শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

লিবিয়ায় যেভাবে হত্যা করা হলো ২৬ জন বাংলাদেশিকে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২০, ৫:৫৯ পিএম

লিবিয়ায় নৃশংসভাবে নিহত হওয়া ২৬ জন বাংলাদেশি মানব পাচারকারী চক্রের হাতে অপহৃত হওয়ার পর অপহরণকারীদের হাতে খুন হয়েছেন বলে জানিয়েছে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস।

যদিও লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার জানিয়েছে, লিবিয়ার একজন মানব পাচারকারীকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে হত্যা করেছে ঐ পাচারকারীর পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশি বাদে মারা যাওয়া অন্য ৪ জন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন আহত বাংলাদেশি নাগরিকের সূত্রের বরাত দিয়ে লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম বিষয়ক কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, মারা যাওয়া ২৬ জনসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি ও কিছু সুদানি নাগরিক প্রায় ১৫ দিন ধরে ঐ অপহরণকারী চক্রের হাতে আটক ছিলেন। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদায় আটক করে রাখা হয়েছিল তাদের। আশরাফুল ইসলাম জানান, সেখানেই ২৮শে মে সকালে বন্দীদের ওপর গুলি চালায় অপহরণকারীরা।

কীভাবে অপহরণকারীদের কবলে পড়লেন তারা?
মূলত লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশ করাই লক্ষ্য ছিল ৩৮ বাংলাদেশির। এজন্য বেনগাজীর আবদুল্লাহ নামের একজন বাংলাদেশি নাগরিক তাদের ত্রিপলির উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেন। কিন্তু চারটি গাড়িতে করে ত্রিপলি যাওয়ার পথে অপহরণকারীদের কাছে মিজদা শহরে জিম্মি হয়ে পড়ে দলটি। সেখানে মাথাপিছু ৭ হাজার ডলার মুক্তিপণের দাবিতে শারীরিক নির্যাতন করা হয় তাদের ওপর। এক পর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নির্যাতনকারীর ওপর চড়াও হয় জিম্মিরা, ফলে সেখানেই মৃত্যু হয় জিম্মিকারীর। এই মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রতিশোধ নিতে আসে নিহতের পরিচিতরা। তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ২৬ বাংলাদেশি। আহত হন আরও ১১ জন। ঘটনাস্থল থেকে জীবন বাঁচিয়ে পালানো অবশিষ্ট একজন বাংলাদেশির কাছ থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
আশরাফুল ইসলাম জানান, "করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জটিলতা শুরু হওয়ার আগে ডিসেম্বর মাসে তারা ভারত ও দুবাই হয়ে বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছান।" এরপর গত কয়েক মাস তাদেরকে লিবিয়ার ভেতরে গোপনে রাখা হয়েছিল।

উপকূলীয় অঞ্চল যুওয়ারা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে ইতালির দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল পাচারকারীদের।
"বছরের এই সময়টায় সাগর অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় এটিকেই সাগর পাড়ি দেয়ার আদর্শ সময় বলে মনে করা হয়। কিন্তু প্রচলিত ও ব্যবহৃত পথে না গিয়ে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বেশ বিপদসংকুল একটি পথে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল," বলেন আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বলেন যুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় একাধিক সরকার থাকায় ত্রিপলি হয়ে যুওয়ারা যাওয়ার প্রচলিত পথে নানা রকম তল্লাশি হয়। সেই পথ এড়িয়ে কম ব্যবহৃত মরুভূমির মধ্যকার রাস্তা দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে যুওয়ারা যাচ্ছিলেন পাচারকারীরা।

"কিন্তু ঐ মরুভূমির পথ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণাধীন, যারা সরকারহীনতার সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে অনেকদিন ধরে। সন্ত্রাসী ও অপহরণকারীদের একাধিক গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনাও ঘটে থাকে।" বেনগাজি থেকে মরুভূমির রাস্তায় যুওয়ারা যাওয়ার পথে তারা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন।
অপহরণের পর মিজদাতেই প্রায় ১৫ দিন অপহরণকারীদের জিম্মায় ছিলেন অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশি ও সুদানি নাগরিকরা।
"অপহরণকারীদের সাথে আটক হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষি চলছিল। আটককৃতদের অনেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেও কাক্সিক্ষত মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয় তারা", জানান আশরাফুল ইসলাম। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আাটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে অপহরণকারীরা।
"এক পর্যায়ে বাংলাদেশিদের সাথে থাকা সুদানি নাগরিকরা অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে মেরে ফেলেন। এরপর অপহরণকারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে ৩৮ জন বাংলাদেশির সবাই গুলিবিদ্ধ হয়। মারা যায় ২৬ জন।"

"গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় কয়েকজন ভিতরেই পড়েছিল, দুই-একজন আহত অবস্থায় বের হয়ে আসে। তাদের দেখে স্থানীয় লোকজন সেনাবাহিনীকে খবর দেয় এবং সেনাবাহিনী তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।"
আশরাফুল ইসলাম জানান, আহত বাংলাদেশিদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে লিবিয়ার একটি সংবাদ মাধ্যম আল-ওয়াসাত খবর প্রকাশ করেছে যে মোহাম্মদ আব্দুল রহমান, যিনি একজন মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিত, অজানা কারণে শুরু হওয়া এক 'বিদ্রোহে' মারা যান। এরপর তার পরিবারের সদস্যরা ঐ ভবনটি ঘেরাও করে এবং মরদেহ ফিরে পাওয়ার জন্য আলোচনা শুরু করে।
এক পর্যায়ে ঐ ভবনে উপস্থিত ১০০ জন অভিবাসী আত্মসমর্পণ করেন, কিন্তু ৪০ জন ভবন ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ঐ ভবনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও রকেট দিয়ে হামলা করার পর ভবনের ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা নিহত হন। তবে অন্য কোন সূত্র থেকে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
লিবিয়াতে এখন যার হাতে যত বেশি অস্ত্র , তার শক্তি এবং প্রভাবও তত বেশি। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন লিবিয়া এখন অস্ত্রের বাজারে পরিণত হয়েছে। আর অস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে পুরো দেশেই বিভিন্ন পন্থী ছোট ছোট মিলিশিয়া গ্রুপ তৈরি হয়েছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, "এখানে অপহরণকারী চক্র খুবই শক্তিশালী। তারা এখানে সেনাবাহিনীর সাথেও কখনো কখনো মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনীও পিছু হটতে বাধ্য হয়।"

"এই মিলিশিয়ারা এখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সামনে অসহায়।"
আশরাফুল ইসলাম বলেন, লিবিয়ায় একক সরকার ব্যবস্থা না থাকায় মিলিশিয়া বাহিনীগুলো মানব পাচার ও অপহরণের মত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। আর দেশটির আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ায় মিলিশিয়াদের তৎপরতার বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না তারা। তথ্যসূত্র : বিবিসি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন