মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন আমার বাবা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ্.)’ শিরোনামে তার ছেলে ও পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদক আহমাদ বদরুদ্দীন খানের মধুময় স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ আবদুল অদুদ।
আমার বাবার পারিবারিক আঙ্গিনা তথা পরিধিটি ছিলো অনেক বড়। কারণ, তিনি আজীবন শুধুমাত্র আমার মা ও আমাদের পরিবারের পাঁচ ভাই-বোন এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে কখনো পারিবারিক জীবন কল্পনা করেন নি। বরং সকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভান্যুধ্যায়ী ও দেশের গোটা ইসলামী অঙ্গনের সকল সদস্যদের নিজের পরিবারভূক্ত মনে করতেন। আর তাই উল্লেখিত সকলকে নিয়েই ছিল তার বৃহৎ পরিবার। তবে আজ আমি তাঁর একান্ত পারিবারিক জীবন তথা আমার মায়ের সাথে তাঁর দীর্ঘ বাষট্টি বছরের দাম্পত্য জীবনের একটি খণ্ডিত অংশ তাঁর প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের সামনে উপস্থাপন করব, যেখানে আমার বাবা-মায়ের একান্ত কিছু অনুভূতি- যা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, তেমনি দু’একটি শিক্ষনীয় অন্তরঙ্গ খন্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব। আর বাবা-মা দু’জনকে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য এই যে, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আজ চার বছর পূর্ণ হলো। ২০১৬ সালের ১৯ রমযান সন্ধ্যা ৬:১০ মিনিটে আব্বা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর তার ঠিক চার দিন কম চার বছর পর গত পরশুর আগের দিন অর্থাৎ, ১৬ রমযান বিকেল ৪:১০ মিনিটে আমার স্নেহময়ী মা-ও মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
আর এদিন আমরা প্রিয়জন-হারার ব্যাথায় ব্যথিত হলেও আমার মরহুম দাদা হাকীম আনসার উদ্দীন খান (রাহ্.) এবং বাবা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ্.) তাদের প্রিয়জন অর্থাৎ, আমার মাকে হয়তো তাঁদের পরকালীন জীবনে কাছে পেয়ে আনন্দিত হয়েছেন।আর মুসলমান হিসেবে আমরা তাই বিশ্বাস করি। কেননা, আমাদের প্রিয় নবীজী (সা.) ইহ-জীবনের একেবারে অন্তিম সময়ে কান্নারত প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)-কে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে এই বলে সান্তনা দিয়েছিলেন, হে ফাতেমা! কেঁদো না! বরং সুসংবাদ গ্রহণ করো। কারণ, আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে তুমিই সর্বপ্রথম এসে কবর জীবনে আমার সাথে মিলিত হবে। বাস্তবে হয়েছিলও তাই, ছয় মাস মতান্তরে তিন মাস দশ দিন পর নবী-নন্দিনী হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা (রা.)গিয়ে মিলিত হন মহান পিতার পবিত্র সান্নিধ্যে। এরপর আরো দুই প্রিয় সহচর হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা.) ও হযরত ফারুকে আযম (রা.)গিয়ে মিলিত হন প্রিয় নবীজী (সা.)-এর সাথে। আর প্রিয় নবীজী (সা.)-এর বিশ্বাসী উম্মত হিসেবে আমরা দৃঢ়তার সাথে একথা বিশ্বাস করি যে, আমরা যারা এ জীবনে পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ, মৃত্যু-পরবর্তী কবর জীবনেও আমরা সেভাবে পরস্পরের সাথে মিলিত হব।
আমার বাবার সংসার জীবনের কেন্দ্র-বিন্দু ছিলেন আমার মা। দিন শেষে বাড়ী ফিরে বাবা তাঁর সকল সুখ-দুঃখের কথা মায়ের সাথে শেয়ার করতেন। মা ছিলেন বাবার গুণমুগ্ধ শ্রোতা। আর তাই বাবা বাইরে থেকে ঘরে আসার পর হাত-মূখ ধুয়ে আয়েশ করে বসে দীর্ঘ সময় আমার মায়ের সাথে গল্প করতেন।
বাবার কোন বই প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম কপিটিই বাবা নিয়ে আসতেন মায়ের জন্য। মা পরম ভক্তি ও আনন্দের সাথে সে বইটি নেড়ে-চেড়ে দেখতেন, এরপর টিপ্পনী কেটে বলতেন, আপনি সারা দিন মানুষের সাথে বসে আড্ডা দেন এবং গল্প করেন, এসব করে এত বড় বড় বই লেখার বা অনুবাদ করার সময় পান কখন? বাবা তখন হেসে বলতেন, আরে! এই আড্ডাবাজীর মধ্যে থেকেই আমি আমার লেখালেখির রসদ জোগাড় করে নেই।
বাবার লেখালেখি জীবনের একটি মাইল ফলক ছিল তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনের বঙ্গানুবাদ।অতএব যারা বাবার অনুবাদকৃত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনের সু-বৃহৎ আট খন্ডের বঙ্গানুবাদ অধ্যয়ন করেছেন এবং পাশাপাশি সউদী সরকার কর্তৃক এ তাফসীর গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত এক খন্ডের বঙ্গানুবাদ অধ্যয়ন করেছেন, তাদের প্রায় সকলের কাছেই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি তুলনা-মূলক সহজ ও গোছালো মনে হয়েছে- যদিও নানা আঙ্গিকে উল্লেখিত সংস্করণ দুটির প্রয়োজনীয়তা, স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সে আলোচনায় না গিয়ে আজ আমি তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনের সংক্ষিপ্ত সউদী সংস্করণ সম্পর্কে বাবার সাথে আমার সহজ-সরল মায়ের একটি মজার গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করব। উনিশ’শ তিরানব্বই সালে আমার বাবা-মা সউদী সরকারের রাজকীয় মেহমান হিসেবে পবিত্র হজ্জ পালন করতে মক্কা মুকাররামায় যান। আমি তখন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। অতএব আমাকেও রাজকীয় কর্তৃপক্ষ পুরো সফরে তাদের সাথে সম্পৃক্ত করে নিলেন। আমরা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে হজ্জ ও মদীনা মুনাওয়ারার যিয়ারত সম্পন্ন করলাম। হজ্জ শেষে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আমিও তাঁদের সাথে একই ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। ছাত্র হিসেবে ভার্সিটি কর্তৃক সরবরাহকৃত আমার এয়ার টিকেট ছিল ইকোনোমি ক্লাসের। আর রাজকীয় মেহমান হিসেবে মা-বাবার টিকেট ছিল ফার্স্টক্লাসের। বাবা সউদী রাজকীয় প্রটোকলের সাথে কথা বলে আমার টিকেট ফার্স্টক্লাসে আপগ্রেড করে নিলেন। অতঃপর আমরা দেশের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য জেদ্দা বিমান বন্দরে উপস্থিত হলাম। বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে প্লেনে আরোহণ করার ঠিক আগ মুহুর্তে সউদী হজ্জ ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রত্যেক যাত্রীকে এক বোতল যমযম ও মদীনা মুনাওয়ারাস্থ বাদশাহ্ ফাহাদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প থেকে প্রকাশিত এক কপি পবিত্র কোরআনের বাংলা সংক্ষিপ্ত তাফসীর উপহার দেয়া হলো। আমরা সকল যাত্রীই সেই অমূল্য উপহার আনন্দের সাথে গ্রহণ করলাম। বাবা নিজের উপহার সামগ্রীগুলো গ্রহণ করে আমার মায়ের হাতে দিয়ে দিলেন। মা কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, ভালই হলো এক সেট পড়ব। আর আরেক সেট যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিব। উল্লেখ্য যে, উপহার হিসেবে প্রাপ্ত পবিত্র কোরআনের সেই বাংলা সংক্ষিপ্ত তাফসীর গ্রন্থটি ছিল আমার বাবার অনুবাদ ও সম্পাদনাকৃত সংক্ষিপ্ত তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন। আর এই বিশেষ সংস্করণটি সেবারই প্রথম বিলি করা হয়, ফলে আমার মায়ের সেটা জানার কথা নয় যে, এ তাফসীরটি আমার বাবার অনুবাদকৃত।
আমার মা ইতোপূর্বে বাবার অনুবাদকৃত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনের সু-বৃহৎ আট খন্ডের বঙ্গানুবাদ অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু সেটি বৃহৎ ও বিস্তারিত তাফসীর হওয়ার কারণে আমার মায়ের পক্ষে পুরোটা আয়ত্ব করা বেশ কষ্টকর ছিল। আর তাই প্লেনে আসন গ্রহণ করার পর এই সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষনীয় অবয়বের তাফসীর গ্রন্থটি মা খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় লেখক পরিচিতি না দেখেই সরাসরি সূরা ফাতেহার অনুবাদ ও তাফসীর অধ্যয়ন করার পর পাশে বসা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কোরআনের কি তাফসীর করলেন যে, পড়তে ও বুঝতে কষ্ট হয়। অথচ এই তাফসীরটি দেখুন কত সুন্দর ও ঝরঝরে- দেখতেও ভালো লাগে আর পড়তেও বেশ মজা।
বাবা আমার মায়ের এ তীর্যক মন্তব্য শুনে আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যপূর্ণ হাসি দিয়ে মাকে শুনিয়ে আমাকে বললেন, তোমার মাকে বল যে, কোন গ্রন্থ পাঠ করার পূর্বে লেখক বা অনুবাদকের নাম সর্বাগ্রে দেখে নিতে হয়। আমি তখন মাকে বললাম, আম্মা! তুমি প্রথম পৃষ্ঠা খুলে দেখ! এটি কে অনুবাদ করেছেন। মা ত্বরিৎ গতিতে প্রথম পৃষ্ঠা খুলে অনুবাদকের স্থানে বাবার নাম দেখে বিস্মিত নেত্রে একবার আমার দিকে, একবার বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা আবার আপনি কবে অনুবাদ করলেন?! বাবা তখন সুযোগ পেয়ে এই বলে টিপ্পনী কাটলেন, আরে! তুমি আমার গুণটা কবে দেখলে। তুমি তো শুধু আমাকে লোকজনের সাথে আড্ডা দিতেই দেখেছ। তাই তোমার অবগতির জন্য বলছি, সেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকেই আমি এটা অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছি। আমার তো এটাই দুঃখ যে, সারা দুনিয়ার মানুষ আমার গুণমুগ্ধ অথচ এক তুমিই আজো আমাকে চিনতে পারলে না।
বাবার এই রহস্যপূর্ণ হাসি ও তীর্যক মন্তব্য শোনার পর মা যেন লজ্জায় একেবারে মিশে গেলেন। প্লেনের প্রথম শ্রেণীর আসন বিন্যাস এভাবে ছিল যে, জানালার পাশে দুটো সিট এক সাথে তারপর করিডোর এর পর আরো দুটো সিট। আমি বসেছিলাম জানালার পাশে তারপর মা, আর মায়ের পাশে একটু ব্যবধানে বাবা। অতএব, তাফসীরের বিষয়টা বুঝতে পারার পর মা লজ্জায় যেন আর বাবার পাশে বসতে পারছিলেন না। আর তাই কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করার পর মা আমাকে চুপি চুপি বললেন, তুমি এপাশে এসে বসো। এই বলে মা সাইড পরিবর্তন করে যেন নিজেকে লুকোতে চাইলেন। আমার মায়ের এই পলায়ণপর তৎপরতা দেখে বাবা শুধুই তৃপ্তির হাসি হাসছিলেন। কেননা, মায়ের এই অজ্ঞতা অতঃপর সঠিক বিষয়টি বুঝতে পেরে বিস্ময় প্রকাশ করা- এসবই যেন ঐ মুহুর্তে বাবার সেই অসাধারণ অধ্যাবসায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর পরিতৃপ্ত চেহারায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল। কারণ, যার সাথে সুখে-দুঃখে সংসার জীবনের অর্ধ শতাব্দী পার করে দিলেন, সেই প্রিয়তমা স্ত্রীর চেহারার কৃতজ্ঞ-চিত্তের সেই বিস্ময়ভরা চাহনী সেদিন আমার বাবাকে কতটা পুলকিত করেছিল, সেটা শুধু আমিই দেখেছিলাম এবং উপলব্ধি করেছিলাম। এদিকে মা নিজের লজ্জা লুকাতে ঘোমটা টেনে গভীর মনোযোগের সাথে তাফসীর পাঠ করতে লাগলেন। দীর্ঘ সাত ঘন্টার সফরে মা আর একটি কথাও বললেন না। অতঃপর ঢাকায় প্লেন অবতরণ করার আগ মুহুর্তে মা আমাকে বললেন, তুমি এই ঘটনা কাউকে বলো না। অতঃপর বাবাকে শুনিয়ে আমাকে আবারো বললেন, তোমার বাবাকেও বলে দিও সে যেন একথা কাউকে না বলে, তাহলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। বাকী জীবনে বাবা কিংবা আমি- কাউকে আমার মায়ের সেই বোকা বনে যাওয়ার কথা বলিনি।
আজ বলছি, কারণ, আজ বাবার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। চার দিন হয় মা-ও আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সকল ভয়, লজ্জা আর ভালো-মন্দের সীমা পেরিয়ে তাঁরা আজ আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরের অধিবাসী। মা সেদিন নিজের সেই সুমধুর ভুলের জন্য লজ্জিত হলেও, প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে নিজের স্বশ্রদ্ধ স্বীকৃতির জন্য আমার বাবার চোখে-মূখে আমি সেদিন এক স্বর্গীয় সুখ ও পরিতৃপ্তির ঝলক দেখেছি। বলতে কি, সেদিন সন্তান হিসেবে আমিও বাবাকে নিয়ে এক ধরণের গর্ব অনুভব করেছি। কারণ, সউদী এয়ারলাইন্সের সুপরিসর বিমানের সাড়ে পাঁচ’শ হজ্জযাত্রীর সকলেই সেদিন আকাশে বসে তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআনের সংক্ষিপ্ত এই সংস্করণটি গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠ করছিলেন আর আমার বাবার এই অসাধারণ কর্মের প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক যাত্রীর মাঝে কেউ জানতে পারেননি যে, স্বদেশের যে আলেমকে নিয়ে তারা এতো গর্ব অনুভব করছেন তিনি স্বয়ং এই ফ্লাইটে তাদের সাথেই ভ্রমণ করছেন। এ কথাটি সেদিন শুধু আমার মা আর আমিই জানতাম। কেননা, আমার বাবা ছিলেন প্রচার-বিমূখ মানুষ। তবে আমার মা অন্ততঃ তাঁকে এবং তাঁর কর্মযজ্ঞকে অনুধাবন করুক, এটা তিনি চাইতেন। কারণ, পৃথিবীর প্রত্যেক সফল ও কীর্তিমান পুরুষদের যাবতীয় সফলতার পিছনে স্ত্রীদের একটা বিশাল অবদান থাকে। আর আমার মা স্বল্প-শিক্ষিত হলেও স্বশিক্ষিত ছিলেন। বাবার সঠিক কদর বুঝতেন। তাঁর চেষ্টা-সাধনাকে মনযিলে মকসুদে পৌছে দিতে আমার মায়ের ত্যাগ-তিতীক্ষা ছিল অপরিমেয় এবং কিংবদন্তিতুল্য।সংসার জীবনের সকল না পাওয়ার কষ্টকে আমার স্নেহময়ী মা হাসিমূখে মেনে নিয়েছেন। অনেক কিছু না পাওয়ার পরও কখনো কোন অভিযোগ তার ছিল না। বাবার দেয়া কোন উপহারকে কখনো তিনি ছোট করে দেখতেন না।
সংগ্রামী আলেম-সাধকদের জীবনী আমার মা পাঠ করতে ভালোবাসতেন। আর আমার বাবার সংগ্রাম-মূখর জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন আমার মা। আর তাই আমরা মনে করি, আমার বাবার বিশাল সাহিত্য সম্ভারের প্রতিটি শব্দে শব্দে আমার মায়ের স্বযত্ন স্নেহের পরশ রয়েছে। বাবার লেখা জীবনের খেলাঘরে নামক সাড়া জাগানো আত্মজীবনী গ্রন্থের শুরুতেই বাবা আমার মহিয়সী মায়ের সেই অবদানের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে এভাবে স্মরণ করেছেন :
“দাম্পত্য জীবনের শুরুর দিকে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর খাওয়া-দাওয়া তো যা চলছে তা না বলাই ভাল। কিন্তু ছেলেটাকে তো আর দুধ না দিয়ে পারা যায় না! সুতরাং নিজেরা না খেয়ে হলেও ওর জন্য সপ্তাহে অন্যূন দুটা গ্লাক্সোর কৌটা জোগাড় করতেই হয়! এদিকে আবার এক ভয়ঙ্কর পণ করে বসেছি যে, পেটের ভাতের জন্য কারো কাছে নত হবো না। এমনকি নিজের অভাবের কথাটাও বলব না। সব অভাব আর বিপদ-আপদের কথা একমাত্র রিযিকের মালিক আল্লাহ্ তাআলার নিকটই বলব! বিগত রাতটা কেটেছে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা আর মনোকষ্টে!
আর চরম হতাশার মধ্যেই আল্লাহর কথা বেশী মনে হয়। গত রাতটায় আল্লাহ্কে স্মরণ করছিলাম একটু ব্যতিক্রমী পন্থায়। কণ্ঠে ছিল অভিযোগ মিশানো কান্না! বলছিলাম, যদি একটু ভাল কাজ করার সুযোগই করে না দিলে তবে দ্বিনী এলেম দিলে কেন? মনের মধ্যেই বা এত আবেগ-উৎসাহ দিলে কেন? স্ত্রীকে মাঝে মাঝেই বলি, তুমি কিছু দিন বাড়ীতে গিয়ে থাক, দেখি আল্লাহ্ পাক কোন ব্যবস্থা করেন কিনা! কিন্তু সে রাজী হয়না। তার কথা হলো, যে অবস্থা দেখছি, তাতে তোমাকে রেখে চলে গেলে খাওয়ার কষ্ট চরমে পৌঁছবে এবং তুমি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বে। অবশ্য ইতিমধ্যেই গ্যাষ্টিকের আলামত পরিপূর্ণরূপে দেখা দিয়েছে। লক্ষ্য করছিলাম, স্ত্রীর স্বাস্থ্যও পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল। ছেলে হওয়ার পর বেচারীকে উপযুক্ত ঔষধ-পথ্য তো দূরের কথা, মান-সম্মত খাবারও তো দিতে পারিনি! কিন্তু এজন্য তার মুখে কোন অভিযোগের কথা আমাকে কখনও শুনতে হয়নি। বরং উল্টা সে আমাকে উৎসাহ দিত এই বলে যে, দ্বীনের যে কোন সেবার দায়িত্ব গ্রহণ এত সোজা নয়! এসব বিষয় আমিও যে না বুঝতাম তা নয়, কিন্তু তারপরও মনটা মাঝে মাঝেই যেন দমে যেতে চাইত! গত রাতটা আমার সেরূপ একটা অবস্থার মধ্যেই কেটেছে।”(জীবনের খেলাঘরে)
আমি আমার বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। বাবার বর্ণাঢ্য সংগ্রামী কর্ম-জীবনের চার দশক বা চল্লিশটি বছর খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বাবার হাজারো সহযোদ্ধা আলেম-উলামাদের কেউ কোন দিন পর্দার আড়ালে থাকা আমার মাকে দেখেন নি। অথচ এঁদের প্রত্যেকেই আমার স্নেহময়ী মায়ের স্বযত্ন মেহমানদারীর স্বাদ আস্বাদন করেছেন। পয়ষট্টি বছরের সংসার জীবনে আমার মা কালজয়ী মনীষী হযরত মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী (রাহ.), হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.), হাফেযুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল্লাহ্ দরখাস্তি (রাহ.), হযরত মাওলানা ত্বাকী উসমানী, হযরত মাওলানা আবদুর রহমান কাশগড়ী (রাহ.), হযরত মাওলানা মুফতী আমীমুল ইহ্সান মুজাদ্দেদী (রাহ.), হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি (রাহ.), হযরত মাওলানা মোহাম্মদউল্লাহ্ হাফেজ্জী হুজুর (রাহ.), হযরত মাওলানা মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ খান (রাহ.), মাওলানা আকরম খা (রাহ.), বিশ্বনবী গ্রন্থের রচয়িতা কবি গোলাম মোস্তফা, কবি ফররুখ আহমদ ও সমকালীন জগৎ-বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদসহ হাজার হাজার আলেম-উলামাকে পরম যত্নে আমার মা রান্না করে খাইয়েছেন। এঁদের প্রত্যেকেই আমার মায়ের মেহমানদারীর প্রশংসা করেছেন ও তার জন্য প্রাণভরে দোয়া করেছেন।
আমরা সারা-জীবন দেখে এসেছি যে, আমার বাবা কর্ম-ব্যস্ততার কারণে অনেক রাতে কোন রকম পূর্বাভাস না দিয়েই হঠাৎ দশ-বারোজন মেহমান নিয়ে বাসায় আসতেন। আমার মা হাসিমূখে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। রুগ্ন শরীরেও কখনোই মেহমানদারী করতে আমার মায়ের মূখে কোন অভিযোগ বা বিরক্তির কোন চিহ্ন আমরা দেখিনি। বরং সব সময় আলেম-উলামা ও গুণীজনদের মেহমানদারীতে আমরা আমাদের মাকে আগ্রহী ও সপ্রতিভ দেখেছি।
আলেম-উলামা ও গুণীজনদের মেহমানদারী করার ক্ষেত্রে আমার মায়ের অনুপ্রেরণার বিষয়টি তিনি খুব সোজা-সাপ্টা কথায় এভাবে ব্যক্ত করতেন যে, আলেম-উলামাগণ নবীদের ওয়ারিস বিধায় যে ব্যক্তি তাঁদের সেবা-যত্ন করবে, কাল হাশরে স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর মেহমানদারী করবেন। আমার মা কোন সূত্র থেকে মেহমানদারীর এই অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন জানি না, তবে পরবর্তী জীবনে হাদীস অধ্যয়ন করে দেখেছি যে, রাসূল (সা.)-এর একটি হাদীসের মর্মার্থও তাই- যা আমার মায়ের মেহমানদারীর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করত। আর সেই হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সা.)এরশাদ করেছেন :“মানুষের হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে, দুনিয়ার জীবনে সে যাদের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় রাখবে।”
আমার মরহুম বাবা-মা আজীবন আলেম-উলামা ও গুণীজনদের ভালোবেসেছেন, সাধ্যমত তাঁদের সেবা-যত্ন করার ও তঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন। আমার বিশ্বাস তাদের সেই ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পর-জীবনে তাঁদের পাথেয় হবে। পবিত্র মাহে রমযানের মাগফেরাতের দশকে বিদায় হওয়া আমার পিতা-মাতা ও পিতামহ মহান রাব্বুল আলামীনের রহমত ও মাগফেরাত লাভে পরকালীন জীবনে সফল হবেন ইনশাআল্লাহ্। (১৯ রমযান ১৪৪১ হিজরী)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন