বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছেই

জাঁকজমকে ঈদ করার চেয়ে জীবন বড় : প্রফেসর ডা. আব্দুল্লাহ, ঝুঁকিপূণ দেশের সকল এলাকাই এখন : ডা. বে-নজির আহমেদ

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০২০, ১২:০৭ এএম

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে গত ৮ মার্চ। বর্তমানে ভাইরাসটি সারদেশে কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশ লকডাউন ঘোষণা করা হয়। বন্ধ করা হয় গণপরিবহন ও অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে মাঝে কিছুটা শিথিল থাকায় বিভিন্নভাবে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে। আবার ঈদকে সামনে রেখে নানা অজুহাতে ও বিভিন্ন উপায়ে ঢাকা ছাড়ে মানুষ। অনেক মানুষ ঢাকা ছাড়ার পর টনক নড়ে প্রশাসনের। প্রশাসন থেকে ঢাকায় প্রবেশ ও ঢাকা থেকে বাইরে আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেরি চলাচল। কিন্তু গত বৃহষ্পতিবার রাত থেকে আবারও ঢাকা থেকে নিজস্ব পরিবহনে সারাদেশে মানুষদের যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে গ্রামমুখী মানুষের ঢল নামে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্তে করোনাভাইরাস সারাদেশে আরও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়বে। বাড়বে ঝুঁকি। যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে পড়বে কষ্টসাধ্য।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাস নিজে থেকে কোথাও যেতে পারে না। কোথাও যেতে হলে তার বাহক প্রয়োজন হয়। রাজধানীর মানুষ বাহক হয়ে এই সুযোগে সারাদেশে ব্যপকহারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিবে। ঈদের আনুষ্ঠানিকতা এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে এই সময় শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখা অনেকের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাছাড়া ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় বয়স্ক ও শিশুসহ আক্রান্তদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সবকিছু মিলিয়ে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশি বাধা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর ছাড়ার ব্যাপারে পুলিশ কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছে, লোকজন ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি ফিরতে পারবে। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। ঘরমুখো মানুষদের বাধা না দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সদস্যদের বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই রাজধানীতে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো চেকপোস্টগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ১৭ মে থেকে ঢাকায় প্রবেশ ও ঢাকা থেকে বাইরে আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। নগরীতে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নানা অজুহাতে ও বিভিন্ন উপায়ে ঢাকা ছাড়ছিল মানুষ। গতকাল শুক্রবার সকালে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নতুন নির্দেশনা অনুযায়ীই ইতিমধ্যে কাজ করছেন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ২৪ জন। এ পর্যন্ত একদিনে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ নিয়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৩২ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে এক হাজার ৬৯৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩০ হাজার ২০৫ জন।
ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি যাওয়ার বিষয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউ অব প্রিভেন্টিভ এন্ড সোসাল মেডিসিন (নিপসম) এর পরিচালক প্রফেসর ডা. বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ বলেন, কোন ভাইরাস নিজে থেকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলাচল করতে পারে না। এজন্য তার বাহকের প্রয়োজন হয়। রাজধানীতে যখন ঝুকিপূর্ণ জনগোষ্টি প্রত্যন্ত এলাকায় যাবে তখন তারা ভাইরাসের বাহক হিসাবে কাজ করবে। এভাবেই ভাইরাসটি দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বে।
যদিও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে এবং দেশের মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়ে এ বছর নিয়ন্ত্রিতভাবে ঈদ করার অনুরোধ জানান তিনি। প্রফেসর ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, জাঁকজমক করে ঈদ করার চেয়ে জীবনটা বড়। বেঁচে থাকলে উৎসব করে ঈদ আবার করা যাবে। কিন্তু ঈদ করতে গিয়ে যেন জীবন ঝুঁকিতে না পড়ে সেদিকে সবার নজর দিতে হবে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে সরকার প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব অফিস-আদালত বন্ধ রাখার ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এরপর ধাপে ধাপে সেই ছুটির মেয়াদ ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বিপণি বিতান ও দোকানপাট, মসজিদ এবং পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে কিছু বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়া হলেও আন্তজেলা বাস ও গণপরিবহনে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। নতুন করোনাভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক বলেই সরকারের তরফ থেকে এসব বিধিনিষেধ জারি করা হয়। যাতে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের এলাকাগুলো থেকে ঈদের সময় মানুষের সঙ্গী হয়ে গ্রামে গ্রামে এ রোগ ছড়িয়ে না পড়ে। গত ১৪ মে সর্বশেষ ছুটির আদেশে বলা হয়, সাধারণ ছুটি/চলাচলে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কেউ কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে না। উক্ত সময়ে সড়কপথে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী নৌযান ও রেল চলাচল এবং অভ্যান্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে এবং মহাসড়কে মালবাহী/জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন ব্যতীত অন্যান্য যানবাহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ওয়াল্ডোমিটারের গতকালের তথ্য অনুসারে বর্তমানে করোনা সংক্রমনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থায় ২৮ তম। গত ১৯ মে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩০ নম্বরে। গত ৩ মে ছিল ৩৯ নম্বরে এবং গত ৫ এপ্রিল সংক্রমণের দিক থেকে দেশের অবস্থান ছিল ১১৭ নম্বরে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় কি বিপুল গতিতে বাংলাদেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ৫ এপ্রিল ১১৭ নম্বর থেকে ৮৭ টি দেশকে টপকে ২৮ স্থান দখল করেছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তর বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রন শাখার সাবেক পরিচালক প্রফেসর ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এখনো দেশের ৮০ ভাগ জনপদ করোনা মুক্ত রয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে দেশের সকল এলাকাই ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ এই ৮০ ভাগ জনপদ সুরক্ষা করতে পারলে সংক্রমণ নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ রাখা সম্ভব হতো। তিনি বলেন, শুধুমাত্র মাস্ক আর গøাভস পরলেই করোনা থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব নয়। তাহলে এতো সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হতো না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গত বছর ঈদে বাড়ি ফেরাকে কেন্দ্র করে ডেঙ্গু ভাইরাস যেভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, একবার ঠিক একই ভাবে করোনাভাইরাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকাই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এসব এলাকায় যারা বসবাস করেন তারা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্টি হিসেবে চিহ্নিত।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে যারা বাড়ি যাচ্ছেন তাদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব হবে না। এই সুযোগে অনেকেই সিএনজি বা হোন্ডা নিয়েও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। এক্ষেত্রে ঝুকি আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে একমত পোশন করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, আমারা বলেছি ঘরে থাকতে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে, নয়তো করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যাবে না। এর ব্যতিক্রম হলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে- এটাই স্বাভাবিক।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন