শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ

| প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০২০, ১২:০২ এএম

গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশের হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক আফ্রিকান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের মৃত্যু হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসের বাইরে হাজার হাজার মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। এদিন বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে মিনেসোটা, নিউইয়র্ক এবং ক্যালিফোর্নিয়া। গতকালও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ফ্লয়েডের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ২০ ডলারের একটি জালনোট ব্যবহার করেছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের গাড়িতে নেওয়ার আগে, এক ভিডিওতে দেখা যায়, ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে আছে এক পুলিশ কর্মকর্তা। এতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ফ্লয়েড মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি ফ্লয়েডকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্মম এ ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। একটানা বিক্ষোভ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের হুমকি দেন। বিক্ষোভকারীদের গুন্ডা আখ্যা দিয়ে টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, যে কোনও জটিলতা আমরা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারি, তবে যখনই লুটপাট শুরু হবে তখনই গুলি শুরু হবে। বিক্ষোভকারীরা হিংস্র অপরাধী। জর্জ ফ্লয়েডের স্মৃতির প্রতি এসব গুন্ডা অসম্মান দেখাচ্ছে, আর আমি তা হতে দিতে পারি না। অবশ্য ট্রাম্পের পোস্টের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এতে জনস্বার্থ নোটিশ যুক্ত করে দেয় টুইটার। কোম্পানিটি বলছে, অন্যদের সহিংস কর্মকণ্ডে উৎসাহিত হওয়া ঠেকানোর স্বার্থে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিষয়টি বহু বছর ধরে চলে আসছে। তবে সভ্যতার ধারাবাহিকতায় তা কমে এলেও একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। বহুজাতিক দেশ হিসেবে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আবাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পরিচিতি পেলেও সেখানে বর্ণবাদ বেশ ভালভাবেই রয়ে গেছে। প্রায়ই তা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং এতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার উস্কানি দেয়ার অভিযোগও ওঠে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এ প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার পেছনে বর্ণবাদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে সে সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিশ্লেষকরা বলেছেন। সে সময় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও ওঠে এবং সে নিজেও নির্বাচনী প্রচারণায় অভিবাসী বিরোধী অবস্থান নিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হবে শুধু আমেরিকানদের। তার এ বক্তব্য ছিল বর্ণবাদের চরম বহিঃপ্রকাশ। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই মূলত বহুজাতির অভিবাসীর স্থান হিসেবে যে সুনাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, তা আহ্বান হতে শুরু করে। তার বক্তব্যে সে সময় উগ্র শ্বেতাঙ্গ সংগঠন কে.কে.কে. (কু ক্লাক্স কস্ন্যা) তৎপর হয়ে উঠে এবং অশ্বেতাঙ্গদের ওপর চড়াও হতে শুরু করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শুধু আমেরিকানদের’, ট্রাম্পের এ শ্লোগান তার জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা মনে করেছিলেন, এটা তার বিজয়ী হওয়ার কৌশল হলেও ক্ষমতায় গিয়ে তিনি আমেরিকার চিরায়ত বহুজাতিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখবেন। তাদের এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন বর্ণবাদ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। আর এতে ট্রাম্পের যে নীরব সমর্থন রয়েছে, তা তার টুইট করা থেকেই বোঝা যায়। ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের যে ভাষায় আক্রমণ করে টুইট করেন, তাতে তার বর্ণবাদী মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশে এমন মানসিকতার একজন প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তা কল্পনাও করা যায় না। প্রেসিডেন্ট যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, তিনি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে সমান হবেন। শুধু নিজ দেশেই নয়, সারাবিশ্বে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন, এটাই স্বাভাবিক। দুঃখের বিষয়, ট্রাম্পের আচরণে তা প্রকাশিত হয়নি এবং হচ্ছে না। এমনকি বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কাছে তিনি অগ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো আচরণ করছেন। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র নিজের মানবাধিকার এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করতে না পারলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ছুঁতোনাতায় মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত হয়ে যাচ্ছে বলে, উদ্বেগ প্রকাশ, বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া থেকে শুরু করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকি দিয়ে থাকে। হংকংয়ে চীনের এক্সট্রাডাইট বিল পাস হওয়া নিয়ে যে আন্দোলন চলছে, তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগের সীমা নেই। অথচ নিজ দেশেই বর্ণবাদের যে নিষ্ঠুরতা চলছে, তা নিয়ে তার কোনো বিচলন নেই। অর্থাৎ দেশটি নিজ ঘরের আগুণ না নিভিয়ে পরের ঘরের আগুণ নিভানোর মতো দ্বিচারী নীতি অবলম্বন করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের মানসিকতা দুঃখজনক।
সারাবিশ্ব বরাবরই লক্ষ্য করেছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মানবতা এবং কোথায় অনাচার-অবিচার হচ্ছে, তা নিয়ে কথা বলে। তবে এক্ষেত্রে তার পক্ষে যায় এবং যা তার স্বার্থের অনুকূল, সে সেভাবেই বক্তব্য দিয়ে থাকে। বিশেষ করে বর্ণবাদের ক্ষেত্রে তাকে একচোখা নীতি অবলম্বন করতে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর যে অকথ্য নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে এবং ভারতে মুসলমানদের ওপর যেভাবে স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে, তা নিয়ে তাকে খুব বিচলিত হতে দেখা যায় না। ভারতে মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন আর যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন ও বৈষম্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দেশটিকে সবসময় নিজের ক্ষেত্রেও একপেশে নীতি অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। সাদা-কালো নাগরিকদের মধ্যকার বর্ণবাদের ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের পক্ষ নিতে দেখা যায়। সভ্যতার ধ্বজাধারী এ দেশটির এমন অশোভনীয় আচরণ কোনোভাবে কাম্য না হলেও তাই ঘটে চলেছে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রকে আগে তার নিজের আচরণ পরিবর্তন করা দরকার। তার উচিৎ ঘৃণ্য বর্ণবাদ অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তারপর অন্যদের ব্যাপারে কথা বলা। পুলিশ কর্তৃক একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশটির সচেতন ও সভ্য মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়েছে, তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে যে বা যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে বর্ণবাদীদের হুঁশিয়ার করা জরুরি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন