বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করতে হবে যৌথভাবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২০, ১২:১৪ এএম

বিশুদ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ ও নিরাপদ পানীয় জল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং নিরাপদ বাসস্থান এই মৌলিক চাহিদাগুলোকে প্রভাবিত করছে জলবায়ুর পরিবর্তন। সা¤প্রতিক অতীতে, বছরে অতিরিক্ত ১,৪০,০০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সংবেদনশীল স্বাস্থ্যসমস্যাগুলো, যেমন অপুষ্টি, ডায়েরিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি ভয়াবহ আকার নিতে চলেছে। আগে পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে ভৌগোলিক কারণে এগুলোর প্রকোপ ছিল না বা কম ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনে সেই অঞ্চলগুলোতে নতুন স্বাস্থ্যসমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই সমস্যার আকস্মিকতা ও ব্যাপ্তি সামলানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। শুধু মাত্র রোগের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, পরিবেশকে শীতল ও নির্মল করার সমস্ত উদ্যোগের পাশাপাশি, উন্নততর যাতায়াত, খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবহার ইত্যাদি সমস্যারও এই নতুন দিকটিকে অনেকটা সামাল দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যার মূলে যে জলবায়ু পরিবর্তন সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশবিরোধী নানারকম ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি ‘গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোতে উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে যার ফলে বায়ুমন্ডলের নিচের স্তরে উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি, পরিমাণ এমনকি ঋতুছন্দও। গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর উষ্ণতা প্রতি দশকে প্রায় ০.১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়ে চলেছে। গলে যাচ্ছে হিমবাহ ও মেরু প্রদেশের বরফ। সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। প্রসঙ্গত, এশিয়া অঞ্চলের সমুদ্রতল ৪০ সেন্টিমিটারের বেশি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়ার চরমতা প্রায়শই লক্ষ করা যাচ্ছে। ঠান্ডা বা গরমের তীব্রতা লক্ষণীয়ভাবে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকমের স্বাস্থ্যসমস্যা ডেকে আনছে। যেমন, তীব্র গরম, কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক মানুষ বেশি সংখ্যায় এর শিকার হচ্ছে। উচ্চ তাপমাত্রা, বায়ুতে ওজোন এবং অন্যান্য দূষণের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছে। এই ধরনের দূষিত আবহওয়া শহরাঞ্চলে অ্যাজমার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে আজ প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এর শিকার।
জলবায়ুর পরিবর্তনে, গত অর্ধ-শতাব্দীতে আবহাওয়া সংক্রান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বেড়ে গিয়েছে। প্রধানত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ধরনের বিপর্যয় প্রত্যেক বছর প্রায় ষাট হাজার মানুষের প্রাণ সরাসরি কেড়ে নিচ্ছে। প্রচলিত চিকিৎসা ও পরিকাঠামো এ ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর হচ্ছে না। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি ও আবহাওয়া সংক্রন্ত নানা দুর্যোগ বিশেষ করে ক্ষতি করছে তাঁদের, যাঁরা সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে বাস করেন। প্রসঙ্গত, পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সমুদ্র থেকে ৬০ কিমি-র মধ্যে বসবাস করেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে এরা নিজেদের বাসস্থল থেকে দূরে সরতে বাধ্য হলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা ও সংক্রামক ব্যাধিসহ অজানা পরিবেশের শিকার হতে পারে ।
বৃষ্টিপাতে প্রকৃতি ক্রমাগত বদলে যাওয়ার কারণে আগামী দিনে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার সমস্যা তীব্রতর হতে পারে। পুকুর, খাল, বিল, নদী ইত্যাদির পানির অন্যতম উৎস বৃষ্টি। বৃষ্টি প্রধান উৎস ভৌম পানি, যে পানি আমরা পান করি এবং কৃষিক্ষেত্রে সেচের কাজে ব্যবহার করি। সুতরাং বিশুদ্ধ পানির অভাব বা সমস্যা হলে মানুষ পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হবে। বাড়বে ডায়েরিয়ার ঝুঁকি, যে রোগে প্রত্যেক বছর প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ মারা যায়। আবার পানির অভাব তীব্র হলে খরা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন, ২০৯০ সালের মধ্যে, খরাগ্রস্ত এলাকাকে অনেক বাড়িয়ে দেবে। ঘনঘন দেখা দেবে তীব্র খরা। প্রকৃতপক্ষে এর সম্ভাবনা প্রায় ২ গুণ বেড়ে যাবে আর খরার গড় সময়কাল বেড়ে যাবে ৬ গুণ। অন্যদিকে, বন্যার সংখ্যা ও ভয়াবহতাও বাড়বে। এর ফলে যেমন পানি দূষিত হয়ে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ বাড়বে, তেমনই বন্যা পরবর্তী জমা পানিতে মশা ও নানা কীটপতঙ্গের রমরমায় বাড়বে এগুলো সম্পর্কিত নানারকম রোগ। এ ছাড়া, বন্যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে একদিকে যেমন জীবন ও সম্পত্তিহানি ঘটবে, অন্যদিকে তেমন যাতায়াত ও চিকিৎসা পরিষেবাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সব থেকে বড় কথা হল, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যথেষ্ট কমে যাবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ২০২৫ সালের মধ্যে আফ্রিকার অনেক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমলে সার্বিকভাবে বাড়বে অপুষ্টি, যাতে এখনই বছরে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবিত হচ্ছে নানারকম কীটপতঙ্গ। শামুক জাতীয় প্রাণী ও বিভিন্ন শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী, যাদের মাধ্যমে সাধারণভাবে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হয়। প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তিত জলবায়ু, সংক্রমণের আদর্শ সময়কালকে দীর্ঘায়িত করছে, বাড়ছে রোগাক্রমণের ভৌগোলিক সীমাও। চীনে শামুকজাতীয় প্রাণীবাহিত সিস্টোসোমিয়াসিস রোগ অনেকটা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রত্যেক বছর মারা যাচ্ছে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ছাড়াচ্ছে দ্রæত। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, ২০২২ সালের মধ্যে আরও অতিরিক্ত ২ বিলিয়ন মানুষের ডেঙ্গু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি রোগের প্রকোপের সরাসরি সম্পর্ক লক্ষ করা গিয়েছে। যেমন, অতিরিক্ত উষ্ণতা ও তাপমাত্রায় অনেক সময় কলেবার মতো ব্যাকটেরিয়াজাত সংক্রমণ মহামারীর আকার নিতে পারে। একইভাবে বেড়ে যেতে পারে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া। উষ্ণ ও শুঙ্ক সময়কালে সাহারাসংলগ্ন আফ্রিকায় প্রকোপ বাড়ে বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজাত এক ধরনের মেনিনজাইটিস। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়া-কমার ক্ষেত্রেও উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের তারতম্যের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট। কিউলেক্স মশাবাহিত জাপানি এনসেফেলাইটিসের বাড়-বাড়ন্ত লক্ষ করা যায় বর্ষার আবহাওয়ায়, যখন বেশি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে তাপমাত্রা অন্তত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কার্যকারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত। একপক্ষ মনে করেন, মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলেই এই অবাঞ্ছিত পরিবর্তন। অন্যদল মনে করেন, পৃথিবীতে মানুষ আবির্ভাবের অনেক অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ভূ-তাত্তি¡ক যুগে, প্রাকৃতিকভাবেই কখনও পৃথিবী উষ্ণ হয়েছে, কখনও শীতল। তবে কারণ যাই হোক না কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্যতা এবং তার ফলস্বরূপ নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যা ক্রমশ একটা চ্যালেঞ্জ হয়েই দেখা দিচ্ছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে করণীয় কী? প্রাথমিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করা দরকার। তারপর স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ক একটি নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রক্রিয়াটিকে সার্বিক রূপ দিতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এক্ষেত্রে সমন্বয় করে উন্নত করতে হবে। আবহাওয়ার চরমতা ও তৎপরবর্তী সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পরিকল্পনাগুলোকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণের আরো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় বিশেষীকরণ এবং পরিবেশনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য-সমস্যা যেমন একটি আঞ্চলিক ইস্যু, একই সঙ্গে এটি একটি গেøাাবাল ইস্যুও। কারণ শেষমেশ ‘প্রকৃতি’ গোটা বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই পৃথিবীর সমস্ত দেশ, সমস্ত সরকারকে অন্তত এই একটি বিষয়ে এক হয়েই কাজ করতে হবে। না-হলে সমস্যাটির মূলে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তবে বাংলাদেশের মতো, একই সঙ্গে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় ও জনবহুল দেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যসমস্যা বিষয়ে উপযুক্ত গণ-সচেতনতা সবার আগে প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো নিঃসন্দেহে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। আমাদের দেশ ছোট্ট। জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটির মতো। কাজেই জনভারে আমরা জর্জরিত। আমরা যে যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি যে অবস্থানেই থাকি না কেন আমাদেরকে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে, যার উপর আগামী দিনে দেশের জনসাস্থ্যের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সদস্য, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন কমিটি, সিলেট।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন