শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

হযরত ফাতেমা রা.-এর জীবনাদর্শে নারী মুক্তি

প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফিরোজ আহমাদ

পরিচয় : হযরত ফাতেমা (রা.)। ইসলামের ইতিহাসে স্বীকৃত চারজন নারীর মধ্যে হযরত ফাতেমা (রা.) হলেন একজন। হযরত ফাতেমা (রা.) হলেন জান্নাতী নারীদের সরদার। তিনি পাকপাঞ্জাতনের একজন। হযরত ফাতেমা (রা.) হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও খাদিজা (রা.)-এর কন্যা। জান্নাতের যুবকদের সরদার হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাঈন (রা.) আম্মাজান। হযরত ফাতেমা (রা.) ২০ জমাদিউস সানি এ ধরাধামে আসেন।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর জন্ম রহস্য : নবীজির সন্তান তাহের তৈয়ব কাশেম ইব্রাহিমসহ সবাই যখন একের পর এক দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে থাকল তখন কাফেরা রাসূল (সা.) সম্পর্কে ‘আবতার’ বলে অপবাদ রটানো শুরু করল। তখন হযরত ফাতেমা (রা.)-এর জন্ম হয়েছিল। আর হযরত ফাতেমা (রা.) জন্মের পর পর কাফেরদের ‘আবতার’ বলা বন্ধ হয়ে যায়। (সূরা কাউসারে আবতারের বর্ণনা রয়েছে)। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর মাধ্যমে নবীজির বংশ ধারা দুনিয়াতে প্রসার লাভ করে।
হযরত ফাতেমা (রা.) নামের গুণাবলী : এ নামের গুণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত ফাতেমা (রা.) সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন।  হযরত ফাতেমা (রা.)-এর মূল নামের পাশাপাশি বিভিন্ন পুস্তকাদিতে তার  ৮০টি আরো গুণবাচক সিফাতী নাম পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হলো : খাতুন, জান্নাত, সৈয়্যদা, মাসুমা, আবেদা, তাহিয়্যা, মসতুরা, যাকিয়া, শরিফা, হালিমা, নসিবা, যুহরা, সালিহা, শাফিয়া, ওসিলা, হাসিবা, বতুল, রাজিয়া, মর্জিয়া।
হযরত ফাতেমা (রা.) নামের ভাবার্থ : প্রিয় নবী (সা.) হযরত ফাতেমা (রা.) নাম রেখেছিলেন। ফাতেমা নামের অর্থ উদ্ধারকারিণী, পৃথককারিণী। তার গুণবাচক নামগুলোর বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। যেমনÑ জোহরা অর্থ হলো কুসুম কলি। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর চরিত্র ছিল ফুলের কুসুম কলির ন্যায় সুষমা ম-িত। যাকিয়া অর্থ হলো সতী। হযরত ফাতেমা (রা.) ছিলেন সতী সাধ্বী। রাজিয়া, মর্জিয়া অর্থ হলো আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা। হযরত ফাতেমা (রা.) আল্লাহর ওপর সকল কিছুতে তাওয়াক্কুল করতেন। বতুল অর্থ হলো ভোগ লিপসা বর্জনকারী। হযরত ফাতেমা (রা.) নবীজির কন্যা হওয়ার পরও তার কোনো লোভ-লিপসা ছিল না।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর চারিত্রিক গুণাবলী : হযরত ফাতেমা (রা.)-এর চারিত্রিক গুণাবলী অতুলনীয়। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর তুলনা তিনি নিজেই। ফাতেমা অর্থ হলো পৃথক। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর চারিত্রিক দৃঢ়তা পৃথিবীর সব নারী থেকে পৃথক। তিনি ধৈর্যশীল ছিলেন। পর্দানসীন ছিলেন। স্বামী ভক্ত ছিলেন। ইবাদতকারিণী ছিলেন। পবিত্র ছিলেন। নবীজির কন্যা এরূপ কোনো অহংকার ছিল না।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর ধর্মীয় শিক্ষা : হযরত ফাতেমা (রা.)-এর শিক্ষক ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি সব আমল আখলাক সরাসরি নবীজির নিকট থেকে শিক্ষালাভ করেছেন।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর শাদী মোবারক : হযরত ফাতেমা (রা.) বিবাহের জন্য উপযুক্ত হলে বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসতে থাকে। নবীজি সবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। নবীজি তার দুলালীকে হযরত আলী (রা.)-এর সাথে শাদী দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবীজি বলেছিলেন, হযরত আলীর জন্ম না হলে হযরত ফাতেমা (রা.)-এর শাদী মোবারকের জন্য কোনো পাত্র পাওয়া যেত না। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বয়স যখন ১৫ বছর ৫ মাস তখন হযরত আলী (রা.)-এর সাথে শাদী মোবারক সম্পন্ন হয়।
কোরআনের আলোকে হযরত ফাতেমা (রা.)-এর মর্যাদা : আল কোরআনে নবীজির পরিবারভুক্তদের আহলে বাইত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আহলে বাইতের মর্যাদা ও পবিত্রতা সম্পর্কে কোরআনে স্বীকৃতি রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আহলে বাইত! আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে সকল প্রকার পাপ-পন্কিলতা থেকে মুক্ত ও পূত-পবিত্র রাখতে চান’। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৩)। আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসূল! আপনি বলে দিন, আমি এর (দ্বীন প্রচারের) বিনিময়ে তোমাদের নিকট হতে আমার আহলে বাইত তথা আওলাদে রাসূলের ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিদান চাই না’। (সূরা শুরা, আয়াত : ২৩)।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর দানশীলতা : হযরত ফাতেমা (রা.) দানশীলতার জন্য ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মতো দানশীল নারী দ্বিতীয় কাউকে আর দেখা যায় না। একদিন হযরত ফাতেমা (রা.)-এর ঘরে কোনো খাবার নেই। ঘরের মধ্যে ইমাম হাসান, ইমাম হোসাঈন, হযরত আলীসহ সবাই অভুক্ত ছিলেন। তিনি কিছু খাবার সংগ্রহের জন্য হযরত রাসূল (সা.)-এর নিকট গেলেন। নবীজি খাবার না দিয়ে উল্টো দুজন মেহমান হযরত ফাতেমা (রা.)-এর ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা খাবারের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও খাবার দান করেন- মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে’। (সূরা দাহর, আয়াত : ৮)
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর উদারতা : হযরত ফাতেমা (রা.) শাদী মোবারকের দিন এক ব্যক্তি এসে তার নিকট নতুন কাপড়ের জন্য আকুতি জানায়। বিয়ের শাড়ি ব্যতীত হযরত ফাতেমা (রা.)-এর নিকট নতুন কাপড় ছিল না। হযরত ফাতেমা (রা.) আগন্তুককে নিজের বিয়ের শাড়ি দিয়ে দেন। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা উদারতার দৃশ্যে অবলোকন করে হযরত ফাতেমা (রা.) জন্য হযরত জিব্রাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে জান্নাত থেকে একটি নতুন শাড়ি প্রেরণ করেছিলেন। জান্নাতী শাড়ি পরে হযরত ফাতেমা (রা.)-এর শাদী মোবারক সম্পন্ন হয়েছিল।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর তাসবিহ : ঘরের কাজ করতে গিয়ে হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। হযরত ফাতেমা (রা.) একদিন নবীজির নিকট একজন দাসীর জন্য গিয়েছিলেন। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর মুখ থেকে দাসীর কথা শোনামাত্র নবীজি বললেন, আমার নিকট তোমরা যা কিছু দাবি কর এর চেয়ে উত্তম বস্তু নেয়ার মতো তোমরা রাজি আছো কি? অতঃপর হযরত রাসূল (সা.) বললেন, হযরত জিব্রাঈল (আ.) আমাকে প্রত্যেক নামাজবাদ তিনটি বাক্য পাঠ করার জন্য বলেছেন। এ উত্তম বাক্য (বস্তু) তিনটি হযরত রাসূল (সা.) তাঁর আদরের দুলালী হযরত ফাতেমা (রা.)-কে প্রত্যেক ফরজ নামাজবাদ ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আলাহু আকবার পড়ার জন্য নির্দেশ করেছিলেন। যা পরবর্তীতে তাসবিহে ফাতেমী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই তাসবিহ আজও বিশ্বের সব মুসলমানের নিকট সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় আমল।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর ধৈর্য : হযরত ফাতেমা (রা.)-এর দাসী ছিল না। তিনি নিজেই একা পরিবারের সব কাজ করতেন। হযরত ফাতেমা (রা.) নিজ হাতে আটা পিষাতে গিয়ে যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। কুয়া থেকে মশক (কলস) দিয়ে পানি টানতে টানতে হযরত ফাতেমা (রা.) বুকের মধ্যে রশির দাগ পড়ে গিয়েছিল।
স্বামীর আদেশ পালনে হযরত ফাতেমা (রা.) : হযরত আলী (রা.) অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল ছিলেন। ঘরের মধ্যে বিছানাপাতি পর্যন্ত ছিল না। হযরত ফাতেমা (রা.) স্বামীর সংসারে থাকাকালীন কোনো দিন চিন্তাও করেননি যে তিনি নবীজির কন্যা। হযরত রাসূল (সা.)-এর কন্যা হওয়া সত্ত্বেও হযরত আলী (রা.)-এর আদেশ ব্যতীত ঘর থেকে বের হয়ে নবীজির নিকট আসতেন না।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর ইবাদত বন্দেগী : হযরত ফাতেমা (রা.)-এর কান্না ইতিহাস স্বীকৃত। তিনি নামাজে দাঁড়ালে কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে নফল রোজা মানত করতেন। ফরজের পাশাপাশি নফল নামাজ পড়তেন। কোরআন তেলাওয়াত করতেন। স্বামীর সেবা, সংসারের কাজকর্ম ও বংশ মর্যাদা কোনো কিছুই হযরত ফাতেমা (রা.)-কে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিরত রাখতে পারেনি।   
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর খোঁজে : কালের বিবর্তনে সমাজের আচরণের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং ভবিষ্যতে পরিবর্তনের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু কোরআনের বিধিবিধান সব সময়ের জন্য স্থির থাকবে। নামাজের নিয়ত অতীতে যা ছিল, বর্তমানেও ঠিক তা আছে এবং ভবিষ্যতেও একই রকম থাকবে। ইসলাম হলো সুন্দর ও সৌহার্দ্যরে প্রতীক। যখন আরবে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। যৌনাচারের ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে নারীকে ব্যবহার করা হতো। তখন দ্বীন দুনিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত মুহাম্মদ (সা.) ধরাধামে আগমন করেন। তিনি প্রথম মুসলিম আইন প্রতিষ্ঠা করে নারীদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করছেন। সবাইকে জানিয়ে দেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। নারী ও পুরুষ একে অপরের অংশ। পৃথিবীর সব মানুষকে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ইসলামের দাওয়াতী কাজে নারীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর নেতৃত্বে মহিলারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
সুজন ৭ জানুয়ারি, ২০২০, ২:৫৮ এএম says : 0
অনেক সুন্দর লিখেছেন আপনাকে ধন্যবাদ...!
Total Reply(0)
সোহাগ মজুমদার আজিম ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ২:৪২ এএম says : 0
বাপতে চি মেয়ের নাম রাখবো বাকিটা উপর আলা জানে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন