শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রবাস জীবন

মালয়েশিয়া থেকে এক মাসে ৮৩ কর্মীর লাশ

প্রবাসী কর্মীদের লাশ দেখে স্বজনদের আহাজারি

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২০, ৪:১২ পিএম

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারীতে বহির্বিশ্বে লাখ লাখ বাংলাদেশি চাকরি হারানো ঝুঁকির মুখে রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন কোম্পানীতে কাজ না থাকায় অনেক প্রবাসী কর্মীই খালি হাতে দেশে ফিরছে। চলমান মহামারীর এ দুর্দিনের মাঝে প্রবাসে মৃত কর্মীদের লাশ দেখে স্বজনদের মাঝে চলছে আহাজারি। বিদেশে মৃত কর্মীর লাশ এক নজর দেখার জন্য প্রতিবেশিরাও ছুটে যাচ্ছেন তাদের বাড়িতে। পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানা কারণে অনেক কর্মীই মারা যাচ্ছে। ঋণগ্রস্ত এসব অসহায় প্রবাসী পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
পরিবারের আর্থিক অভাব অনটনের খবরে মানসিক দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবারের অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাসের কারণে প্রবাসে অনেক কর্মী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। অভিজ্ঞ মহল এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বিমান বন্দরের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মহামারীর মাঝেও বিশেষ ফ্লাইট যোগে সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে প্রতি সপ্তাহেই মৃত কর্মীদের লাশ আসছে। সউদীর বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিন যাবত শতাধিক প্রবাসী কর্মীর লাশ পড়ে রয়েছে। রিয়াদের একটি হাসপাতাল মর্গেই ৮১টি প্রবাসী কর্মীর লাশ পড়ে রয়েছে। এসব লাশ দ্রুত দাফনের জন্য সউদী সরকার রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকে দফায় দফায় চাপ দিচ্ছে। আতœীয় স্বজনের অনুমতির অভাবে এসব লাশ দেশে পাঠাতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেক প্রবাসী কর্মী লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। গত এক মাসে দেশটি থেকে ৮৩ জন প্রবাসী কর্মীর লাশ দেশে পৌঁছেছে। সোমবার গভীর রাতেও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইট যোগে ১৫ প্রবাসী কর্মীর লাশ হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছেছে। এসব লাশের কফিন দেখে অপেক্ষমান আত্মীয় স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দেশটিতে কর্মরত অবস্থায় এসব কর্মী হৃদরোগসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছে। বিমান বন্দরে কল্যাণ ডেস্কের এডি ফখরুল আলম আজ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সোমবার রাতে মালয়েশিয়া থেকে যেসব মৃত কর্মীর লাশ দেশে পৌঁছেছে তারা হচ্ছে, মুন্সিগঞ্জের এনামুল হক, আলম শেখ, কুমিল্লার হুমায়ূন কবির, সিরাজুল ইসলাম, চাঁদপুরের মো. সেলিম, মান্নান গাজী, শরীয়তপুরের সেলিম সরদার, ফেনীর মো.অজিউল্লাহ, নারায়ণগঞ্জের শাহাদাৎ আলী, যশোরের মো. আবু বকর সিদ্দিক, বগুড়ার মো. আইনুল ও নরসিংদীর মাসুদ রানা। বাকি তিন জন অবৈধ কর্মী হওয়ায় তাদের নাম জানা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭৮ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশটিতে ১০ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৪ কর্মী চাকরি লাভ করে। ২০১৭-২০১৮ সালে দশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনপ্রতি তিন লাখ টাকা থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় তিন লাখ কর্মী দেশটিতে চাকরি লাভ করে। এসব কর্মীর অনেকেই ভিটেমাটি বিক্রি ও চড়া সুদে ঋণ করে মালয়েশিয়ায় গিয়ে অভিবাসন ব্যয়ের টাকাই তুলতে পারেনি। দেশটিতে বর্তমানের বৈধ অবৈধ মিলে ৬ লক্ষাধিক প্রবাসী কর্মী রয়েছে। এসব কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি মাসে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। দেশটি থেকে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাসী কর্মীরা ২২৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৯ সালে দেশটি থেকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় প্রায় ৪৫ হাজার অবৈধ কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে।
মালয়েশিয়া থেকে আসা প্রবাসী কর্মীদের লাশ পরিবহনের ভাড়া বাবদ এবং দাফন কাফনের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল থেকে প্রত্যেক পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে কল্যাণ তহবিল থেকে প্রবাসে মৃত কর্মীদের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে দেয়া হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সেলর (শ্রম) জহিরুল ইসলাম আজ মঙ্গলবার ইনকিলাবকে জানান, মৃত কর্মীদের লাশ দেশে পাঠানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কোম্পানীগুলোর। তারা একটি সংস্থার মাধ্যমে মৃত কর্মীদের লাশ বাংলাদেশে পাঠায়। সেক্ষেত্রে হাইকমিশন শুধু লাশ পাঠানোর অনুমতি দিয়ে থাকে। মৃত কর্মীর লাশ দেশে প্রেরণে হাইকমিশনের কোনো গাফলতি নেই বলেও তিনি দাবি করেন। গত এক মাসে দেশটি থেকে ৮৩ জন বাংলাদেশি কর্মীর লাশ দেশে পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে বর্তমানে কত মৃত কর্মীর লাশ পড়ে রয়েছে তার কোনো সঠিক সংখ্যা জানা নেই বলে কাউন্সেলর (শ্রম) জানান। তিনি বলেন, মৃত কর্মীর লাশ দেশে পাঠাতে সংশ্লিষ্ট আত্মীয় স্বজনের অনুমতিপত্র লাগে। এ জন্য লাশ পাঠাতে কিছুটা বিলম্ব হয় ।
মালয়েশিয়ার পেনাংস্থ মুসলিম কমিউনিটি অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান ও প্রবাসী ব্যবসায়ী মো. মোশাররফ হোসেন রিপন আজ মঙ্গলবার ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মীদের অনেক আবাসনগুলোই স্বাস্থ্য সম্মত নয়। প্রবাসী কর্মীদের হোষ্টেলগুলোতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস নেই। মালয়েশিয়ার অনেক কোম্পানী আর্থিক সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে কর্মীদেরকে হোষ্টেলে গাদাগাদি করে রাখে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী ব্যবসায়ী রিপন বলেন, পরিবারের আর্থিক অভাব অনটনের খবরে মানসিক দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবারের অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাসের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রবাসী কর্মীর মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় বহন করে কর্মীরা বিদেশে গিয়ে সর্বদাই মারাত্মক দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তিনি বলেন,কর্মস্থলে যথাযথ নিরাপত্তা এবং অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই কর্মীদের বিদেশে যেতে হবে। এতে প্রবাসে কর্মীদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন