শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জঙ্গি নিধনের মহারণে চাপা পড়ছে বানভাসির কান্না

প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : দেশে জনপ্রতিনিধি গিজগিজ করছে। মন্ত্রী, এমপি, জেলা পরিষদে মনোনীত প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার সবাই জনপ্রতিনিধি। কিন্তু কেউ নেই বন্যাদুর্গতদের পাশে। উত্তরাঞ্চলের রংপুর, নিলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। সুনামগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগগঞ্জ, শরিয়তপুরেও দুর্গত মানুষ আহাজারি করছে। ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো নদীভাঙনে বাড়িঘর হারাচ্ছে শত শত পরিবার। খেয়ে না খেয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে বানভাসিরা। অথচ তাদের দিকে তাকানোর যেন কেউ নেই। দুর্গত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসছে না কেউই। জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠন, সংস্কৃতিসেবা ও সমাজের বিত্তবান কারো দৃষ্টি পড়ছে না দুর্গতদের দিকে। জনগণের সেবক নামের রাজনীতিকরা এখন ব্যস্ত জঙ্গিদমন ও জঙ্গিনিধন নিয়ে। কারো দাবি জঙ্গিদমনে জাতীয় ঐক্য, আবার ক্ষমতাসীনদের দাবি ইতোমধ্যেই জঙ্গি ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে। বন্যার্ত মানুষের সহায়তা, সহানুভূতি দূরের কথা, অনুভূতি জানানোর যেন সময় নেই নেতানেত্রীদের। এমনকি মিডিয়াগুলো জঙ্গি ইস্যুতে এত ব্যস্ত যে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও যমুনা নদীর আশপাশের শত শত গ্রাম পানির নিচে তালিয়ে গেলেও সে খবর প্রচারের আগ্রহ নেই। তিস্তা, যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাটÑসেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, উনিশ শতকে উত্তরাঞ্চলে বন্যা হলেই চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাসচন্দ্র বসু, আচার্য্য প্রফুল চন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানী, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবিরা ছুটে যেতেন দুর্গতদের মাঝে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যেখানে বন্যার কথা শুনেছেন, সেখানেই ছুটে গেছেন দুর্গত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াতে। সাধ্য অনুযায়ী সহায়তা করেছেন। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত দেখা গেছে প্রধান-অপ্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের অধিকাংশই নদীভাঙন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গতের সাহায্যে এগিয়ে গেছেন। ’৯০ দশকেও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতির সংগঠন, পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা ত্রাণ নিয়ে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি ঢাকায় গলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে দুর্গতদের জন্য অর্থ, খাবার, পুরনো কাপড়, ওষুধ সংগ্রহ করে দুর্গতদের মাঝে বিলিয়েছেন। সে চিত্র এখন সুদূর অতীত।
জঙ্গি নিধনের এই মহারণে ভুপেন হাজারিকার কালজয়ী ‘মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য’ গান যেন উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত-নদীভাঙন কবলিত মানুষের জীবনে শুধুই স্বপ্ন। পৃথিবীতে মানুষ যতদিন থাকবে এ গানের পঙ্্ক্তি ততদিন ‘বর্তমান’। অথচ নদীভাঙন আর বন্যা দুর্গত লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। অসহায় এবং সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলোর পাশে জনপ্রতিনিধিরা নেই। উত্তরাঞ্চলের অনেকগুলো জেলা বন্যাকবলিত। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। নদীভাঙনে গৃহহীন হচ্ছে শত শত পরিবার। প্রবলবর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে কুড়িগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, জামালপুর ও সুনামগঞ্জে নদ-নদীগুলোতে বন্যার পানি বিপদসীমার ওপরে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা সংলগ্ন নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ; গঙ্গা-পদ্মা সংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং সুরমা-কুশিয়ারা সংলগ্ন সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেশের নদনদীগুলোর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ১৭টিতে পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে। ধরলা নদী কুড়িগ্রামে, তিস্তা নদী ডালিয়ায়, কাউনিয়া, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়িতে, ঘাঘট নদী গাইবান্ধায়, ব্রহ্মপুত্র চিলমারী, যমুনা বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জে, গুর নদী সিংড়ায়, আত্রাই নদী বাঘাবাড়িতে, ধলেশ্বরী এলাসিনে, পদ্মা গোয়ালন্দ ও সুরেশ্বরে, সুরমা নদী কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জে, কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইলে ও তিতাস নদীর পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২ থেকে ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য হলো উজানের ঢলে বন্যার বিস্তার ঘটছে। এখন পর্যন্ত ১২টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদনদীগুলোর পানি সমতলে বাড়ছে। উজানে আরও বৃষ্টি হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। অথচ বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া দূরের কথা কষ্ট করে দুর্গত মানুষকে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি বর্তমানের জননেতারা একটি প্রেস রিলিজেও তাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করা হয় না। কয়েকদিন যাবৎ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যায় প্লাবিত। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। দুর্বিষহ তাদের জীবন। শুধু মানুষ নয়, ভাষাহীন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির অবস্থা শোচনীয়। টিভি মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় বন্যার খবর গুরুত্ব পাচ্ছে না। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বন্যা উপদ্রুত এলাকার বিপন্ন মানুষের কিছু কিছু দুরবস্থার দৃশ্য প্রচারিত হচ্ছে। ত্রাণ তৎপরতার কথা কোনো মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে না।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই আষাঢ়-শ্রাবণে বন্যায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হবে, ঘটবে ফসলহানি, নদীভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে, এটা বাংলাদেশের অবধারিত চিত্র। বর্ষার শুরু থেকেই এ চিত্র প্রবিছরের। কিন্তু কোনো বছরই প্রতিকারে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আজ দেশের উত্তরাঞ্চল বন্যাকবলিত, কিশোরগঞ্জের হাওর ও সুনামগঞ্জের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। অন্যান্য অঞ্চলও যে সামনের দিনে বন্যাকবলিত হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। দেশের নদ-নদীর অবস্থা ভালো নয়। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বৈরী আচণের কারণে অনেক নদীতেই পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষের খাদ্য ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানির কারণে অনেক জায়গায় রাস্তা ডুবে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শুধু রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় প্রায় ২ হাজার ২৭৪ হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে রোপা আমন, বীজতলা, আউস ও শাকসবজি। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বন্যায় পানির নীচে রংপুরে ৩৩০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৬৬২ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ২৫৭ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৯৭০ হেক্টর ও নীলফামারীতে ২৮৫ হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে রয়েছে। এর মধ্যে রংপুরে বীজতলা ৩০ হেক্টর, আমন ধান ১০০ হেক্টর, গাইবান্ধায় বীজতলা ১৭০ হেক্টর, আমন ধান ১৫০ হেক্টর এবং শাকসবজি ১১২ হেক্টর, কুড়িগ্রামে বীজতলা ২৯ হেক্টর, আমন ধান ১১০ হেক্টর, পাট ৪০ হেক্টর, আউস ৫৩ হেক্টর, শাকসবজি ৫৩ হেক্টর। লালমনিরহাটে বীজতলা ৯৬ হেক্টর, আমন ধান ৮৬২ হেক্টর ও শাকসবজি ১২ হেক্টর। নীলফামারীতে বীজতলা ৩৫ হেক্টর এবং আমন ধান ২৫০ হেক্টর পানির নিচে রয়েছে। বগুড়া, সিরাজগঘ্জ, সুনামগঞ্জসহ বন্যাকবলিত অন্যান্য জেলাগুলোর চিত্র প্রায় অভিন্ন। উপদ্রুত মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রশাসনকে পর্যাপ্ত ত্রাণের পাশাপাশি বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা করতে হবে। বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দিতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পরপরই নানা রোগব্যাধি দেখা দেবে। এসব রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আগ থেকেই নিয়ে রাখতে হবে। বিবেচনায় রাখতে হবে বন্যাদুর্গত দরিদ্র মানুষের বিকল্প জীবিকা। বন্যা ও নদীভাঙনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সহায়সম্বল হারানোর পাশাপাশি তাদের জীবিকার পথও বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। তবে এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পর্যাপ্ত ত্রাণ, বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ। আর কৃষকদের জন্য বীজ সরবরাহ করতে না পারলে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থেকে যাবে। এতে খাদ্যের ওপর চাপ বটে; অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জঙ্গি নিধনের মহারণে ব্যস্ত জনপ্রতিনিধিরা। দেশের বানভাসি মানুষের দিকে তাকানোর কেউ নেই। আসুন আমরা সবাই বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়াই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
সালাউদ্দিন ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:২৪ পিএম says : 0
জাতীয় ইস্যুর কারণে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দুর্দশার কথা ভুলে গেলে চলবে না।
Total Reply(0)
মিল্লাত ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:২৬ পিএম says : 0
দেশের বানভাসি মানুষের দিকে তাকানোর কি কেউ নেই ? এত দানোবীর লোকেরা এখন কোথায় গেলে ?
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন