বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চিকিৎসাবঞ্চিত নিরাপত্তাহীন মানুষের কাছে উন্নয়নের দাবি অর্থহীন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশ বা ভারতে নভেল করোনাভাইারাস মহামারীতে আক্রান্ত ও প্রাণহানীর মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই জুন মাসকে সংক্রমণের পিকটাইম বলা হলেও জুনের পর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার একমাসের মধ্যে এপ্রিলে ভাইরাস সংক্রমণ দ্রæত বেড়ে চলার মধ্যেই একাধিকবার দেশের বৃহত্তম শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের লক্ষ্য নস্যাৎ করে ঢাকা-নারয়নগঞ্জের রেড জোনগুলোতে শ্রমিকদের তলব করে আনার সিদ্ধান্তটি ছিল চরম আত্মঘাতী। এর মধ্য দিয়ে দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষ লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নির্দেশনা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। দ্রæত সংক্রণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তারই বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। একদিকে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে সব পক্ষের শৈথিল্য, অন্যদিকে কোভিড-১৯ ভাইরাস টেস্টের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অস্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা ও অস্বচ্ছতা ও স্বাস্থ্য সেবা খাতের ভগ্নদশার কারণে দেশে করোনা মহামারী বড় ধরনের সামাজিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। করোনায় মৃত্যু আতঙ্ক ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এর কোনো ভ্যাকসিন বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই, সুনির্দ্দিষ্টও সুনিশ্চিত কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। করোনা টেস্ট করতে গিয়ে মানুষকে নানাবিধ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়, এরপরও অভিযোগ উঠেছে, অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের ভুল পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহের কারণে টেস্টিংয়ের ভুল রিপোর্টের শিকার হচ্ছে অনেক মানুষ। সেই সাথে করোনা ভীতি আমাদের সামাজিক দায়দায়িত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের চিরায়ত ভিত্তিগুলো যেন এখন ধসিয়ে দিচ্ছে। করোনা সংক্রমণের ভীতির কারণে পারিবারিক ¯েœহ মমতার বন্ধনকে অগ্রাহ্য করে সমাজে ও পরিবারে স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুর নিমর্মতার অসংখ্য উদাহরণ তৈরী হচ্ছে। বাড়িওয়ালা ও প্রতিবেশীদের কথা বাদ দিলেও করোনা আক্রান্ত নিকটজনকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করাসহ নানাবিধ কাহিনীর জন্ম হচ্ছে। করোনা সংক্রমিত হলেই মানুষ মারা যায় না। সারাবিশ্বে মৃত্যুর হার ৫ শতাংশের বেশি নয়। আমাদের দেশে সম্ভাব্য সংক্রমণ অনুপাতে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ টেস্টিং ক্যাপাসিটি সত্তে¡ও মৃত্যুর হার শতকরা ২ ভাগের বেশি নয়। করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও সাধারণ সর্তকতা না মানলেও কোথাও কোথাও শুধুমাত্র করোনা রোগীদের নিয়ে অতিমাত্রিক সর্তকতা ও ভীতি মানবিক মূল্যবোধের সীমা লঙ্ঘিত হতে দেখা যাচ্ছে।
সকলেই জানেন, সাধারণত; সংক্রমিত রোগীর হাঁচি-কাশি, থুতু ও কফের ড্রপলেট থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়। মুখে মাস্ক পরে এবং নিয়মমাফিক সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া ও সাধারণ সর্তকতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে ভাইরাস সংক্রমণ ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিবৃতি দিয়ে বলেছে, মৃত্যুবরণকারী করোনা রোগীর মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি খুবই কম। এরপরও প্রতিদিনই আমাদের সমাজে শ্রেফ করোনাভীতির কারণে প্রতিদিনই অমানবিক, মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে চলেছে। করোনা আক্রান্ত পিতাকে ঘরে আটকে রেখে তাকে খাবার এবং জরুরী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার ঘটনা, করোনা আক্রান্ত মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে সন্তানের পালিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা এখন প্রায়শ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে। করোনায় মৃত লাশ ফেলে আত্মীয়দের পলায়ন, কবরস্থ করতে সামাজিকভাবে বাঁধা দেয়া এবং লাশ পুঁতে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলার মত নিষ্ঠুরতাও আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে। এর বিপরীত চিত্রও আছে। এই করোনার সময়েও যখন একশ্রেণীর জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক কর্মীর দরিদ্র-কর্মহীন মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য ও অর্থ সহায়তা আত্মসাতে লিপ্ত রয়েছে, তখন অন্যদিকে অনেক ডাক্তার, পুলিশ. সেনাসদস্য, সমাজকর্মী ও জনপ্রতিনিধি করোনাযোদ্ধার ভূমিকা অবতীর্ণ হয়ে নিজের জীবনের তুচ্ছ করে মহামারী উত্তরণের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এদের অনেকেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিজেরাই রোগী হয়েছেন, নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও মানুষের দোয়ায় তারা দ্রæত সেরেও উঠছেন। আবার কেউ কেউ করোনা ভাইরাসের কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্যে আলিশান বাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে মাসের পর মাস ধরে নিবিড় কোয়ারেন্টাইনে থেকেও কেউ কেউ করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জনগণের সেবার সুযোগ দেয়ার প্রার্থনা জানিয়ে ভোটে ঁদাড়ানো এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগই এই করোনাকালে লকডাউনের নির্দেশনা মেনে ঘরে বসে আছেন। তখন কিছু দরদী মানুষ নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে এ সময়ে মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। আবার জীবিকার তাগিদে দিনরাত রাস্তায় ঘাম ঝরানো লোকগুলোর যেন তেমন কিছুই হচ্ছে না।
সারাদেশে করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণের বিস্তার ঘটার মধ্য দিয়ে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই নতুন আগের দিনের রেকর্ড ভেঙ্গে বেড়ে চললেও দিনে লক্ষাধিক মানুষের করোনা টেস্টের বাস্তব লক্ষ্য অর্জনে সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারী শুরুর পর থেকে এই ভাইরাসের চিকিৎসায় বাংলাদেশকে বিভিন্ন ভাবে বেশকিছু কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গেলেও করোনা টেস্ট এবং স্বাস্থ্যসেবায় লেজেগোবরে অবস্থার কারণে সব অর্জন যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। আমেরিকায় করোনা সংক্রমণের শুরুতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা রোগীদের জন্য হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও এজিথ্রোমাইসিনের কম্বিনেশন ট্রিটমেন্টকে অব্যর্থ হিসেবে দাবি করেছিলেন। এ দুটি ওষুধই বাংলাদেশে বিপুল পরিমানে উৎপাদন ও রফতানি হয়ে থাকে। এ কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে বিতর্ক ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আপত্তি প্রকাশিত হওয়ার আগেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় রেমডিসেভিরের সাফল্য সর্বত্র স্বীকৃতি লাভ করে। মার্কিন কোম্পানির পেটেন্টধারি রেমডিসেভির আমেরিকার বাইরে প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদনের কৃতিত্বও সম্ভবত বাংলাদেশের। রেমডিসেভিরের জন্য বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে ধর্না দিতে শুরু করেছে। এ সপ্তাহে নাইজেরিয়ায় সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর সে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ চাটার্ড বিমান পাঠিয়ে রেমডিসেভির, পিপিইসহ করোনাভাইরাস চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পিপিই’র গুণগত মান নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছ¡সিত প্রশংসার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দেশের বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি, গার্মেন্টস ও প্রযুক্তিপণ্য কোম্পানীগুলোর এমন সাফল্যের খতিয়ান আরো গতিশীল, উজ্জ্বল এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আরো ফলপ্রসু হতে পারত। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এমন বৈশ্বিক ও জাতীয় সংকটের চরম সময়েও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রিতার খপ্পরে পড়ে দেশে করোনা সাসপেক্টেড লাখ লাখ মানুষ অশেষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। অথচ রেমডিসেভির ওষুধ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণের অনেক আগেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র র‌্যাপিড টেস্টিং কিট উদ্ভাবন ও উৎপাদনে সাফল্য সম্পর্কে ঘোষণা এসেছিল। দ্রæততম সময়ে এই কিটের ট্রায়াল, অনুমোদন ও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে এখন প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের করোনা টেস্ট করা সম্ভব ছিল। আর দ্রæততম সময়ে যত বেশি টেস্ট হবে তত দ্রæত সংক্রমণের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানী যেখানে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের করোনা টেস্ট ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। অথচ নিজেদের আবিষ্কৃত র‌্যাপিড ডটবøট কিট দিয়ে ১০ ভাগ খরচে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের করোনা টেস্টের মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্র হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারত।
ক্লোরোকুইন, রেমডিসেভির, ইভারমেকটিন ওষুধ, গণস্বাস্থ্য বেন্দ্রের র‌্যাপিড ডটবøট টেস্টিং কিট, উন্নত মানের পিপিই, মাস্ক, ওয়ালটন-মিনিস্টার কোম্পানির ভেন্টিলেটর উৎপাদনের মধ্য দিয়ে চীনের পর করোনা ভাইরাস চিকিৎসায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় রোল মডেল হতে পারত। অথচ এপ্রিলে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) রিপোর্টে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি দেশের মধ্যে প্রায় সবগুলো সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে থাকার চিত্র প্রকাশিত হয়। এরপর ইতিমধ্যে একমাসের বেশি পেরিয়ে যাওয়ার পর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ দ্রæত বেড়ে যাওয়ার সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তা রীতিমত ভীতিকর ও উদ্বেগজনক। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই অসুস্থ্য অনেকে হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে রাস্তায় বিনা চিকিৎসায় মরা যাচ্ছে। কোভিড ১৯ সন্দেহে মৃত্যুর পর স্বাভাবিক সামাজিক মর্যাদা, ধর্মীয় রিচুয়াল অনুসারে শেষকৃত্বও অনেকের ভাগ্যে জুটছে না। জীবিতাবস্থায় তাদের করোনা পরীক্ষা না হলেও মৃত্যুর পর পরীক্ষা করে অনেকেরই নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। তার আগেই নিহতরা পারিবারিক-সামাজিকভাবে সমাহিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। করোনায় মৃত অথবা সাসপেক্টেটেড রোগীদের এমন অমর্যাদা ও অবমানকর পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কোনো নজির বাংলাদেশ বা ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বৈশ্বিক মহামারির সময়ে মৃতদের নিয়ে এমন তুঘলকি অবস্থা বিশ্বের আর কোথাও নেই। এ কারণেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে লুকোচুরি ও গোপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে ভুক্তভোগীরা। এভাবেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে সামাজিক সংক্রমণ। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরীক্ষার হার এবং সংক্রমণের হার অনেক কম হলেও করোনাভীতির কারণে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের এমন ভগ্নদশা ও নাজুক অবস্থা আর কোথাও দেখা যায়নি।
আগামীকাল বৃহষ্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ সালের জাতীয় বাজেট ঘোষণার কথা রয়েছে। প্রাথমিক ধারণায় এবারের বাজেট বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের কাছাকাছি বা কিছুটা বেশি হতে পারে। তবে সম্ভাব্য ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে প্রায় ২ লক্ষকোটি টাকার (প্রায় ৪০ শতাংশ) ঘাটতি বাজেটই বলে দিচ্ছে আমাদের অর্থনীতির হালহকিকত। উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণা অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। টেকসই উন্নয়নের মানদÐ হিসেবে সর্বপ্রথমেই এসেছে সুশাসন, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক বৈষম্যহীনতা এবং পরিবেশ ও সামাজিক-রাজনৈতিক ভারসাম্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার উপর। গত এক দশক ধরে উন্নয়নের গল্প শুনে আসছে দেশের মানুষ। তথাকথিত উন্নয়নের খাতিরে গণতন্ত্র সীমিত রাখার যুক্তিও তুলে ধরেছেন ক্ষমতাসীনদের অনেকে। পাশাপাশি দেশ থেকে অবাধে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানের হিসাবে গড় মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও গার্মেন্ট রফতানির মাধ্যমে বছরে কয়েক হাজার কোটি ডলারের রেমিটেন্স কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোষাগারে ক্রমবর্ধমান হারে জমা হওয়ার অঙ্কটিকেই অনেকে দেশের শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসাবে করে আসছেন। উন্নয়নশীল অর্থনীতি থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার গড়পড়তা হিসাবের চেয়ে দেশের সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই ছিল নাগরিক সমাজের কাছে কাক্সিক্ষত বিষয়। আজকের করোনা পরিস্থিতি কোটি কোটি মানুষের জীবন-মৃত্যু ও জীবীকার নিরাপত্তার প্রশ্নগুলো যখন সামনে নিয়ে এসেছে, তখন উন্নয়নের অন্যসব উপাত্ত ও দাবিদাওয়া যেন কর্পুরের মত হাওয়া হয়ে যেতে বসেছে। মাত্র দুই মাসের সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে দেশের কোটি কোটি মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি সাধারণ অসুস্থতা ও জরুরী স্বাস্থ্যসেবায় বঞ্চনার আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠেছে। কোটি মানুষের এমন ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ বা স্ট্রেস থেকে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
করোনাকালীণ ছুটি ও লকডাউনের সময় ঢাকা শহরের সামগ্রিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে এটাই প্রতিয়মান হয়েছে যে শুধুমাত্র খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমে এসেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই করোনা লকডাউন ও সাধারণ ছুটি কার্যকর হয়েছে। কোথাও কোথাও কার্ফিউ জারি করেও মানুষের রাস্তায় বের হওয়া বন্ধ করতে দেখা গেছে। তবে তার আগে সবার খাদ্য নিরাপত্তা, বেকার হওয়া লোকদের বেকারভাতা, নুন্যতম সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করেই করোনা লকডাউন কার্যকর করতে হয়েছে। সেখানে করোনা ভীতির কারণে হাজার হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ডাক্তারশূন্য, চিকিৎসা সেবা বন্ধ হওয়ার নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট ও বিশেষায়িত হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও কোনো চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না মানুষ। ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি ও লিভারের সমস্যা নিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ নিয়মিত ডাক্তারি ফলোআপে থাকেন, তাদের বেশিরভাগ এখন চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন। স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত যেসব রোগীরা হাসপাতালে জরুরী সেবা নিয়ে একদিনে বা দু’চারদিনে আশঙ্কামুক্ত হয়ে বাসায় ফিরে যেতে পারে, এখন সেসব রোগী হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। অথচ দেশে উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত ডটবল্ট র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করে মাত্র ১৫মিনিটেই যেকোনো মানুষের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত করার ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে কোটি মানুষকে এমন অপমৃত্যুর বিভীষিকা থেকে মুক্ত করা অসম্ভব নয়। করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড বা ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। জনগণের সে মৌলিক দাবীর বাস্তবায়ন এখন যেন সুদূরপরাহত। লাখ লাখ টাকার আইসিইউ বেড বা ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবী দূরের কথা দু’চার হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে হাসপাতালগুলোতে ছটফট করতে করতে রোগীরা মারা যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে দেশের বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও প্রবীন কলামিস্ট-সাংবাদিক শেখ দরবার আলম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে অনেক দেরিতে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার পর কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যান। অথচ সারাজীবন শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞানসাধনায় নিয়োজিত হয়ে বহু গ্রন্থের লেখক শেখ দরবার আলম রাষ্ট্রের কাছে জীবন সায়াহ্নে এবং শেষ সময়ে ন্যুনতম চিকিৎসা সেবার নিশ্চয়তা ও সুযোগ সুবিধার বঞ্চনা নিয়ে চিরবিদায় নিতে হল। এ সপ্তাহে কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক, যিনি দেশের শীর্ষ স্থানীয় ইংরেজী দৈনিকে কক্সবাজার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত রবিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটু অক্সিজেন সাপোর্ট না পেয়ে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশে এভাবেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। সব কিছুর আগে মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এই দায়িত্ব অগ্র্হ্যা করার সুযোগ কোনো রাষ্ট্রের কোনো সরকারের নেই। এ ছাড়া উন্নয়নের সব দাবী অর্থহীন।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ১১ জুন, ২০২০, ১২:৩০ পিএম says : 0
There is only one solution, O'Muslim wake up and install a Muslim Leader who will rule our Beloved Country by the Law of our Creator The Al-Mighty Allah [SWT] then Allah's help will descend upon us and lots of problem will be solved.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন