শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

গর্ভাবস্থায় করোনা : কিছু গবেষণামূলক তথ্য

| প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব কঠিন এক দুর্যোগের মুখোমুখি, যা মোকাবেলা করতে মানবজাতি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কোভিড - নাইনটিন বা নভেল করোনা ভাইরাসের নানা দিক নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে গবেষণা করছেন সারাবিশ্বের বড় বড় সব বিজ্ঞানীরা। কয়েক মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অনেক দিকই অজানা।
কোভিড নাইনটিন এ সারা বিশ্বের মৃত্যু হার পর্যালোচনা করলে যে কঠিন সত্যিটি সামনে আসে তা হলো, বয়স্ক বা ষাট ঊর্ধ্ব মানুষদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ও মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। যদিও সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে, তারপরও স্বস্থি-দায়ক ব্যাপার হোল বাচ্চারা অনেক কম আক্রান্ত হচ্ছে । গবেষকরা মনে করছেন এই ভাইরাস মানুষের দেহে আরাম করে বাসা বাঁধার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা বাচ্চাদের দেহে তৈরি হয়নি ।
প্রেগন্যান্ট বা গর্ভবতী মহিলাদের উপর করোনা ভাইরাস কি ধরনের প্রভাব ফেলে বা কি ধরনের চিকিৎসা করা হয়, এটা সত্যি খুব গুরুত্বপূর্ণ, সময় উপযোগী, জরুরী একটি বিষয়। আমি কিছু আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মেডিকেল জার্নাল যেমন, দি ল্যান্সেট, ন্যাচার, আমেরিকান জার্নাল অফ অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনোকলজি, সিডিসি সহ আরও কিছু জার্নাল পড়ে এ বিষয়ে কোন গবেষণা হয়েছে কিনা জানার চেষ্টা করি। ল্যান্সেটে আমি মাত্র তিনটি আর্টিকেল পাই এ বিষয়ে। যদিও খুব স্বল্প সময়ে স্বল্প সংখ্যক করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের উপর এ রিসার্চগুলো করা হয়, তবুও এগুলো কিছুটা হলেও পথ নির্দেশনা দেয়। যা এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজনীয় ।
গবেষণাগুলো চীনের উহানের ২ টি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের উপর করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ল্যান্সেটে অনলাইনে প্রকাশিত হুইজুন চ্যান ও তার সঙ্গীদের একটি গবেষণায় করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ/উপসর্গ, আউট-কাম বা ফলাফল এবং জন্মের আগেই মায়ের কাছ থেকে শিশুর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। মাত্র ৯ জনের উপর এ গবেষণাটি করা হয়। এই নয়জন জানুয়ারির ২০ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে তাদের গর্ভকালীন ৩৬/৩৭ সপ্তাহে হসপিটালে ভর্তি হন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। তাদের বয়স ছিল ৩৩ থেকে ৪০ এর মধ্যে।
গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের লক্ষণ গুলো স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের মতোই জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা, ডাইরিয়া ইত্যাদি। এই রোগীদের কেউই খুব সিভিয়ার বা আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিলেন না। কেউ আইসিইউ তে ভর্তি ছিলেন না। ঐ সময় তাদের কিছু টেস্ট করে দেখা হয় বাচ্চার মধ্যে করোনা সংক্রমণ হয়েছে কিনা (অ্যামনিয়টিক ফ্লুইড, কর্ড ব্লাড পরীক্ষা)। তবে সবার সিজার করতে হয়েছিল গড়ে ৩৯ সপ্তাহে যা নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই। সিজারের কারণ হিসেবে অন্যান্য উপসর্গের সাথে স্বাভাবিক বা নরমাল ডেলিভারিতে শিশুর করোনা আক্রান্তের আশংকাকে মাথায় রাখা হয়। আনন্দের বিষয় ৯ জন সুস্থ শিশুর জন্ম হয়েছিল। নবজাতক করোনায় আক্রান্ত কিনা দেখার জন্য নবজাতকদের গলার রস (থ্্েরাট সোয়াব) টেস্ট করা হয়। সব টেস্টই নেগেটিভ আসে।
জন্মের ৩৬ ঘণ্টা পর একটি শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু তার ভাইরাস সংক্রমণ গর্ভে থাকা অবস্থায় হয়েছে নাকি জন্মের পর আক্রান্ত মায়ের সংস্পর্শে আসার কারণে হয়েছে তা প্রমাণিত নয়।
অন্য আর একটি শিশু জন্মের ১৭ দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়। সে করোনায় আক্রান্ত মা ও নার্স দুজনের সংস্পর্শে এসেছিল।
গত ২৪ মার্চ, ২০২০ সালে ল্যান্সেটে অনলাইনে আর একটি রিসার্চ স্টাডি প্রকাশিত হয় । ন্যান ইউ ও তার সঙ্গীরা অন্য আর এক হাসপাতালে ৭ জন করোনায় আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলার উপর এই রিসার্চটি করেন। তারাও ঠিক একই ধরনের লক্ষণ, ফলাফল পান। এই গবেষণায় চিকিৎসার দিক টি তুলে ধরা হয়।
উপরে উল্লেখিত গবেষণাগুলো মূলত গর্ভকালীন ৩৬/৩৭ সপ্তাহের মহিলাদের উপর করা হয় যারা ঐ সময় হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কি ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে তা জানা যায়নি এখনও। তবে সুখের বিষয় কোন আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলা মৃত্যুবরণ করেনি বা জন্মদানের পর করোনায় আক্রান্ত কোন মায়ের মৃত্যু হয়নি।
কোভিড নাইনটিন বা করোনায় আক্রান্ত প্রেগন্যান্ট মহিলাদের যে সব ব্যবস্থাপনা দেয়া হয়-
* আইসোলেশন
* অক্সিজেন থেরাপি
* মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম এপ্রোচ- সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দেয়া হয়
* নির্দিষ্ট কোন ওষুধ ব্যবহারের কথা উল্লেখ্য নেই। তবে ন্যান ইউ এর স্টাডিতে এনটি ভাইরাল আর এন্টিবাইওটিক ও সিজারের পর করটিকো স্টেরয়েড ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তারা দুজন রোগীর ক্ষেত্রে চাইনিজ মেডিসিনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ্য করেছেন যদিও এ ধরনের চিকিৎসার কোন উপকারিতা প্রমাণিত নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে করটিকো স্টেরয়েড ব্যবহারের কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছে। মূলত প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে মেডিসিন ব্যবহারে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
উপরে উল্লেখিত গবেষণাগুলো ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন করোনায় আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিশেষ এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে এই ধরনের রোগীদের ঘন ঘন ফলো আপ, কাউন্সিলিং, স্পেশাল প্রটেকটিভ পোশাক ও বিশেষ যত্ন নেয়ার জন্য বলা হয়। জন্মের পর অন্তত ১৪ দিন নবজাতক বাচ্চাকে আইসলেশনে রাখতে বলা হয়েছে এবং দুধ-পান না করাতে বলা হয়েছে।
যেহেতু খুব স্বল্প সংখ্যক রোগীদের উপর গবেষণা গুলো জরুরি ভিত্তিতে করা হয়েছে তাই আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন। আরও বেশি তথ্য প্রমাণ দরকার নিশ্চিত কোন সিদ্ধান্তে আসার জন্য।
অতএব, আমরা এতটুকু আশাবাদী হতে পারি, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের নবাগত শিশু করোনায় আক্রান্ত নাও হতে পারে এবং তারা কোন রকম কমপ্লিকেশন নিয়ে নাও জন্মাতে পারে। শিশু জন্মের সাথে সাথে তাকে অন্তত ১৪ দিন আইসোলেটেড রাখতে হবে ও প্রয়োজনীয় টেস্ট করতে হবে। উপযুক্ত প্রটেকশন ব্যবস্থা না নিয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করানো যাবে না।
আমাদের সচেতনতাই বাঁচাতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ।
লায়লা আরজুমান্দ
পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট, নর্থ সাউথ উনিভারসিটি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন