্ছে, ‘এবং গোরা (সাদা) রঙের যেসব লোক যাদের ওসিলায় বৃষ্টি তলব করা হয়। এতিম অনাথদের আশ্রয়দাতা, বিধবাদের নিরাপত্তা দানকারী।’
নুবওয়াত লাভের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যখন কোরেশরা অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে তখন আবু তালেব এ কবিতায় কোরেশদের স্মরণ করিয়ে দেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শৈশব জীবনের অবদানের কথা। তিনি তাদের বুঝাতে চান, এরূপ সৌভাগ্যবান উপকারীর ওপর যেন তারা অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতে বিরত থাকে। আবু তালেব ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। ব্যবসা উপলক্ষে তিনি নানা দেশে গমন করতেন। এ উপলক্ষে তিনি শাম (সিরিয়া) গমন করেন। তখন প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ (সা.) কে সঙ্গে নিয়ে যান, তখন তাঁর বয়স বার বছর দুই মাস। ‘তাইমা’ নামক স্থানে পৌঁছলে সেখানে ‘বোহায়রা’ নামক এক রাহেবের (পাদ্রী) সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি একজন ইহুদি অথবা খ্রিস্টান আলেম ছিলেন। তিনি প্রাচীন গ্রন্থাবলীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মোহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে নবুওয়াতের বিভিন্ন আলামত দেখতে পান। তিনি খাজা আবু তালেবকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার সাথে এই ছেলে কে?’ আবু তালেব পরিচয় দিলেন, ‘আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।’ বোহায়রা বললেন, ‘আমি আপনাকে একটি কথা জানিয়ে দিতে চাই এবং তা এই যে, আপনি একে (এই ছেলেকে) নিয়ে সিরিয়া গমন করলে ইহুদিরা তার শত্রু হয়ে যাবে এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হবে। আপনি তাকে নিয়ে প্রত্যাবর্তণ করুন।’ অপর বর্ণনানুযায়ী একজন গোলামের মারফত তাকে স্বদেশে পাঠিয়ে দেন। আবু তালেবের সিরিয়া গমনের ঘটনাটি কিছুটা ভিন্ন রকমেও বর্ণিত হয়েছে। খাজা আবু তালেব যখন সিরিয়া গমনের ইচ্ছা পোষণ করেন তখন সফর-কষ্ট বা অন্য যে কারণেই হোক রাসূলুল্লাহ (সা.) কে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে চাননি, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে লেপটে ধরেন তিনিও সঙ্গে যাবেন। আবু তালেব তাঁর প্রতি এত দয়ালু ছিলেন যে, তাঁর আবদার উপেক্ষা করতে পারলেন না, তাঁকেও সঙ্গে নিয়ে যান। বোহায়রার সাথে সাক্ষাৎ এ সফরের ঘটনা। এ বণর্না অনুাযায়ী আবু তালেব যখন ‘বসরা’ পৌঁছেন তখন একজন খ্রিস্টান পাদ্রীর খানকাহের কাছে অবতরণ করেন, যার নাম ছিল বোহায়রা। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে দেখে বললেন, ‘ইনি সাইয়িদুল মোরসালীন।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কীভাবে জানলেন?’ তিনি বললেন, ‘যখন তোমরা পর্বত হতে অবতরণ করছিলে তখন গাছ, পাথর যত ছিল, সবাই তাকে সেজদা করার জন্য ঝুঁকে পড়েছিল।’ ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ ঘটনার প্রতি সাধারণ মুসলমানদের যত আকর্ষণ, আগ্রহ থাকার কথা, বিস্ময়ের ব্যাপর হচ্ছে, এর প্রতি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ খ্রিস্টানদের, তারা এ ঘটনাকে খ্রিস্টানদের মহান বিজয় বলে মহাখুশী এবং দাবী করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মজহাবের সমস্ত তত্ত্ব ও গূঢ় রহস্য সেই খ্রিস্টান রাহেবের (পাদ্রী) কাছ থেকে শিখেছেন এবং তিনি (রাহেব) যেমন সূক্ষ্ম বিষয় বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সেগুলোর উপর ইসলামী আকায়েদের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ইসলামের সমস্ত উত্তম নীতি এসব সূক্ষ্ম বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সীরাতুন নবী’-এর বিজ্ঞ লেখক এ সম্পর্কে বলেন, ‘খ্রিস্টান লেখকগণ যদি এ বর্ণনাকে সঠিক মনে করেন তাহলে এমনিভাবে মানা উচিত যেভাবে রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণিত ঘটনায় বোহায়রার শিক্ষার কথা কোথাও উল্লেখ নেই। ধারণাও করা যায় না যে, দশ-বার বছরের বয়স্ক বালককে ধর্মের সকল সূক্ষ্ম বিষয় শিখিয়ে দেয়া হবে। আর যদি এটি কোন অস্বাভাবিক-অলৌকিক ঘটনা হয়ে থাকে তা বোহায়রার কষ্ট স্বীকারের কি প্রয়োজন ছিল?’ (১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৯) লেখক আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.), খ্রিস্টান লেখক স্যার উইলিয়াম মিয়ূর ড্রিপার এবং মারগুলিয়াসের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি তাদের ভিত্তিহীন দাবি খন্ডনে বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের বরাতে ৬টি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। (১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৯-৮০)
খাজা আবু তালেবে বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে ৩৫ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি চাচাকে জীবিত পেয়েছেন। অর্থাৎ- নবুওয়াত জীবনের পূর্ণ ৮ বছর খাজা আবু তালেব তাঁর প্রিয় নবী ভাতিজার অকৃত্রিম অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি এতই সতর্ক ও যত্নশীল ছিলেন যার ফলে, কাফেরদের সকল চক্রান্ত ষড়যন্ত্র একের পর এক বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু এতকিছু সত্তে¡ও ইসলাম গ্রহণে তাঁর অনীহায় রাসূলুল্লাহ (সা.) মনে মনে কষ্ট অনুভব করতেন এবং চিন্তিতও ছিলেন। কেননা তাঁর আপন চাচা হিসেবে এবং সার্বক্ষণিক হিতাকাক্সক্ষী, সুহৃদ মুরব্বী হিসেবে তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ ও ইচ্ছা ছিল খাজা আবু তালেব যেন ইসলাম গ্রহণ করেন। সুযোগমত তিনি কয়েকবার তাঁকে সরাসরি আহবানও জানিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর প্রতি তাঁর গভীর স্নেহ-ভালোবাসা এবং ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ঘটনাটি হচ্ছে, খাজা আবু তালেব একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে যান। তখনি আবু তালেব তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রিয় ভাতিজা! আল্লাহ তোমাকে পয়গম্বররূপে প্রেরণ করেছেন। তাঁর কাছে দোয়া চাও, তিনি যেন আমাকে আরোগ্য দান করেন, আল্লাহ তোমার কথা মানেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আপনিও আল্লাহর কথা মানলে আল্লাহ আপনার কথাও মানবেন।’
আরো একটি ঘটনা, খাজা আবু তালেবের মৃত্যুর সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর নিকট গমন করেন। আবু জেহেল, আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই প্রমুখও পূর্ব থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘মৃত্যুর এ সময় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করুন, যাতে আমি আল্লাহর দরবারে আপনার ঈমানের সাক্ষ্য দিতে পারি।’ আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই বললেন, ‘আবু তালেব! আপনি কি আবদুল মোত্তালেবের দ্বীন হতে ফিরে যাবেন?’ অবশেষে আবু তালেব বললেন, ‘আমি আবদুল মোত্তালেবের দ্বীনের ওপর মৃত্যুবরণ করছি।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি সেই কলেমা পাঠ করতাম, কিন্তু কোরেশরা বলবে আমি মৃত্যুকে ভয় করছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি আপনার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকবো, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে নিষেধ করবেন।’ (সীরাতুন্নবী)
[সমাপ্ত]

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন