শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনায় শিক্ষার ক্ষতি অপূরণীয়

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এটা অতি পুরাতন কথা। আর বর্তমানকালে বলা হচ্ছে, আধুনিক তথা কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা মূল্যহীন। এর সাথে নৈতিকতা ও মানকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে যারা যত অগ্রগামী হচ্ছে, তারা তত উন্নতি করছে। তাই বেশিরভাগ দেশ এসবের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তবে, এতে সব দেশই যে সমান সফল হয়েছে, তা নয়। তথাপিও যতটুকু উন্নতি করেছে, তাও থমকে গেছে করোনা মহামারিতে। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর এর বিশ্বায়ন হয়েছে খুব দ্রুত। যা মোকাবেলার জন্য একে একে প্রায় সব দেশ লকডাউন করেছে। ফলে সব খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিসেফ গত ২৫ এপ্রিল বিবৃতিতে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে হাম, ডিপথেরিয়া, পোলিওসহ বিভিন্ন রোগের টিকাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আর এ কারণে লাখ লাখ শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অথচ প্রতি বছর দুই কোটির বেশি শিশুকে এসব টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু ১.৩০ কোটির বেশি শিশু এসব টিকা এখনো নেয়নি। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বার্কলে বলেছেন, ‘যেসব শিশু বর্তমানে টিকা নিচ্ছে না; তাদের সারাটা জীবনই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। হাম কিংবা পোলিওর চেয়ে করোনাভাইরাস শক্তিশালী নয়। কিন্তু করোনার জেরে সেসব রোগের টিকা শিশুদের দেওয়া থেকে বিরত থাকার মতো ঘটনা ঘটছে।’ এর জের পড়বে শিক্ষায়। অন্যদিকে, লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বাড়িতে বন্দি থাকার কারণে শিশুরা স্থূল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, দুরন্তপনা থেমে যাওয়ায় এবং বন্ধুদের সাথে দেখা ও খেলা করতে না পারায় তারা মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। খাওয়া-দাওয়া করছে না ঠিকভাবে।ফলে চরম অপুষ্টি শিকার হচ্ছে। তন্মধ্যে গরীবরা বেশি। উপরন্তু হৈ-চৈ, চিৎকার, চেঁচামেচি, মারামারি, ভাঙচুর ইত্যাদি করছে। আগে যে কাজটি তারা রাস্তা-ঘাটে ও খেলার মাঠে করতো, সে কাজ এখন বাড়িতেই করছে তারা। এরও জের পড়বে শিক্ষায়। এই অবস্থার অবসান কবে হবে তা কেউই জানে না। তাই বিভিন্ন দেশ লকডাউনের মধ্যে শিশুদের বাইরে খোলা স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যা’হোক, লক-ডাউনের কারণে শিক্ষাখাতও বন্ধ হয়ে গেছে ৩-৪ মাস যাবত। তাতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। সিএনএন’র খবরে প্রকাশ, ‘ইউনেস্কোর তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৯০টি দেশের শিক্ষার্থীরা লকডাউনে আছে। অর্থাৎ স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সারা বিশ্বের ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী এখন বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে। সব দেশেই আর্থিকভাবে সচ্ছলদের তুলনায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধনীদের মতো অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার কম্পিউটার, অন্যান্য ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ এবং নিরাপদ ও পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে না তারা। আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তারা মানসিকভাবেও ভালো নেই। সব মিলিয়ে করোনা মহামারীর পর ধনী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ফলাফলের পার্থক্য অনেক বেড়ে যাতে পারে। এছাড়া, সেভ দ্য চিলড্রেনের ডিরেক্টর হ্যাজার্ড জানান, ২০১৫ সালে ইবোলা মহামারীর সময় সিয়েরা লিওনে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছিল। এ সময় করা এক গবেষণায় দেখা যায়, মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। করোনাতেও একই অবস্থা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো অনেক শিশু শিক্ষার্থীকেই জোর করে অর্থ উপার্জনে নামিয়ে দিতে পারে। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো পরে আর স্কুলে ফেরার সুযোগ পাবে না।’ উল্লেখ্য যে, ইউনেস্কো এর আগে বলেছে, করোনার কারণে বিশ্বের ১৪০ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়াশুনা এবং পিএইচডি ও গবেষণা করে।তাদের মধ্যে যারা অসচ্ছল, তারা খন্ডকালীন কাজ করে শিক্ষা এবং থাকা-খাওয়ার ব্যয় বহন করে। কিন্তু লকডাউনের কারণে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা চরম সংকটে পড়েছে। এছাড়া, সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থাই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। অন্যদিকে, বহু শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তন্মধ্যে অনেকেই মারা গেছে। উপরন্তু ব্রিটেনের চিকিৎসকরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, করোনা চিকিৎসারত কিছু শিশুর দেহে খুবই বিরল কিন্তু বিপজ্জনক কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। কারণ, এ দেশেও করোনার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তাই গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে সারাদেশে লকডাউন। অবশ্য সব শিক্ষাঙ্গন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এর আগেই তথা ১৭ মার্চ থেকে। এই অবস্থায় শুরু হয়েছে পবিত্র মাহে রমযান। ফলে রোজার ঈদ পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে প্রাথমিকের। অপরদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২৭ এপ্রিল বলেছেন, করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। তবে, যখন করোনার প্রকোপ থাকবে না, তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই মাউশি থেকে মার্চ ও এপ্রিলের বেতন, টিউশন ফি বা অন্যান্য যে কোনও পাওনা আদায়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই বন্ধের মধ্যেই অভিভাবকদের ক্ষুদে বার্তায় বেতন পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এতে চরম বিপাকে পড়েছে বেশিরভাগ অভিভাবক। কারণ, উপার্জন বন্ধ থাকায় তারা চরম সংকটে রয়েছে। লকডাউনের কারণে প্রাইভেট এবং কোচিং বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ নেই তেমন। কারণ, করোনা আতংকে সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী টিউশনি, কোচিং, পার্ট টাইম জব করে শিক্ষার ব্যয় বহন করতো। লকডাউনের কারণে এসব বন্ধ থাকায় তারাও বিপদে পড়েছে। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিল চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। করোনার কারণে তা আটকে গেছে। ফলে ২০ লাখ শিক্ষার্থী চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কারণ, ফল প্রকাশ যত দেরি হবে, কলেজে ভর্তি হওয়া তত বিলম্বিত হবে। একই অবস্থা হয়েছে এইচএসসির পরীক্ষার্থীদের। গত এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে এ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, করোনা শেষ হওয়ার ২০ দিন পর পরীক্ষা শুরু করা হবে। ফলে এই পরীক্ষার ১২ লাখ শিক্ষার্থী চরম বিপাকে পড়েছে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে চতুর্থ দফায় মাইগ্রেশন ও অপেক্ষমান তালিকা থেকে ভর্তির সময় ছিল গত ৫-২১ এপ্রিল পর্যন্ত। কিন্তু করোনার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। এভাবে বহু পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। সেশনজটও সৃষ্টি হচ্ছে। অবশ্য, শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকায় ব্যতিক্রম হিসাবে সংসদ টিভিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কিছু পাঠদান হচ্ছে। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ তেমন নয় বলে মিডিয়ার খবরে প্রকাশ। অন্যদিকে, অনলাইনে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ-সামর্থ্য সকলের নেই। গত ২৬ এপ্রিল ইউজিসি জানিয়েছে, বর্তমানে ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারি ও বাকি সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ৬০-৭০%। অপরদিকে, করোনার প্রাদুর্ভাবে ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করেছে এনটিআরসিএ। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ১৫-১৬ মে এবং লিখিত পরীক্ষা ৭-৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এতে ১১.৭২ লাখ প্রার্থী আবেদন করেছে। এভাবে সব নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারী করতে পারছে না। ফলে চাকরি প্রার্থীরা চরম ক্ষতির শিকার হয়েছে। তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ২০২০ সালকে চাকরি প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ‘নন কাউন্টেবল’ করা দরকার। তাহলে তারা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
মোট কথা বিশ্বের প্রায় সব দেশের ন্যায় এ দেশেও শিক্ষার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে এক বছর নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু একটি বছর শিক্ষার্থীদের জীবনে মহামূল্যবান। একে নষ্ট করতে দেওয়া সমীচীন নয়। শিক্ষার্থীরাও তা চাইবে না। কারণ দু-এক বছরের মধ্যে বহু শিক্ষার্থীর বয়স পূর্ণ হয়ে যাবে সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে। তাই তাদের কাছে এই এক বছর অতি গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি বেশিরভাগ অভিভাবকের সামর্থ্য নেই অতিরিক্ত এক বছরের শিক্ষা ব্যয় বহন করার। আবার প্রাইভেট পড়ে কিংবা কোচিং করে পুষিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য নেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২-৩ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে এবং তা ফুল কোর্সের ভিত্তিতেই। কারণ, কোর্স শর্টকাট করে কিংবা ৬ মাস ড্রপ করে বছর অতিক্রান্ত করা হলে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হবে,তা তাদের বহন করতে হবে সারাজীবন। সে সাথে দেশকেও। তাই ফুল কোর্স পূরণ করতে হবে। আবার করোনা সৃষ্ট ক্ষতিও পুষিয়ে নিতে হবে। অনেকেই অটো প্রমোশনের কথা বলছে। এটা করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। যার ক্ষতি চলেছে দীর্ঘদিন। তাই এটা করা অনুচিত।
স্মরণীয় যে, দেশে প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৮%। বর্তমানে নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার কোটির অধিক। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ প্রায় সমান। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বের ২০০টি দেশের কোনটিতেই নেই। তাই আমাদের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেশের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিপুল শিক্ষার্থীর আউটপুট তেমন সুখকর নয়। কারণ, তারা দক্ষ নয়। ইউনিসেফের ২০১৯ সালের তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশের তরুণদের ৭৪% অদক্ষ আর মাত্র ২৬% দক্ষ।’ এ থেকে বোঝা যায়, দেশে দক্ষ লোকের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। যার কিয়দংশ পূরণ করা হচ্ছে বিদেশিদের দিয়ে। তাতে তারা বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ভারতীয়রা বেশি। অথচ দেশে মোট যে তরুণ রয়েছে, তারা যদি সকলেই দক্ষ হতো; তাহলে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি উন্নতি করবে বাংলাদেশ-এই বক্তব্য শুধু চটকদারই হতো না, বাস্তবেই হতো। (কিন্তু বাস্তবে দেশের সার্বিক উন্নতি কি হয়েছে, তা প্রমাণিত হয়েছে করোনাকালে)। এ সংকট থেকে উদ্ধার পেতে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর কাছে সহায়তা চাইতে হচ্ছে! অন্যদিকে, ৬ এপ্রিল প্রকাশিত এফএম গ্লােবাল’র ‘গ্লােবালরেজিলিয়েন্স ইনডেক্স-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ্যের দিক থেকে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম। অপরদিকে, ইউএনডিপির প্রতিবেদন মতে, করোনা সংকটে নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আটটি ক্ষেত্রে দেশগুলোর নেওয়া সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার তুলনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। অপরদিকে, খবরে প্রকাশ, করোনায় সেরে উঠার হার বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন বাংলাদেশ! তাই আর্থসামাজিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের মানবিক সংস্থাগুলো একজোট হয়ে ‘নিডস অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে কাজ করছে। এতে ৬৫টি সরকারি সংস্থা, জাতিসংঘের সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। কেয়ার বাংলাদেশ এই গ্রুপের কো চেয়ার হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ করোনার চিকিৎসায় সরঞ্জাম দিয়েছে। এটাই হচ্ছে দেশের সার্বিক উন্নতির প্রকৃত স্বরূপ।
দেশের শিক্ষার পদ্ধতি সেই মান্ধাতার আমলেরই রয়েছে, যা আধুনিক যুগে অচল। আর মান কমতে কমতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ৬৫% ভালভাবে বাংলাই পড়তে পারে না, আর ইংরেজিতে অবস্থা আরও করুণ বলে ২০১৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে। নিম্ন স্তরের শিক্ষার এই মানহীনতার জের উপরের স্তরেও চলছে। এভাবে দেশের শিক্ষা মানহীন হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রে। শিক্ষার মানহীনতার জন্য প্রধান দায়ী বর্তমান সরকারের নীতি। সেই নীতিটি হচ্ছে, যেনতেনভাবেই হোক শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা। আর সে কারণেই শিক্ষার হার বেড়েছে আর শিক্ষার মান কমেছে। এছাড়া, ঝড়ে পড়া তো রয়েছেই। প্রাথমিক থেকে অনেক কিশোরী ঝড়ে পড়ে। এই ঝড়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে: দারিদ্র। অন্যদিকে, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভালো অবকাঠামো নেই। খেলার মাঠ ও বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা নেই বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অনেক শিক্ষকেরও মান খারাপ। নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে এই অবস্থা হয়েছে। অপরদিকে, দেশে অসংখ্য প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলো সরকারি নীতি তেমন পালন করে না বাণিজ্যিকিকরণের ফলে। তাই সাধারণ পরিবারের সন্তানদের সেখানে লেখা-পড়া করার সামর্থ্য নেই। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আর একটি প্রকট সমস্যা রয়েছে। সেটি হচ্ছে-বাংলা, ইংরেজি, আরবি ইত্যাদি মাধ্যম। যার একটির সাথে অন্যটির মিল নেই। তাই এক মাধ্যমের শিক্ষিতরা অন্য মাধ্যমে কাজ করতে পারেনা। সরকার একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সফল হওয়া আবশ্যক এবং তাতে ইংরেজি ও ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে। উপরন্তু সরকার শিক্ষা আধুনিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যেমন: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নগণ্য। দেশে ক্রমশ: বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তবে, আইটির শিক্ষা কিছু বেড়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। কারিগরি শিক্ষাকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর যে বৃদ্ধির হার (বর্তমানে ৮-১০%। আর বেশিরভাগ দেশে ৫০-৬০%), তাতে কাক্সিক্ষত অবস্থায় পৌঁছতে যথেষ্ট সময় লেগে যেতে পারে। শিক্ষার মানের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার হার বাড়ানো যত সহজ, শিক্ষার মান বাড়ানো তত সহজ নয়। কারণ, শিক্ষার মানোন্নয়নের সাথে শিক্ষকের মান,শিক্ষাঙ্গনের মান, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ইত্যাদি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ইচ্ছা করলেই রাতারাতি শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন চাইলে এসব আগে করতে হবে। বিবিএস’র তথ্য মতে, দেশের ২৫-৬০ বয়সী মানুষের ৩৭% নিরক্ষর। যারা সাক্ষরযুক্ত, তাদেরও মান অতি নিম্নতর। অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষার উন্নতি ও মানোন্নয়নের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে এবং তা জিডিপির কমপক্ষে ৬%। এ অভিমত বিশেষজ্ঞদেরও। শিক্ষাবিদ ও বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘মধ্যম কিংবা উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে আমাদের জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ানের মতো দক্ষ হতে হবে। এই দক্ষতা অর্জনের চাবিকাঠি হলো শিক্ষা এবং তা বিশ্ব মানের।’
যা’হোক, করোনা সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষি খাতে, শিল্প খাতে, সেবা খাতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। লকডাউন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে এসব খাতে পুনোর্দ্যমে কাজ শুরু হয়ে যাবে। পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দায়িত্ব মূলত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তবে, এ ক্ষেত্রে শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। এর বাইরে আমাদের মতো সাধারণ লোকের পক্ষে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। করোনা সৃষ্ট শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ঐচ্ছিক ছুটি বন্ধ, অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে গ্যাপ পূরণ, শিক্ষকদের ভালো নোট দেওয়া ইত্যাদি আবশ্যক।
আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই বছরের কোন ফি নিতে পারবে না। প্রতিষ্ঠানের জনবলের বেতন সরকারকে বহন করতে হবে এবং তা বেসরকারি খাতেরও। অন্যদিকে, অনলাইন ও দূরশিক্ষণ ভিত্তিক শিক্ষা চালু করা দরকার বলে অনেক শিক্ষাবিদের অভিমত। হ্যাঁ, বিভিন্ন দেশ শিক্ষা খাতে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক সুফল পাচ্ছে। আমাদেরও সেদিকে অগ্রসর হতে হবে। এর সাথে বেতারকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন