মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মহামারী এবং নববী শিক্ষা

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী | প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০২০, ১২:০২ এএম

হাদিসে পাকে এসেছে, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘রোগ-ব্যাধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে লেগে যায় না।’-(সহিহ মুসলিম, হাদিস ৫৭৪২)। অসুস্থ ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে অসুস্থতা ছড়ানোকে ‘ওদওয়া’ বলা হয়। কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন, কোন ধরনেই রোগই ছোঁয়াচে নয়। তারা ধ্বংসাত্মক রোগগুলো থেকে বাঁচার জন্য তদবির করাকে তাওয়াক্কুল পরিপন্থী মনে করেন। তাদের এই বুঝ সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ধ্বংসাত্মক রোগ থেকে বাঁচার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। বিষয়টি নিন্মোক্ত দুটি হাদিস দ্বারা পরিষ্কার হবে।
১. সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উসামা ইবনে যায়েকে (রা.) জিজ্ঞেস করেন, প্লেগ-মহামারি সম্পর্কে আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে কি শুনেছেন? উসামা (রা.) বললেন, মহামারি হচ্ছে, এক প্রকার প্রাকৃতিক অভিশাপ বা শাস্তি, যা বনি ইসরাইল অথবা তোমাদের পূর্ববতীদের ওপর পাঠানো হয়েছিল। অতএব যখন তোমরা কোনো এলাকায় প্লেগ-মহামারির সংবাদ পাবে, সেখানে যাবে না। আর যদি তোমাদের এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব হয় তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে যাবে না।’-(সহিহ মুসলিম, হাদিস ৫৬০৭)।
২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তিনি সারগ নামক স্থানে পৌঁছলে আজনাদের অধিবাসীগণ আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এবং তাঁর সাথীরা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাকে জানান, সিরিয়ায় মহামারি দেখা দিয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ওমর (রা.) আমাকে বললেন, প্রথমে হিজরতকারী মুহাজিরদের আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। আমি তাদের ডেকে নিয়ে আসলাম। তিনি তাদের সাথে পরামর্শ করেন এবং তাদেরকে জানান যে, সিরিয়ায় মহামারি দেখা দিয়েছে। তারা এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গিয়ে মতভেদে লিপ্ত হন। কেউ কেউ বলেন, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হয়েছিলেন। তা থেকে ফিরে যাওয়া আমরা ঠিক মনে করি না। কেউ কেউ বলেন, আপনার সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবিগণ এবং আরও লোকজন আছেন, এমতাবস্থায় তাদের নিয়ে প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় যাওয়া সমীচীন মনে করি না। ওমর (রা.) বললেন, আচ্ছা! আপনারা চলে যান। অতঃপর তিনি বললেন, মক্কা বিজয়ের পূর্বে কুরাইশদের যেসব বয়োজ্যেষ্ঠ লোক মুসলমান হয়েছেন তাদের যারা এখানে উপস্থিত আছে তাদেরকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। আমি তাদের ডেকে আনলাম। তাদের মধ্যে দু’জন লোকও দ্বিমত পোষণ করেনি। তারা সবাই বললো, আমরা মনে করি, আপনি সকলকে নিয়ে ফিরে যান এবং তাদের নিয়ে মহামারি আক্রান্ত এলাকায় না যান। পরিশেষে ওমর (রা.) ঘোষণা করেন, সকালে আমি ফিরে যাওয়ার জন্য সওয়ার হবো। আবু উবাইদা (রা.) বলেন, আপনি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে কি পালাচ্ছেন? ওমর (রা.) বললেন, হে আবু উবাইদা, আফসোস! তুমি ছাড়া আর কেউ যদি এ কথা বলতো। ওমর (রা.) তার বিরোধিতায় বিরক্তি বোধ করলেন, হাঁ, আমরা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরের দিকেই পালাচ্ছি। তোমার যদি উট থাকে আর তুমি এমন একটা মাঠে তা চড়াতে যাও, যার একদিক সবুজ এবং অপর দিক শুষ্ক। এমতাবস্থায় তোমার উট যদি সবুজের দিকে চড়াও তাহলে তাও আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির অনুযায়ী চড়াচ্ছো। এ সম্পর্কে তুমি কি মনে করো? ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এমন সময় আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) আসেন। তিনি নিজের কোনো প্রয়োজনে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমার কাছে এর প্রমাণ আছে। আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো দেশ সম্পর্কে যখন তোমরা শোনো যে, সেখানে মহামারি দেখা দিয়েছে, তাহলে সেখানে যেওনা। আর যদি তোমাদের দেশে মহামারি দেখা দেয় তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে যেওনা। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ কথা শুনে ওমর (রা.) আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর রওয়ানা হন।’-(সহিহ মুসলিম, হাদিস ৫৬১৯)। এই সকল হাদিস দ্বারা বুঝা গেলো, ছোঁয়াচে মহামারি বিস্তার রোধের ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য মুসলমানদের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা তাওয়াক্কুল এবং তাকদিরের ওপর ঈমান রাখার পরিপন্থী নয়। বরং তাওয়াক্কুলের বাস্তবতা এটাই যে, ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সত্তাগতভাবে ক্রিয়াশীল মনে করার পরিবর্তে আল্লাহ ক্রিয়া সৃষ্টিকারী এর ওপর ঈমান রাখতে হবে। কেননা আসবাবের মধ্যে ক্রিয়াতো আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। তাঁর আদেশেই বস্তুতে ক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাকদিরের ওপর ঈমানের দাবিও এটাই। নবীজি (সা.) বলেছেন, অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ ব্যক্তি হতে আলাদা রাখা হবে।’-(সহিহ মুসলিম, হাদিস ৫৬২৬)।
মোটকথা মহামারি থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্য এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, কুষ্ঠ রোগী থেকে এমনভাবে বেঁচে থাকো, যেমনভাবে সিংহ থেকে বেঁচে থাকো।’-(৫৭০৭)। তবে আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) কুষ্ঠ রোগীকে নিজের সাথে বসিয়ে খাবার খাইয়েছেন।’-(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস)। নবীজি (সা.) এর এটা করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে কোন মহামারিতে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে তা যথাস্থানে ঠিক আছে। তবে এ রোগকে ঘৃণা করা যাবে না। যাতে অসুস্থ ব্যক্তির সুযোগ সুবিধে থাকে এবং তার অন্তরে বঞ্চিত হওয়ার কোনো অনুভূতি যাতে সৃষ্টি না হয়। সুতরাং বর্তমান সময়ের করোনা ভাইরাসের বিষয়টি সম্পর্কেও একই কথা। মহামারিতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যেয়ে যেন এ ধরনের রোগীকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা না হয়। ডাক্তার এবং স্বাস্থকর্মীরা যেন এ ধরণের অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা করতে ঘৃণা না করে।
‘রোগ-ব্যাধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে লেগে যায় না।’ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা নববি (রহ.) লিখেন, বাহ্যত এ ধরনের হাদিসগুলোতে বিরোধিতা লক্ষ করা যায়। এক হাদিসে অসুস্থ ব্যক্তি থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। আবার অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) এ ধরনের রোগীকে সাথে বসিয়ে খাবার খাওয়ানোর মতো মুবারক আমল বিদ্যমান। যা দ্বারা কোন রোগ সংক্রামক নেই বুঝা যায়। এই ধরনের হাদিসগুলোর সমাধানে বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, রোগের মধ্যে সংক্রমন হওয়ার বিষয়টি আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু সেটা আল্লাহর ইচ্ছায়ই ক্রিয়াশিল হয়। কোনো বস্তুতে কোন ক্রিয়া সত্তাগতভাবে নেই। আল্লাহ চাইলে সংক্রমন হবে নতুবা হবে না। কারণ আমরা দেখতে পাই, রোগীর কাছে বা চারপাশে থেকেও অনেক মানুষ সুস্থ থাকেন। আবার অনেক সতর্কতার পরেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে। যদি বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া ক্ষমতা থাকতো তাহলে ওষধ ব্যবহারকারী এবং ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যেতো। অথচ আমরা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করছি যে, এমনটা হচ্ছে না। অতএব যার জন্য আল্লাহর হুকুম হয় সেই অসুস্থ ব্যক্তির জন্যই ডাক্তারের ব্যবস্থপপত্র সঠিক হয় এবং তার বাতলে দেয়া ওষুধপত্র আরোগ্যের অছিলা হয়। সুতরাং যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) রোগ-ব্যাধির মৌলিকভাবে সংক্রমন হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তখন এক বেদুইন রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাহলে উটের অবস্থা কি? বালুতে তো হরিণের মতো পরিষ্কার থাকে। অতঃপর খোশ পাঁচড়ায় আক্রান্ত একটা উট এসে সুস্থ উটের সাথে মিশে যায় এবং সেগুলোও চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। তিনি বললেন, প্রথম উটটিকে কে আক্রান্ত করেছে?-(সহিহ মুসলিম, হাদিস ৫৬২৩)। হাদিসের উদ্দেশ্য হলো, রাসূল (সা.) রোগ সংক্রমন হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেননি, যেহেতু এটি একটি বাস্তব বিষয়। বরং এখানে তিনি আল্লাহ তায়ালার কুদরতের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন এবং বলে দিয়েছেন মাধ্যমের জগত মাধ্যমসৃষ্টিকারীর হুকুমের অধীন। তাই ব্যবস্থাগত হিসেবে আসবাবকে গ্রহণ করা যাবে। তবে সব কিছুকে সৃষ্টিকারী আল্লাহর হুকুমের অধীন মনে করতে হবে। শুধুমাত্র কারণ আসবাব ইত্যাদিকে প্রকৃত ক্রিয়াসৃষ্টিকারী মনে করা ইলহাদ তথা ভ্রষ্টতা। এ ধরনের বিশ্বাসে বিশ্বাসী লোকদিগকে মুলহিদ বলা হয়।
মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করেন যে, সব কিছুর ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের আশঙ্কায় ভয় এবং চিন্তার কারণ নেই। তবে অবশ্যই তওবার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসসহ যে সকল রোগের ব্যাপারে জানা যাবে যে, এ রোগটি নিশ্চিত সংক্রামক। সেসকল রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মহামারিতে পড়ার দোয়া: হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি নিন্মোক্ত দোয়াটি সন্ধায় তিনবার পাঠ করবে সকাল হওয়া পর্যন্ত তার প্রতি কোনো বিপদ হঠাৎ চলে আসবে না। আর যে সকালে তা তিনবার পাঠ করবে সন্ধা পর্যৗল্প তার ওপর কোনো হঠাৎ বিপদ আসবে না। দোয়াটি হলো-
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাজি ইয়াদুররুহু মাআসমিহি শাইউ ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা-ই, ওয়াহুয়াস সামীউল আলীম।
অর্থ: আল্লাহর নামে যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।’-(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৫০৮৮)।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, (রোগ-ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য) নবীজি (সা.) পড়তেন-
‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আউজু বিকা মিনাল বারসি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুযামি ওয়া মিন সাইয়্যিল আসকাম।’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উম্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সব দুরারোগ্য ব্যাধি হতে।’-(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৫৪)।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে এসেছে, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওপর কোনো কাজ কঠিন হয়ে দেখা দিত, তখন তিনি এ দোয়াটি পড়তেন।-
উচ্চারণ: ‘ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু বিরাহমাতিকা আসতাগিছ।’
অর্থ: হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্ব চরাচরে ধারক! আমি তোমার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।-(সুনানে তিরমিজি, হাদিস ২৪৫৪)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন