শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার এখনই সময়

সাজ্জাদ হোসেন রিজু | প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০২০, ১২:১৩ এএম

টানা দুইমাসের বেশি সময় সাধারণ ছুটি তথা অঘোষিত লকডাউনের কারণে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নেমে আসতে পারে ২ শতাংশের নিচে, যা গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৮.১৫ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে বৈদেশিক আদেশ বাতিল হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি। ৯ লাখের বেশি লোক বেকার হয়ে পড়েছে। কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত মিলিয়ে মে মাস পর্যন্ত ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমান ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকজন। রাজধানী ঢাকার ৩৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে ফিরে গেছে, যারা কর্ম হারিয়েছেন এবং এই মুহূর্তে ঢাকায় ফিরে আসার মত অবস্থা নেই। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাদের শ্রমশক্তি ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার।

২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরই রাজধানীবাসী ঢাকা ছাড়তে শুরু করে। রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাসিন্দা চলে যায় গ্রামে। ঢাকার বস্তিাবাসী আর দিনমজুর শ্রেণির লোকেরা, যারা গ্রামে ফিরে গেছে তাদের ভাগ্য ফেরাতে গ্রামেই তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর ‘একফালি জমিও যেন পড়ে না থাকে’ এই নির্দেশের কঠোর বাস্তবায়ন করতে কৃষিকাজের বিকল্প নেই। ফসল ও সবজি চাষ, মাছ চাষ, পশুপালন ও দুগ্ধখামারের মত কর্মসংস্থানে মনোনিবেশ করতে হবে। গ্রামের নদী-নালা, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাওরগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। কাজে লাগাতে হবে অনাবাদি প্রতিখন্ড জমি। রাজধানীতে এসে ভাসমান জীবনযাপন করার চেয়ে গ্রামে এধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়া অনেক যৌক্তিক। তবে এজন্য গ্রামবাসীদের মানসিকতার পরিবর্তন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন।

কৃষিকাজের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের দিকেও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এরকম শিল্প যেমন: মৃতশিল্প, কাঠের কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজ, নকশি কাঁথা, তাঁতবস্ত্র শিল্প ইত্যাদি। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উপর নির্ভর করে আছে ৩০ লাখের বেশি জনবল। বর্তমানে বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা অবদান রেখে চলেছে এই শিল্প। দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, স্পেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইডেন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে এই শিল্পের যথেষ্ট কদর রয়েছে, যা উপযুক্ত পৃষ্টপোষকতা পেলে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে আমাদের অর্থনীতিকে।

গ্রামে উৎপাদিত পণ্য যাতে সহজেই শহরে আসতে পারে আবার গ্রামে যাতে কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হয় সেই ব্যবস্থা করতে বাজারজাতকরণের সহজিকীকরণের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। ডেলিভারি চ্যানেলকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করতে দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রমীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেটের বিস্তৃতি জরুরি। পাশাপাশি ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে জাতীয় অবদানের জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার সাথে ই-কমার্সের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। তৃণমূলে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করবে ই-কমার্সের বিস্তৃতি। রাজধানীতে আমরা যেভাবে ই-কমার্স ব্যবহার করতে শুরু করেছি সেই ই-কমার্সকে গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের কর্মভিত্তিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ই-কমার্সকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে ই-কমার্স ব্যবহার করা গেলে গ্রামে কেন নয়?

তৃণমূলে অনলাইনে কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রথমত প্রয়োজন নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ও মানসিকতার পরিবর্তন। সহজ কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামে বসেই সারাবিশ্বের কাজ করা সম্ভব। ‘ডিজিটাল ইকোনমাই রিপোর্ট-২০১৯’ এর তথ্যমতে, দেশে বছরে ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে ৮৫০ কোটি টাকা আয় হয়। করোনা পরিস্থিতিতে আমরা শিখেছি কীভাবে বিকল্প পথে অফিসের কাজ করা যায়। ডড়ৎশ ভৎড়স যড়সব পদ্ধতিতে ঘরে বসে কাজ করা সম্ভব হলে গ্রামে বসেও তা করা সম্ভব। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে নিজেদের কাজগুলোকে ডড়ৎশ ভৎড়স যড়সব ক্যাটাগরিতে ভাগ করা। এতে করে নির্দিষ্ট কিছু কর্মীকে গ্রামে/ঘরে বসেই কাজ করার সুযোগ দেওয়া যাবে। এতে প্রতিষ্ঠানের যেমন বেতন বাবদ খরচ কম হবে তেমনি কর্মীও সন্তুষ্ট থাকবে।

ঢাকা শহরে ৭০ লাখের মতো মানুষ শুধু বস্তিতেই সববাস করে যাদের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এর একটি জরিপ বলছে, ঢাকায় হকার, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালকসহ ৭০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ অস্থায়ী বাসিন্দা। এরা ঢাকা শহরে মানবেতর জীপনযাপন করে, ঢাকার যানজট ও জনজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়, পরিবেশ দূষণেও তাদের ভূমিকা রয়েছে। আবার এরা বিভিন্ন অপরাধের সাথেও নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। কিন্তু এদেরকে গ্রামে পূনর্বাসনের মাধ্যমে একদিকে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করা সম্ভব পাশাপাশি ঢাকা শহরের উপর থেকেও চাপ কমানো যায়।

গ্রামাঞ্চলে যারা কৃষিকাজ ও কুটির শিল্পভিত্তিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে চায় তাদের জন্য সরকার ব্যাংক হতে সহজ শর্তে ঋণগ্রহণের ব্যবস্থা চালু করেছে। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে কৃষকেরা এই ঋণ নিতে পারবেন যেকোন ব্যাংক থেকে। কৃষিখাতে চলতি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮ মাস মেয়াদী এই ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৪ শতাংশ। তবে সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের মানসিক পরিবর্তন। আমরা যদি বিকল্পভাবে ভাবতে না পারি তাহলে আবার সেই অতীতেই ফিরে যেতে হবে। করোনা আমাদের বিশ্বকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের বুঝিয়েছে যে, আমাদের কী করা উচিত ছিল।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
ওসমান ১২ জুন, ২০২০, ৭:০৫ পিএম says : 0
সময়োপযোগী লেখনী।এখনই এসব উদ্যোগ বিশেষ করে কর্মসংস্থানেেের ব্যবস্থা না করলে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী মানসিকভাবে বিকারগস্ত হবে। আর সামাজিক অস্থিরতায় এরাই অংশগ্রহণ করবে। অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন