শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ভারতকে নিয়ে কেন অসহিষ্ণু হয়েছে চীন

বিবিসি বাংলা | প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০২০, ১২:১১ এএম

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যখন গত সপ্তাহে চীনা সেনাবাহিনীকে ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকার’ পরামর্শ দেন তাকে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক ব্যাখ্যা করেছেন সীমান্তে নতুন করে শুরু হওয়া সঙ্কটে ভারতের প্রতি চীনের প্রচ্ছন্ন একটি হুমকি হিসাবে। কারণ চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র দ্য গ্লোবাল টাইমসেও গত কয়েকদিনে ভারতকে লক্ষ্য করে একই ধরণের আক্রমণাত্মক লেখালেখি হচ্ছে।

চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন হঠাৎ করে এই করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের ভেতর এই সঙ্কট শুরু হলো কেন? পশ্চিমা এবং ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক লিখছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরে করে চলেছে।
করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সারা বিশ্ব যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বেইজিং এটাকে একটা লক্ষ্য হাসিলের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। শুধু সীমান্তে চাপ তৈরি নয়, হংকংয়ে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন। এসব পর্যবেক্ষক বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরও সঙ্কটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ-সাহায্য দিয়ে অনেকটা একইভাবে বেইজিং তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।

লাদাখে অবকোঠামো নিয়ে উদ্বিগ্ন চীন : তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকায় গত কয়েক বছর ধরে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো তৈরি করছে তাতে চীন সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। ভারতের এই কর্মকান্ড তারা আর মেনে নিতে রাজি নয়।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, চীন ও ভারতের সীমান্ত রেখা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ ঐতিহাসিক। কিন্তু গত দশ-বারো বছরে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে ভারত যেভাবে ব্যাপক হারে অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে তাতে চীন বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বিগ্ন।

তিনি বলেন, ভারতে কট্টর জাতীয়তাবাদী একটি সরকারের ক্ষমতা-গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক নৈকট্যে বেইজিংয়ের উদ্বেগ দিন দিন আরো বাড়ছে। হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমসে তার এক লেখায় সুইডিশ বিশ্লেষক বার্টিল লিনটার বলছেন, লাদাখে ভারতের সড়ক নির্মাণকে চীন একটি হুমকি হিসাবে দেখতে শুরু করেছে।

তিনি বলছেন, বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাশা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়ক চীন তৈরি করেছে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এমনিতেই এই দুটো প্রত্যন্ত প্রদেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই উদ্বেগে। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীন নামে যে এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে সেটিকে ভারত তাদের এলাকা বলে বিবেচনা করে। এলাকাটি ভারতীয় মানচিত্রের অংশ।
সুতরাং লিনটার বলছেন, সেই অঞ্চলের কাছে ভারতের অবকাঠামো নির্মাণের তৎপরতা চীন মেনে নিতে পারছে না।
ভারতের সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হবে : চীনের গ্লোবাল টাইমসে গত কয়েকদিনে বেশ কিছু সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়তে ভারতের বিরুদ্ধে এমন সব কড়া কড়া ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। গত ১৯ মে প্রকাশিত সংখ্যায় তারা লাদাখের গালোয়ান উপত্যকায় ‘অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা‘ তৈরির জন্য ভারতকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছে। লেখা হয়েছে, ‘ভারত যদি উসকানি অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হবে।’

১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের প্রসঙ্গ টানছে গ্লোবাল টাইমস। গত ২৫ মে এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্কে উত্তেজনা চলছে, তারপরও ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়কার তুলনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের অবস্থান এখন অনেক সুদৃঢ়। চীনের অর্থনীতি এখন ভারতের চেয়ে পাঁচগুণ বড়।’ চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্রে এ ধরণের কথাবার্তাকে অনেক বিশ্লেষক বিরল হুমকি হিসাবে ব্যাখ্যা করছেন।
চীন-বিরোধী অক্ষশক্তির অগ্রভাগে ভারত? : চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫ হাজার বর্গমাইল এলাকাকে ভারত তাদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে মনে করে।
১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে ভুটানের সীমান্তে দোকলাম নামক একটি এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি নিয়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ৭২ দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।

তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণ ছাড়াও ভারত চীনের জন্য অন্য মাথাব্যথারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোট বেধে চীনকে কোণঠাসা করার যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে, ভারতকে সেই জোটের অংশ হিসাবে দেখছে চীন।

ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী, যিনি ভারত-চীন বৈরিতা নিয়ে গবেষণা-ধর্মী একটি বই লিখেছেন, বিবিসিকে বলেন, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি ‘অক্ষশক্তি’ তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে।

আমেরিকা মনে করে চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত দশ বছরের তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে।
গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন লেখায় এমন কিছু মন্তব্য এবং তুলনা টেনেছে যাতে বোঝা যায় যে ভারতকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী একটি অক্ষের অংশ হিসাবে মনে করছে।
গত ২৫ মে চীনা একজন বিশ্লেষক লং শিং চুং এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন, ‘ভারত সরকার যেন তাদের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কামানোর গোলা হিসাবে ব্যবহৃত না হতে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার দুই দেশকেই সতর্ক থাকবে হবে। কারণ যে কোনো সুযোগেই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব।’

ভেঙ্গে পড়ছে সম্পর্কের স্থিতি : ১৯৮৮ সালে চীন এবং ভারতের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া হয় যে তারা সীমান্ত নিয়ে কোনো বিরোধে জড়াবে না। কারণ দুটো দেশই যাতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে পারে। কিন্তু গত ৩২ বছরে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। ১৯৮৮ সালে ভারত ও চীনের অর্থনীতি ছিল প্রায় একই মাপের। একই পরিমাণ অর্থ তারা প্রতিরক্ষায় খরচ করতো।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা এবং ক‚টনীতি বিষয়ক সাময়িকী ফরেন পলিসিতে লিখেছেন সুমিত ব্যানার্জি, ‘এখন চীনের অর্থনীতি ভারতের পাঁচগুণ বড়। প্রতিরক্ষায় ভারতের চেয়ে চারগুণ বেশি খরচ করছে চীন। সম্পর্কের হিসাব বদলে গেছে। চীন ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী। যদিও চীনের রফতানির চেয়ে অনেক বেশি আমদানি করে ভারত। গত বছর বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।

বাণিজ্য কী সঙ্ঘাত ঠেকাতে সাহায্য করবে? : ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, বিশাল এই ঘাটতির কারণেই ভারতের মধ্যে এখন চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও আর তেমন আগ্রহ নেই। বরঞ্চ ভারত এখন খোলাখুলি বলছে, চীন থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এলে ভারত সবরকম সাহায্য দেবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বৃহত্তর কৌশলগত বিরোধ, যেটাকে নতুন এক শীতল যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হচ্ছে, চলছে তার ভেতর ভারত ঢুকে পড়েছে।
যেটা, তার মতে, পারমাণবিক অস্ত্রধর দুই প্রতিবেশির মধ্যে সীমান্ত সঙ্কট মোকাবেলার পথকে দিনকে দিন কঠিন এবং বিপদসঙ্কুল করে ফেলছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
রাগিনী মেয়ে ১ জুন, ২০২০, ১:১৭ এএম says : 0
ভারত একটি প্রতিহিংসা মূলক রাষ্ট্র যার থেকে প্রতিবেশি রাষ্ট্র গুলো ভয়ে থাকে তাই তাদের অস্থিথ্য রক্ষা করার জন্য করোনা ভাইরাসের মাঝেও লড়াই করতে হচ্ছে যেমনটা আশা করা যায় না
Total Reply(0)
Yusuf Ahmed ১ জুন, ২০২০, ১:১৮ এএম says : 0
আমি শিহরিত সীমান্তে ভারতকে চেপে ধরেছে চীন আর নেপাল! পিছন দিয়ে পাকিস্তান যদি একটু নাড়াছাড়া দেয় খেলা তো ভালোই জমবে
Total Reply(0)
Shibsankar Halder ১ জুন, ২০২০, ১:১৮ এএম says : 0
এক সময় যাদের সাহায্য ছাড়া বাঁচা সম্ভব হয়নি তাদেরকেই অসম্মান
Total Reply(0)
মোঃরুবেল ইসলাম ১ জুন, ২০২০, ১:১৯ এএম says : 0
কারণ ভারতের মতো বেয়াদব রাষ্ট্র আর পৃথিবীতে নেই। তাই চীন ভেবে চিন্তা তাদের উচিত শিক্ষা নেওয়ার ব্যবহ্থা নিয়েছে। প্রতিটা দেশের সাথে অবিচল াআচরণ, এবং কি। ছোট রাষ্ট্র নেপালের সাথেও সিমানা নিয়ে টানাটানি। সবাই একদিন বুঝবে কিন্তু াতাআমাদের জাতিরা বুঝে না। ।
Total Reply(0)
Khan Sharif ১ জুন, ২০২০, ১:২০ এএম says : 0
বর্তমান ইন্ডিয়ার অবস্থা দেখে আমার মনে হচ্ছে তারা তাদের প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া বাধানোর জন্য অতিউৎসাহী হয়ে পড়েছে। যেমন পাকিস্তানের সাথে, চীনের সাথে, সামান্য কারনে বাংলদেশের সীমান্ত হত্যার মধ্য দিয়ে, আর সাথে নেপাল তো আছেই । শুধু তাই নয় তারা তাদের দেশের মধ্যে ও বিবাদ বাধিয়ে রাখতে চাচ্ছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে তারা চাইছে তাদের প্রতিবেশী ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ লেগে থাকুক।
Total Reply(0)
Manik Khan ১ জুন, ২০২০, ১:২০ এএম says : 0
এমনিতেই করোনা ভাইরাস জীবাণুর সাথে মানবজাতির লড়াই চলছে। এই সময় আপনারা দুই দেশ যুদ্ধ করে গোলা বারুদের মিসাইলের জীবাণু চড়িয়ে দেবেন না প্লিজ। মানবজাতি কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন
Total Reply(0)
ATAUR RAHMAN ১ জুন, ২০২০, ৫:৫২ এএম says : 0
No
Total Reply(0)
যাযাবর ১ জুন, ২০২০, ১১:০২ এএম says : 0
চিন যা করছে সেটা ভারতের জন্য মঙ্গল । কারণ মুসলিমদের উপর অত্যাচারে চিন যে রেকর্ড করে চলেছে বিশ্বে সেটা নজিরবিহীন । উইঘুর মুসলিম, রোহিঙ্গা মুসলিম যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । পাকিস্তানকে ৠণের ফাঁদে ফেলে এখন অধিগ্রহণ করা বাকি রেখেছে চিন । চিন সাধারণত বোকা টাইপের দেশগুলিকে টার্গেট করছে । যেমন- পাকিস্তান, মালদ্বীপ, আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলি, সৌদি আরব সহ বেশিরভাগ মুসলিম দেশ যাদেরকে চিন দামড়া গাঁধা ছাড়া আর কিছুই মনে করে না । যারা চিন-ভারতের যুদ্ধ আকাঙ্খা করে তাদের এটা বুঝা উচিত যে, একটা গ্রামের দুই প্রভাবশালী কখনও সরাসরি মারামারিতে জড়ায় না । ওরা মারামারি করার অভিনয় করে, আর জান যায় শুধু চুনোপুঁটিদের । অবশ্য চুনোপুঁটিদের মাথায় ওসব ঢুকে না কখনও । আসলে ভারতও মনে মনে চায়- চিন পাকিস্তানকে আরও ঋণের ফাঁদে ফেলে গোটা পাকিস্তানকে অধিগ্রহণ করুক । বিশ্ব রাজনীতির খেলা বুঝা যে কতটা দায় সেটা এসব মুসলিম দেশগুলিকে দেখলেই বুঝা যায় ।
Total Reply(0)
Ershad ৪ জুন, ২০২০, ৬:২৭ পিএম says : 0
jajabor apni jajabor e thakben! R dekben sobai muslim dara porajito hobei,in sha Allah
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন