মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কাঙক্ষিত বিশ্বের জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করতে হবে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

সর্বোন্নত দেশের দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মতো অন্যতম দরিদ্রতম দেশ, কেউই করোনার অভিশাপ থেকে সহসা মুক্ত হবে বলে দাবি করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র তো শুধু করোনায় আক্রান্তের দিক দিয়েই শীর্ষে অবস্থান করছে না, বরং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিক দিয়েও তার অবস্থান সবার শীর্ষে। আর বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে, ইতোমধ্যে করোনায় প্রথম আক্রান্ত চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞদের যে পরামর্শ আমাদের জন্য বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমরা নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুর শিকার হবো কিনা, তা এখন আমাদেরই ঠিক করতে হবে। আমাদের নিজেদেরকেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আত্মরক্ষার নামে একেবারে অমানবিক হওয়াও চলবে না। যেমন দেখা গেছে, মা আক্রান্ত হয়েছে এই সন্দেহে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেইটে অসুস্থ মাকে ফেলে রেখে চলে গেছে ছেলে। যে মা ঐ ছেলেকে নয় মাস গর্ভে রেখে জন্ম দান ও শৈশবে লালন-পালন করে বড় করেছে তাকে করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে মেডিকেল কলেজের গেইটে ফেলে যাওয়া যদি সমর্থনযোগ্য হতো তাহলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধুমাত্র পেশাগত ও মানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় করোনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতেন না। নিজের গর্ভধারিনী মাকে করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে মেডিকেল কলেজের গেইটে ফেলে যাওয়া যে কত বড় অমানবিক ও লজ্জাজনক বিষয়, তা একদিন না একদিন ঐ ছেলে বুঝতে পারবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

তবে কি করোনার অভিশাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের কিছুই করার নেই? এ প্রশ্নের জবাবে বলব, আছে। করার আছে। তবে তা এমন কিছু নয় যা মানুষকে মনুষ্য নামের অযোগ্য অমানুষ করে তোলে। এমন কিছু করা কিছুতেই তার জন্য কাম্য হতে পারে না। কারণ মানুষ বিশ্ব¯্রষ্টার অত্যন্ত প্রিয় একটি সৃষ্টি। বিশ্ব¯্রষ্টা আল্লাহতায়ালা যখন ফেরেশতাদের কাছে পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি হিসাবে মানুষ সৃষ্টির কথা প্রথম বলেছিলেন, ফেরেশতারা বলেছিল, আপনি কি পৃথিবীতে এমন একটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যারা পৃথিবীতে নিজেরা মারামারি করে, ঝগড়া বিবাদ করে রক্তরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে? প্রশ্ন ওঠে, ফেরেশতারা মানুষদের সম্বন্ধে এই খারাপ ধারণা পেলো কোথা থেকে? জবাবে বলতে হয় মানুষ সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ জিন জাতি সৃষ্টি করেন এবং তাদের বাস্তব আচরণ থেকেই ফেরেশতাদের মধ্যে এরূপ আশংকা সৃষ্টি হয়েছিল। আল্লাহ তখন ফেরেশতাদের এই বলে সান্ত¦না দিয়েছিলেন যে, তোমরা মানুষদের সম্বন্ধে যা জান না, তা ধারণা করা তোমাদের জন্য উচিৎ নয়।

আসলে আল্লাহতায়ালা এমন কিছু মানুষ সৃষ্টি করেন, যারা আল্লাহর দেয়া প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী, যারা ভালো ও মন্দ কাজের মধ্যকার পার্থক্য সম্বন্ধে অবহিত থাকার কারণে আল্লাহর কুদরতের গুণে ভুল করেন না। আল্লাহর পছন্দনীয় সেই লোকেরা তারা সব সময়ে আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবন চালনা করেন বলে তারা সব সময় সর্বাধিক সঠিক পথে চলেন। ফলে তারা সব সময় আল্লাহর প্রিয়ভাজন থাকেন। এই নিরিখে বলা যায়, আল্লাহ যে মানুষ ও জিন সৃষ্টি করেছেন, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তারা যেন এই পার্থিব জীবনে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাদের জীবন পরিচালনা করে এবং কিছুতেই তার অন্যথা নাকরে। কারণ, অন্যথা করলে পরজগতে তাদের আল্লাহর বিধান অমান্য করার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। অপর পক্ষে এদের মধ্যে যারা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পার্থিব জীবন পরিচালনা করে তারা পরকালে তার সুফল উপভোগ করবে।

এসব কথা বলার কারণ হচ্ছে, পার্থিব জীবন অল্পদিনের জন্য। তার তুলনায় পরকালীন জীবন অনন্ত কালের জন্য। কিন্তু পার্থিব জীবন স্বল্পকালীন হলেও এই স্বল্পকালীন জীবনে আমরা যেভাবে চলব সেভাবেই আমরা অনন্তকালের জীবনে তার সুফল উপভোগ করতে পারব।

সুতরাং মানুষ সৃষ্টির পেছনে বিশ্ব¯্রষ্টা আল্লাহতায়ালার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য তা হচ্ছে, এই পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্টি এই মানুষেরা আল্লাহর ইচ্ছা ও বিধান মোতাবেক জগৎ ও জীবন চালাতে আন্তরিক চেষ্টা করে যাবে এবং এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে বাস্তব ক্ষেত্রে কাজ করে যাবেন।

তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা সব সময় সহজ ও সুখকর হবে না। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির কারণে ইবলিশ প্রথম দিন থেকেই মানবজাতিকে ভুল পথে চালনার ষড়যন্ত্র করেছিল। আল্লাহতায়ালা আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.)-কে সাবধান করে দিয়েছিলেন একটি বিশেষ বৃক্ষের কাছে না যাওয়ার জন্য। ঐ বৃক্ষের নিকট গেলে এবং ফল ভক্ষন করলে তার পরিণতিতে তারা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালার এই সাবধানতা সম্পর্কে ইবলিশ আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে অসত্য ধারণা দিয়ে বলে যে, ঐ গাছের ফল ভক্ষন করলে তারা চিরজীবী হতে পারবে অথবা ফেরেশতা হয়ে যেতে পারবে। ইবলিশের এই মিথ্যাচার বিশ্বাস করে ঐ নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষন করে ফেলার পর তার পরিণতিতে লজ্জিত অবস্থায় তারা পতিত হন। অতঃপর তারা আল্লাহতায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন, যা অদ্যাবধি আমরা মানুষরা সেই প্রার্থনা মোতাবেক নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি। যার বাংলা মর্মবাণী: হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি, অন্যায় করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব। রাব্বানা জালাম না আন ফুছানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তার হামনা লা নাকুনান্না মিনাল খসিরিন। আজও দুনিয়াভর আদম সন্তানরা এই করুণ প্রার্থনার মাধ্যমে তাদের কৃত ভুল অন্যায় ও পাপের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে থাকে।

আজ দুনিয়াজুড়ে করোনাভাইরাস নামের যে রহস্যময় রোগ দেখা দিয়েছে, যার হাত থেকে মুক্তি পেতে এ যাবৎ কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। এর হাত থেকে মুক্তি পেতে আমাদের যেমন বিভিন্ন ওষুধ আবিষ্কারের দিকে মনযোগী হতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, তেমনি সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আন্তরিকভাবে মোনাজাত চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, এই মহামারী রোগ থেকে মুক্তি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর নির্ভর করে না। কেননা, আমাদের জীবনে আমরা এত বেশি অন্যায় করেছি যে, তার অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর নির্ভর করবে না। এর জন্য সর্ব শক্তিমান বিশ্বপালক রাব্বুল আলামিনের ক্ষমা এবং দয়া লাভের চেষ্টাও অত্যাবশ্যক।

শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপরই যদি করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব হতো তাহলে আজকের সর্বাপেক্ষা উন্নত দেশ বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ভাইরাস দ্বারা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। সুতরাং, আমাদের যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর জোর দিতে হবে, তেমনি আজকের দিনে পৃথিবীজুড়ে যেসব অন্যায় উৎপীড়ন, নির্যাতনের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে অসহনীয় জীবন যাপনে বাধ্য করা হচ্ছে, সেসব থেকে মুক্ত করে বিশ্বের ¯্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় সৃষ্টি মানবজাতিকে এই পৃথিবীর প্রতিনিধি হিসাবে সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হবে। সকল প্রকার জুলুম, অন্যায় নির্যাতনের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে বিশ্ব¯্রষ্টার প্রিয় সৃষ্টি মানবজাতিকে ¯্রষ্টার প্রতিনিধি (খলিফা) হিসাবে তাদের প্রকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুনিয়ার সা¤্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ প্রভৃতি অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন