বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আসছে চলতি বছরের চেয়েও বিশাল ঘাটতি বাজেট

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

আগামী ১১ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট পেশ হওয়ার কথা। সেই পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি, বাজেট নিয়ে দেশের আমজনতা তেমন একটা আগ্রহী নয়। হয়তো এর একটা কারণ এই হতে পারে যে, বিষয়টা জটিল। জনগণের সব পর্যায়ে এটি বোধগম্য হয়না। জনগণ সহজ-সরল ভাষায় বোঝে যে, বাজেট দিলেই ট্যাক্স বসে এবং ট্যাক্স বসালেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তাই যে কোনো সরকারের আমলে বাজেট পেশের আগে মানুষের মনে একটি ভীতি কাজ করে।

বাজেট সম্পর্কে আরো একটি ব্যাপার রয়েছে। রাজনৈতিক আমলে যখন মিটিং-মিছিল করায় কোনো বিধি-নিষেধ ছিলো না তখন দেখতাম, বাজেট পেশ হওয়ার দুই এক ঘন্টা পরেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় খন্ড খন্ড মিছিল হতো। মিছিলে ব্যানার এবং ফেস্টুনও থাকতো। ঐসব ব্যানার এবং ফেস্টুনে লেখা থাকতো, ‘গরীব মারার বাজেট মানিনা।’ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, উভয় দলের যে দলই যখন বিরোধী দলে থাকতো তখন এই ধরণের মিছিল বের করতো। প্রায়শই দেখা গেছে যে, বাজেট পেশের আগের দিনই এসব ব্যানার ফেস্টুন লেখা কমপ্লিট এবং কোন কোন পয়েন্ট থেকে মিছিল বের হবে তাও ঠিক করা হতো। এই সমস্ত প্রস্তুতিই গ্রহণ করা হতো বাজেট পেশের আগের দিন। অর্থাৎ বাজেটে কি থাকছে সেটি না জেনেই বাজেটের বিরোধীতার জন্য বিরোধীদল প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো।

কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পটভূমিতে বাজেট আসছে। কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং রাজনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস এখনও যায়নি। কিন্তু ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা চিন্তা করছেন এবং প্রচেষ্টা নিচ্ছেন Economic recovery বা অর্থনীতির ক্ষতি পুনরুদ্ধারের। অনেকেই কোভিডের আক্রমণকে সাম্প্রতিক অতীতের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সাথে তুলনা করছেন। আবার কেউ কেউ এটিকে ১৯৩০ Great depression বা অর্থনৈতিক মহামন্দার সাথে তুলনা করছেন। সেই মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসা বা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য আমেরিকা কয়েকটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে। অনেকে ১৯৩০ সালের মহামন্দার কথা বলতে গিয়ে ২০০৮ ও ২০০৯ এর মন্দার কথা বলেন। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, ২০০৮/০৯ এর মন্দায় বিশ্ব জিডিপি হ্রাস পেয়েছিলো মাত্র ১% (শতাংশ) কিন্তু ১৯৩০ এর মহামন্দায় বিশ্ব জিডিপি হ্রাসং পেয়েছিলো ১৫% (শতাংশ)। ১৯৩০ সালের এই মহামন্দা মোকাবেলা করার জন্য আমেরিকার সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট অনেকগুলি জনকল্যাণকর প্রজেক্ট, অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য কিছু নিয়মকানুন জারী করেন।

দুই
আজকের বিষয় হলো, আসন্ন বাজেট এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন যে ১৯৩০ সালের মহামন্দা কি ভয়াবহ ছিলো। মহামন্দার আগে আমেরিকায় বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ৩.২ শতাংশ। মহামন্দা কালে সেটি দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ। আমেরিকার মত দেশে বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ-এটি কি কল্পনা করা যায়?

তেমন একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দায় আমরা নিক্ষিপ্ত হয়েছি বলে আমার অভিমত। এই মতামতে উপনীত হওয়ার আগে আমি কতগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই বাজেটের খসড়া প্রণয়ন করেছে। হয়তো ইতোমধ্যে সেটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে। দুই চারটি পত্রিকায় সেই খসড়া বাজেটের রূপ রেখাও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র আমার কাছে নয়, অনেক বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদের কাছেও এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি যে, এবার বাজেটে কোন্ বিষয়টিকে টপ প্রায়োরিটি বা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে? অর্থনৈতিক উন্নয়নকে? নাকি করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট নতুন দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে? নাকি স্বাস্থ্যখাতকে? নাকি কৃষিকে?

তিন
সেটি নির্ধারণ করার আগে এটি জানতে হবে যে, আমাদের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে? এখন পর্যন্ত সরকারীভাবে পরিস্কার কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। তবে এ ব্যাপারে একটি প্রাথমিক ধারণা লাভের জন্য আমাদেরকে জিডিপির ওপর নির্ভর করতে হবে। ২০১৯/২০২০ অর্থ বছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিলো ৮.২ শতাংশ। জুন মাসেই এই অর্থ বছর শেষ হবে। চলতি বাজেটের বরাদ্দ ছিলো ৫ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকা (আমরা খুচরা টাকা বাদ দিয়েছি)। সংশোধিত বাজেটে হ্রাস করে এটি করা হয় ৫ লক্ষ দেড় হাজার কোটি টাকা। আগেই বলেছি যে, প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। আইএমএফের প্রজেকশনে বলা হয়েছে যে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাওয়ায় নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে ৪.৫% শতাংশ। ফলে এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৭ শতাংশ। আগের বছর অর্থাৎ ১৮/১৯ অর্থ বছরের প্রবৃদ্ধি হয়েছিলো ৮.১৫ শতাংশ।

এটি ছিলো আইএমএফের প্রজেকশন। গত রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বলেছে যে, করোনাভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাবে এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে হবে ২.৫ শতাংশ। কোভিড-১৯ এর আরেকটি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে দারিদ্র্যসীমার ওপর। পলিসি ডায়ালগের হিসাব অনুযায়ী, হত দরিদ্রের সংখ্যা বাড়বে ৩৫ শতাংশে। সরকার দাবী করছে যে, তারা দারিদ্র্যসীমা নামিয়ে এনেছে ২০ শতাংশ। অবশ্য সিপিডি বলছে, দারিদ্র্যসীমা নেমে এসেছিলো ২.৪ শতাংশ, ২০ শতাংশে নয়। অন্য অর্থনীতিবিদরা বলেন, Informal sector বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বা কর্মীসহ হত দরিদ্রের সংখ্যা বাড়বে ২৭ শতাংশ। ফলে ‘দিন আনে দিন খায়’ মানুষের সংখ্যা বাড়বে ৪৭ শতাংশ। তারা আরো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, যদি সংক্ষিপ্ততম সময়ে করোনাভাইরাসের লাগাম টেনে ধরা না যায়, যদি আক্রান্ত ও মৃতের উর্ধ্বমূখী রেখাচিত্র আগামী তিনমাস অব্যাহত থাকে তাহলে সরকারী এবং বেসরকারী সব হিসাবই ভন্ডুল হয়ে যাবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাতারে যোগ হবে মধ্যবিত্ত এবং নি¤œবিত্ত।

চার
অর্থনীতির আকাশ থেকে দুর্যোগের কালো মেঘ সরে যায়নি, বরং তা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। করোনাভাইরাস আক্রমণের মাত্রাভেদে সরকার সমগ্র দেশকে তিনটি রং-এ বিভক্ত করছে। রংগুলি হলো লাল, হলুদ এবং সবুজ। সেই রং মোতাবেক দেশে সর্বাত্মক অথবা আংশিক লকডাউন জারী করা হবে। সুতরাং বুঝতে কারো কষ্টা হয়না যে, দিনের পর দিন করোনাভাইরাস তার থাবা বিস্তার করেই চলছে। এখন সেই পটভূমিতেই বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

কিন্তু সেই পটভূমিতে কি বাজেট তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে? পত্রপত্রিকায় বিক্ষিপ্তভাবে যেসব রিপোর্ট আসছে তাতে মনে হচ্ছে, সে রকমটি হচ্ছেনা। এসব বিক্ষিপ্ত রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সরকার চলতি বাজেটের চেয়েও নাকি বড় বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। সেটি হবে একটি বিশাল ঘাটতি বাজেট। তারপরেও চলতি সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট তৈরি করা হচ্ছে কোন হিসাবে সেটি বোধগম্য নয়। বলা হচ্ছে যে এই বাজেটে নাকি ঘাটতি হবে ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এত বিশাল ঘাটতির অর্থায়ন কীভাবে হবে? চলতি অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট শেষ প্রান্ত থেকে, অর্থাৎ মার্চ মাস থেকেই কোভিডের আক্রমণ। এখনও সেটি অব্যাহত আছে। অর্থাৎ এই তিন মাস থেকেই সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় স্থবির। সেই অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের টার্গেট চলতি বছরের চেয়েও বড় করা হচ্ছে কোন বিবেচনায়, সেটিও আমাদের বোধগম্য নয়।

গত বছরের চেয়ে এ বছর স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ নাকি মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি? কোন বিবেচনায়? যেখানে করোনা রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাই নাই, নাই প্রয়োজনীয় আইসোলেশন বেড, যেখানে আইসিইউ বেডের তীব্র অভাব, যেখানে ভেন্টিলেটর একেবারেই হাতে গোনা, যেখানে অক্সিজেনের অভাবে রোগী ছটফট করে মারা যায়, সেখানে ১০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ অতি নগণ্য। এই বরাদ্দ অনেক বেশি বৃদ্ধি করতে হবে।
বাজেট সম্পর্কে আরো কথা বলবো আগামী মঙ্গলবার। কারণ তখন বাজেট পেশ হয়ে যাবে।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (11)
Shahanur Chowdhury ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৩ এএম says : 0
মানুষ বাঁচলে কর দেবে, আগে মানুষকে বাঁচান, আর বড় বড় কোম্পানি, মাঝারি কোম্পানি, তাদেরকে ফলো করুন।
Total Reply(0)
Akram Hossain ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৪ এএম says : 0
কৃষকদের জন্য ৫০% করা হোক এই বছর।
Total Reply(0)
Md Josim ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৪ এএম says : 0
এক লক্ষ কোটি টাকা কমিয়ে বাজেট ঘোষণা করলে তো আর কোন গাঁথি থাকে না যেটা বাস্তবায়ন সম্ভব না সেটা ঘোষণা করার দরকার কি যেটা সম্ভব সেটাই ঘোষণা করেন
Total Reply(0)
Mohammed Full Mieah ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৪ এএম says : 0
দুর্নীতিবাজদের জন্য কত টাকা বাজেট করা হয়েছে তাদের জন্য বাজেট ঘোষণা করা হোক
Total Reply(0)
Razia Sultana ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৪ এএম says : 0
দুর্নীতি করবে তা ঘাটতি থাকবে না তা কি থাকবে
Total Reply(0)
Payra Hasem ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৪ এএম says : 0
অর্ধেক তো সিগারেট থেকেই উঠিয়ে ফেলবে
Total Reply(0)
Md Rahim ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৬ এএম says : 0
আমাদের এই বাংলাদেশে জতবার ই নতুন কোন বাজেট হবে জারা বরলোক তারা আরো অনেক টাকার মালিক হবে আর জারা গরিব তারা আরো গরিব হবে
Total Reply(0)
Md. Masud Uzzaman Rana ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৭ এএম says : 0
2019-20 অর্থবছরের হিসাব নিকাশ করেন অনেক কিছু পাবেন
Total Reply(0)
Joinal Abdin ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৭ এএম says : 0
জাদের জন্য বাজেট আর য়ে কাজের জন্য বাজেট বাজেটে টাকা খরচ করার পর জনগণের কাছে হিসাব দিতে হবে
Total Reply(0)
Mobarak Hossian ৯ জুন, ২০২০, ১:৫৭ এএম says : 0
আমি একজন গার্মেন্টস শ্রমিক, আমার যখন চাকুরী ছিল তখন প্রতিমাসে ৪১৭ টাকা আমার একাউন্টে টাকা ঢোকার আগেই ট্যাক্স হিসেবে সরকার কেটে নিতো,আমি বিদেশে চাকুরী করছি না দেশেই চাকুরী করছি, দীর্ঘ ছয় বছর বছর যাবৎ দিয়ে এসেছি,এই মহামারীতে আমার চাকুরী নেই আমিতো কোন সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পেলাম না? তাহলে এত টাকা বাজেট কাদের জন্য এবং ৯৬ হাজার কোটি টাকা কাদের জন্যে দেয়া হয়েছিল,আল্লাহ এদের বিচার করবেন, আমিন
Total Reply(0)
jack ali ৯ জুন, ২০২০, ১:১১ পিএম says : 0
O'Muslim in Bangladesh wake up and repent to Allah and install a Muslim Leader who will rule our country by the Law of Allah, then Allah will solve all the problem we are facing.. In Islam "Prevention is Better Than Cure"
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন