শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী দাঙ্গা পেন্ডেমিক পরবর্তী সমাজ বিবর্তনের পূর্বাভাস

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনাভাইরাস মহামারী এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের প্রাণ হরণ করে চলেছে। শিল্পন্নোত বিশ্বের দেশগুলোও মাসের পর মাস ধরে চলা লকডাউনে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির ধকল পোহাতে পারছে না। এ কারণে কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাক্কায় মৃত্যুর প্রকোপ কিছুটা কমে আসলেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া এবং দ্বিতীয় ধাক্কার ঝুঁকি নিয়েও কোথাও কোথাও অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা পুনরায় চালুর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। তবে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে হার এখনো অব্যাহত আছে, তাতে খুব শীঘ্রই সেখানে সবকিছু খুলে দেয়া হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। সবার আগে কোভিড-১৯ এর শিকার হওয়ার পর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার উপর ভর করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পেন্ডেমিক মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরায় চালুর মধ্য দিয়ে চীনের শি জিন পি প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঈর্ষা ও প্রতিহিংসার পাত্র হয়ে উঠেছে, যা এখন আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উপস্থিতি ও আধিপত্য বৃদ্ধির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চীন-মার্কিন উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে তা দক্ষিণ চীন সাগর বা আঞ্চলিক বিরোধের গÐি পেরিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতার দ্ব›েদ্ব পরিণত হয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ পেন্ডেমিকে সারাবিশ্বের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থা অভাবনীয় পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে চীনের বিরুদ্ধে বেøইম গেমে অবতীর্ণ হয়ে সুযোগ গ্রহণের মওকা খুঁজছে মার্কিন প্রশাসন তথা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এখানেও তেমন সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। চীনের ওহান থেকে ছড়িয়ে পড়া ‘কোভিড-১৯ ভাইরাস চীনের ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টি’ এমন একটি হটকেক অভিযোগ সামনে রেখে চীনকে আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা করার মার্কিন প্রয়াস হালে তেমন পানি পাচ্ছে না। মার্কিন রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞ এবং প্রভাবশালী নীতি নির্ধারকরা প্রকাশ্যেই ট্রাম্পের এমন অভিযোগের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক এখনো উত্তুঙ্গ অবস্থায় রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অর্ধকোটি মানুষকে সংক্রমিত করে কয়েক লাখ মানুষের প্রানহরণের পর মৃত্যুর মিছিল কিছুটা শ্লথ হয়ে আসলেও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং রাশিয়ায় মহামারী ক্রমেই প্রভাব বিস্তারি হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ওদিকে অত্যন্ত সর্তকতার সাথে ইউরোপ-আমেরিকায় লকডাউন শিথিল ও অর্থনৈতিক কর্মকাÐ চালুর যেসব উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ধাপে ব্যাপক প্রাণঘাতী আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। তবে পেন্ডেমিক মোকাবেলায় টেস্টিং, ট্রেসিং ও আইসোলেশনের ন্যুনতম ব্যবস্থা ও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহালদশা ঘুচিয়ে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা ছাড়াই বাংলাদেশে এমন সময় সাধারণ ছুটি বাতিল করে গণপরিবহনসহ অর্থনৈতিক কর্মকাÐ পুরোপুরি খুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যখন সীমিত টেস্টিং ব্যবস্থার মধ্যেও করোনা সংক্রমন ও মৃত্যুর হার প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভেঙ্গে চলেছে। গত কিছুদিনে দেশের বেশকিছু র্শীষস্থানীয় ব্যবসায়ীসহ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এটা ঠিক যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সফল টিকা প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত এ ভাইরাস মোকাবিলার নিশ্চিত কোনো পন্থা না থাকায় শীঘ্রই এর পরিসমাপ্তি আশা করা যাচ্ছে না। একটি শতভাগ সফল ভ্যাকসিন পেতে কমপক্ষে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। এ দীর্ঘসময় ধরে নিশ্চয়ই সমগ্র পৃথিবী লকডাউন থাকবে না। মহামারীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পর নতুন আশঙ্কা সত্তে¡ও কোথাও কোথাও জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করার মধ্য দিয়ে তারই বার্তা বহন করছে। কিন্তু সামাজিক সংক্রমণের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে একসাথে ব্যাপক সংখ্যক করোনা টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা এবং দেশের সরকারি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মানুষের ন্যুনতম মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তাকে অগ্রাহ্য করেই লকডাউন খুলে সবকিছু উন্মুক্ত করে দেয়ার বাংলাদেশী ব্যবস্থায় উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রাণঘাতী মহামারীর বাস্তবতায় বিশ্বের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে এবং যাচ্ছে। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে চলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তনিও গুতেরেস করোনা মহামারী পরবর্তী বিশ্ব ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও কর্মহীন মানুষের দুর্ভোগের শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সেই মহাসঙ্কটের আশঙ্কা কমিয়ে আনতে এখনই সমন্বিত উদ্যোগের আহŸান জানিয়েছেন তিনি। এমন একটি বৈশ্বিক সংকটময় মুহূর্তে বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে আসন্ন সংকট মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের নীতিগত তাগিদ ও বাস্তবতা থাকলেও চলমান বিশ্ববাস্তবতায় তার বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। শতাব্দীর ভয়াবহ মহামারী ও বৈশ্বিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটময় সময়ে পুরনো সাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব-সংঘাত, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো নতুন করে মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অপরিনামদর্শী তৎপরতা এবং সিদ্ধান্তের কারণে চীন-মার্কিন বৈরীতা যেমন নতুনরূপে আবির্ভূত হতে চলেছে সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মত সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষ, উত্তেজনা এখন বর্ণবাদী সংঘাতে রূপ নিতে শুরু করেছে।
করোনা ভাইরাস মহামারীর চরম সময়ে অনেক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংঘাত অঘোষিতভাবে থেমে গেলেও একদিকে ভারতের মুসলমানরা হিন্দুত্ববাদী সহিংসতার শিকার হচ্ছে, ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ইহুদী জায়নবাদী আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদের কুৎসিত চেহারাটা আবারো উলঙ্গ হয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসে পুলিশি নির্যাতনে নিহত একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর মার্কিন সমাজের ভেতরে লুক্কায়িত বর্ণবাদী শক্তির আস্ফালন এবং রাষ্ট্রশক্তির বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের সংক্ষুদ্ধ বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে। মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুরোধা রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ধরে যে ভাবমর্যাদা বহন করে আসছিল, তা এখন ভেঙ্গে যেতে বসেছে। ঊনবিংশ শতকের সেই সিভিল ওয়ারের সময় থেকেই মার্কিন সমাজে বর্ণবাদী শক্তির পারষ্পরিক দ্বা›িদ্বক সহাবস্থান থাকলেও গত শতকের ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মার্কিন সমাজে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিজয়ী চেতনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে গত দুইশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত একজন আফ্রো-আমেরিকান হিসেবে বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্নের বর্ণবাদ মুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রূপায়ণ হিসেবে গণ্য হয়। বারাক ওবামা যেখানে মার্টিন লুথার কিং ও অহিংসবাদী নেতা গান্ধীকে নিজের আদর্শ বলে স্বীকার করেছেন, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদিরা বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদকে সামনে এনে বিশ্বব্যবস্থায় নতুন সংকটের জন্ম দিতে চলেছেন।
ভারতে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যমূলক ও মুসলিম বিদ্বেষী এনআরসি ও সিএএ’র প্রতিবাদকারীদের শায়েস্তা করতে বিজেপি ক্যাডাররা লাঠি-বন্দুক হাতে দিল্লীর রাস্তায় নেমে আসলে দিল্লীতে রক্তাক্ত দাঙ্গা শুরু হয়। গত ফেব্রæয়ারীর শেষদিকে সংঘটিত সে দাঙ্গায় প্রায় অর্ধশত মানুষ প্রাণ হারায়। এর বেশিরভাগই মুসলমান। মুসলমানদের শত শত বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে ভস্মিভূত করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট দাঙ্গার সেসব ভয়াবহ দৃশ্যাবলী সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এর কিছুদিনের মধ্যেই ভারতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে ভাইরাস ছড়ানোর গুজব ছড়িয়ে আবারো মুসলিম বিদ্বেষী উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলিম বিদ্বেষী অপপ্রচার জোরদার করার সাম্প্রতিক তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোতেও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর ফলে বিভিন্ন দেশে হিন্দুত্ববাদি গুজব রটনাকারি বেশকিছু ভারতীয় চাকুরীচ্যুত হয়। করোনা মহামারীর মহাদুর্যোগ অন্যদিকে মুসলমানদের ত্যাগ ও সংযমের মাস রমজানেও মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-পীড়নের ভূমিকায় কোনো পরির্বতন হয়নি। কাশ্মীরে, দিল্লীতে, গুজরাটে, বিহারে মুসলমানরা আক্রমণের শিকার হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির হিন্দৃুত্ববাদী বিজেপি ভারতে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিওকন রিপাবলিকানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উগ্র জাতীয়তাবাদের তকমা নিয়ে জাতিগত সহাবস্থান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করার মধ্য দিয়ে এই করোনাকালে দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করে এক অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মেনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মৃত্যুর প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ২০ অঙ্গরাজ্যের অর্ধ শতাধিক শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে এলে ভাঙ্গচুর-লুটপাটে মেতে উঠতে দেখা যায়। করোনার সংকটে লাখ লাখ কর্মহীন মানুষের মধ্যে যে অনিশ্চিয়তার উদ্বেগ জন্ম নিয়েছে চলমান বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্য দিয়ে তারই প্রতিফলন ঘটছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে আবারো গ্রেট বানানোর গল্প বলে ২০১৬ সালে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পর থেকে আমেরিকার গৌরব ফিরিয়ে আনার নামে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে মার্কিন সামাজ্যবাদের পতনকেই যেন তরান্বিত করে চলেছেন।
জর্জ ফ্লয়েড একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, তিনি পুলিশি নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। কমবেশি সবদেশেই এমনটা ঘটে থাকে। তবে এবারে মিনিয়াপোলিসে ফ্লয়েড হত্যার ঘটনাটি মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্রের বর্ণবাদী বৈষম্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন জনগণ এবার এই বৈষম্যনীতির মূলোৎপাটন করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য ও শহরের গÐি পেরিয়ে সামাজিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের এই ঢেউ এখন পশ্চিমা দুনিয়ার সর্বত্র আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। গতকাল র্পযন্ত ৮ম দিনের জন্য জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচারের দাবিতে বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ লন্ডন, টরেন্টোসহ পশ্চিমা দুনিয়ার বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। ঔপনিবেশিক যুগে বিভিন্ন ভারতসহ যেসব দেশে জাতিগত দাঙ্গা সংঘটিত হত, তা ছিল বৃটিশদের ডিভাইড এÐ রুল পলিসির ফসল। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে রেসিজম বা সাদা-কালোর দ্ব›দ্ব শুরুর আগে শান্তিপ্রিয় আফ্রিকান কালো মানুষদের দাস এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। নৌশক্তিতে বলিয়ান ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বণিকরা আফ্রিকার উপকূলে জাহাজ নোঙ্গর করে শিল্পের কাঁচামাল ও সম্পদ লুন্ঠনের পাশাপাশি জবরদস্তি করে এবং নানা প্রলোভনে সরলপ্রাণ কালো মানুষগুলোকে জাহাজে তুলে আমেরিকায় নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করার সে নিষ্ঠুর ইতিহাস থেকে পশ্চিমা সমাজে বর্ণবাদী শোষণ-বৈষম্যের সুত্রপাত। ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং আধুনিক আমেরিকা গঠনের পেছনে রয়েছে এসব কৃতদাসদের অসামান্য অবদান। এ নিয়ে অনেক ইতিহাস, অনেক গল্প-উপন্যাস, নাটক-চলচ্চিত্র রচিত হলেও পশ্চিমা সমাজের মনোজগতে লুকিয়ে থাকা প্রভুত্ববাদী ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষে মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের চিরন্তন শিক্ষাকে ধারণ করতে না পারাই আজকের অশান্তি ও দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ সমাজের মূল কারণ। মার্কিন ইতিহাস গবেষক, জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইতিহাস গ্রন্থের লেখক ইব্রাম কেন্দি লিখেছেন, যুগে যুগে পশ্চিমা প্রতিভাবান ব্যক্তিরা নিজেদের বর্ণবাদী স্বার্থ ও নীতিগত অবস্থানের স্বপক্ষে নানা যুক্তি ও মতবাদ দাঁড় করেছেন। এই মুহূর্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনৈতিক স্বার্থে সে কাজটিই করে চলেছেন।
করোনা মহামারী পরবর্তি বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণ ও পালাবদলের নেপথ্যে যেসব বিষয় কাজ করবে, তা হচ্ছে মানুষকে তার শেঁকড়ের দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করা। কর্পোরেট অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে হয়ে গেলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের জন্য মানুষকে আবারো প্রকৃতির দিকেই ফিরতে হবে। শিল্প, কৃষি, সামাজিক-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কলকাঠি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে সত্যিকারের গণমানুষের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্বের হাতে ন্যস্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই কেবল সত্যিকারের ইতিবাচক পরিবর্তন ও স্থিতিশীল-টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। ফসিল জ্বালানির উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, যুদ্ধবাদী অর্থনীতি চালু রেখে, দেশে দেশে মানুষে মানুষে বৈষম্য ও জাতিগত মতবিরোধকে পুঁজি করে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ ও সংঘাতময় পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কর্পোরেট বাণিজ্যিক স্বার্থ দিয়ে কোনো জাতি তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে পারে না। জাতিতে জাতিতে, মানুষে মানুষে শ্রেষ্ঠত্ব ও পার্থক্যের মেকি মানদÐগুলো ছুঁড়ে ফেলতে না পারলে যুদ্ধ, রক্তপাত ও দাঙ্গা-সংঘাতের চলমান ধারা শেষ হবে না।
কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক তথাকথিত পরাশক্তি দেশগুলোর সমাজ, রাজনীতি, নিরাপত্তা ও শ্রেষ্ঠত্ববোধের উপর গভীর রেখাপাত ঘটিয়ে চলেছে। মহামারী এখনো শেষ হয়নি, সব সম্ভবের দেশে অদৃশ্য অণুজীবের সংক্রমণে মানুষের অসহায় করুণ মৃত্যু, মাসের পর মাস ধরে অভাবনীয় লকডাউনের মধ্যে কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ব্যক্তিগত-সামাজিক ও সামষ্টিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ অঞ্চল ভেদে মানুষের মধ্যে মিশ্র ভাবধারার জন্ম দিচ্ছে। মহামারীতে বিপর্যস্ত বিশ্বে যারা বেøইম গেম, বর্ণবাদী এবং প্রভুত্ববাদী চিন্তা ও আগ্রাসী মনোভাব উস্কে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখছে তারা হয়তো অচিরেই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। মহামারীতে ইতিমধ্যেই অনেক মূল্যবান প্রাণ ঝরে গেছে। অনেক সম্পদ বিলোপ হয়ে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার পারমানবিক সমরাস্ত্র, সেটেলাইট ইনস্টলমেন্টস, সুপারসনিক ডেস্ট্রয়ার ও প্রিসিশন প্রযুক্তি দিয়ে করোনা ভাইরাস মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রমানিত হয়েছে, ভূটান বা বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মানুষের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চেয়ে মার্কিনী বা ইউরোপীয়দের ইমিউন সিস্টেম উন্নত নয়। কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ববাসিকে এই বার্তা দিয়েছে যে, মানুষের ইমিউন সিস্টেম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর নির্ভর করে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও প্রাণ-প্রকৃতির দাবীর প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে। বর্ণবাদী আগ্রাসন, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যাশাকে শাসক শ্রেণী হয়তো নিরাপদ বাঙ্কারে বসে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা। কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক পরবর্তি সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট ও চলমান বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া যুদ্ধবাজ, বর্ণবাদী ও কর্পোরেট স্বার্থের ক্রীড়নক শাসকদের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
নাসির ৩ জুন, ২০২০, ২:৩০ এএম says : 0
এমনিতেই করোনা, তার মধ্যে আবার দাঙ্গা!
Total Reply(0)
রিমন ৩ জুন, ২০২০, ২:৩০ এএম says : 0
এই দাঙ্গার জন্য ট্রাম্পের বেফাস মন্তব্য দায়ি
Total Reply(0)
রফিক ৩ জুন, ২০২০, ২:৩২ এএম says : 0
লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো
Total Reply(0)
লোকমান ৩ জুন, ২০২০, ২:৩৩ এএম says : 0
লেখক ও দৈনিক ইনকিলাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
দিদার ৩ জুন, ২০২০, ২:৩৩ এএম says : 0
মার্কিন জনগণ এবার এই বৈষম্যনীতির মূলোৎপাটন করতে চায়।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন