বেহাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে বিপাকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ যেন গলারকাঁটা। এবারের বর্ষায় পানি নিষ্কাশন কিভাবে হবে তার কোনো সমাধান মেলেনি। গত বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়া কয়েকটি বড় বড় ড্রেনেজ প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি। রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করে ড্রেনেজের কাজ শেষ না করেই বিল তুলে নিয়ে গেছেন ঠিকাদাররা। সরকারদলীয় প্রভাবশালী সেই সব ঠিকাদাররা এখন আর সেই কাজের দায় নিচ্ছেন না। এর মধ্যে আবার ছোট ছোট প্রকল্প যুক্ত করা হয়েছে। সেগুলোর কাজ ধীর গতিতে চললেও টেকসই সমাধান মিলছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বয়হীনতায় যুগ যুগ ধরে রাজধানীতে এ সমস্যা লেগেই আছে। প্রতি বছর বর্ষায় সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছে রাজধানীবাসী। সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারও বর্ষায় রাজধানীর অনেক এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই চলতি মাসের কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে রাজধানীবাসীকে।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সামান্য বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যায় রাজধানীর ৫৯টি এলাকা। এর মধ্যে উত্তরের ২৯টি এবং দক্ষিণে রয়েছে ৩০টি। এসব এলাকার পানি নিষ্কাশনের অধিকাংশ চ্যানেল অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। পানিবদ্ধতাপ্রবণ এসব এলাকা নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এলাকাভিত্তিক পানিবদ্ধতা নিরসনে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকার সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। তবে পানি নিষ্কাশনের বড় বড় সার্ফেস ড্রেনগুলো হচ্ছে ঢাকা ওয়াসার। অনেক এলাকায় ওয়াসার ড্রেনেজের কাজ শেষ না করেই ফেলে রাখা হয়েছে। ফেলে রাখা মাটির গর্তে পানি জমে আশপাশের রাস্তাও কর্দমাক্ত হয়ে আছে। বৃষ্টি না হলে একই স্থানের ধূলাবালিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। আবার যে সব ড্রেনেজের কাজ শেষ হয়েছে সেগুলোও পরিষ্কার না থাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, ডিএনসিসির পানিবদ্ধতাপ্রবণ ২৯টি এলাকা হচ্ছে আশকোনা, বিমানবন্দর সড়কের আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী ২৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত, মিরপুর সাংবাদিক কলোনি এলাকা, নয়াটোলা শহীদ আবদুল ওয়াহাব রোড, উত্তর বেগুনবাড়ি, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পূর্ব মনিপুর, দক্ষিণ মনিপুর, আমতলা, পিরেরবাগ, মিরপুর ১০, মিরপুর ১৩, বাংলামোটর বিয়াম ভবনের গলি, মধুবাগ প্রধান সড়ক, শাশাববাড়ি, কাওরানবাজার টিসিবি ভবন সংলগ্ন এফডিসি থেকে সার্ক ফোয়ারা, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণি, নিকুঞ্জ-১, নিকুঞ্জ-২, পশ্চিম নাখালপাড়া, পাগলারপুল, পূর্ব রাজাবাজার, পশ্চিম রাজাবাজার, বসুন্ধরা সিটির পেছনে তেজতুরী বাজারের গার্ডেন রোড, গ্রিন রোড এবং উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর।
এরমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে বিমানবন্দরের সামনে থেকে বনানী ২৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত অংশের পানি নিষ্কাশন নালা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নালাটি সচল করার জন্য ডিএনসিসি থেকে সিভিল অ্যাভিয়েশনকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তাদের বরাদ্দ না থাকায় সেই কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি নিজেই। তিন কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে।
উত্তরার বেহাল দশা
রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের ড্রেনেজ লাইন উন্নত করার জন্য সংস্কার কাজ শুরু হলেও তা শেষ হচ্ছে না। কোথাও অর্ধেক, কোথাও অর্ধেকের একটু বেশি কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে অনেক দিন যাবত। আর বেশিরভাগ ড্রেনেজ পরিষ্কার করার কাজ করা হলেও আদতে তা কোন কাজেই লাগছে না। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে সড়ক। মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। উত্তরার মূল সড়কে র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ চলায় সেক্টরের ভিতর থেকে মূল সড়কে আসতেই নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। ধূলাবালির অসহ্য যন্ত্রণা তো নিত্যদিনের সঙ্গি। ডিএনসিসির একজন কর্মকর্তা জানান, উত্তরা এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসি শায়েস্তা-খাঁ এভিনিউ থেকে ময়মনসিংহ রোড পর্যন্ত ড্রেনেজ পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া রেলওয়ে কালভার্ট থেকে সিএএবি’র বক্স কালভার্ট ড্রেনেজ লাইন নির্মাণসহ কসাইবাড়ী খালের আপস্ট্রিম খনন করেছে ঢাকা ওয়াসা। এদিকে, উত্তরার পাশের দক্ষিণখান ও তুরাগ থানার অবস্থা করুণ দীর্ঘদিন ধরেই। এসব এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন ওয়ার্ড হিসেবে সিটি করপোরেশনে যুক্ত হলেও তুরাগ ও দক্ষিণখানে উন্নয়ন কাজ হচ্ছে না। বৃষ্টিতে পুরো রাস্তা ডুবে যায়, ড্রেন ভরাট হয়ে থাকায় ময়লা পানি উপচে পড়ে বাসা-বাড়িতে পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে মানুষ বের হয়ে অফিসে পর্যন্ত যেতে পারেন না, রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাবার কারণে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তরার ৪ নং সেক্টর, ৬ নং সেক্টরের কিছু রাস্তা ও ড্রেনেজের সামান্য কাজ করে গত বছরের অক্টোবর থেকে ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়ন কাজও ফেলা রাখা হয়েছে। ৪ নং সেক্টরের আর্মড ফোর্স ব্যাটেলিয়ান (এপিবিএন) এর উত্তর পাশের রাস্তার এক পাশ দীর্ঘদিন ধরে বাঁশ ফেলে আটকে রাখা হয়েছে। ড্রেনেজের কাজ শুরু হলেও তা শেষ হবার নাম নেই।
৬ নং সেক্টরের রাজউক স্কুল এন্ড কলেজের পাশের কয়েকটি রাস্তা ও ড্রেনের কাজও ফেলে রাখা হয়েছে। স্কুল কলেজ সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছিল। সংস্কার আর উন্নয়ন চলছে তো চলছেই, শেষ হবার কোন নাম নেই।
উত্তরার সেক্টরের বাইরের তুরাগ থানার ওয়ার্ডগুলোর রাস্তা প্রায় সবগুলোই ভাঙাচোরা। ড্রেনেজের অবস্থাও বেহাল। দক্ষিণ খানের আশকোনা হজ্জ ক্যাম্পের রাস্তা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায়। এছাড়া কসাইবাড়ি-মোল্লারটেক দক্ষিণখান বাজার, আব্দুল্লাহপুর থেকে ফায়দাবাদ এলাকা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব এলাকার ড্রেনের পানি নামার ব্যবস্থার কোন পরিকল্পনা ছাড়াই কাজ শেষ করা হয়েছে। অনেক ড্রেন রাস্তা থেকে উঁচুতে করা হয়েছে। এতে প্রত্যেকটি বাড়ি উঁচু করতে হয়েছে। তা না হলে ড্রেনের পানি বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
এদিকে হাতিরঝিল সংলগ্ন আশপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে হাতিরঝিল প্রকল্পের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বর্ষায় তীব্র পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। ভারি বৃষ্টি হলে এই পানিবদ্ধতা কাঁঠালবাগান, কলাবাগান ও ধানমন্ডি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া শাশাবাড়ি এলাকার ড্রেন পরিষ্কার করার জন্য ডিএনসিসি থেকে ওয়াসাকে চিঠি দেওয়া হলেও ওয়াসা সেই ড্রেন পরিষ্কার করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় ডিএনসিসিকে। এ অবস্থায় গত ৩০ মে এলাকাটি পরিদর্শনে যান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের যেসব পথ রয়েছে সেগুলো একেকটি একেক সংস্থার। এখন অন্য সংস্থাগুলো তাদের মালিকানাধীন খাল বা নালা সচল রাখতে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যে কারণে পানি জমে থাকছে। তিনি বলেন, আশকোনার হাজি ক্যাম্প থেকে রেললাইন বরাবর একটি খাল রয়েছে। সেটি সিভিল অ্যাভিয়েশনের। কিন্তু খালটি বন্ধ। কে খুঁড়বে, তার দায়িত্বও কেউ নিচ্ছে না। আমরা তাদেরকে বারবার বলেছি। খালটি সচল করেনি। এখন আমরাই ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কারণ মানুষ সিভিল অ্যাভিয়েশনকে চেনে না। চেনে মেয়রকে।
ঢাকা দক্ষিণেও ভোগান্তি
ডিএসসিসির তালিকা অনুযায়ী ৩০টি স্থান হচ্ছে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড ও পশ্চিম ধানমন্ডি ঈদগাহ রোড; ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নিউমার্কেট সাইকেল স্ট্যান্ড; ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের ইস্কাটন রোড; ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকা; ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিমউদ্দিন রোড ও ঢাকা কারাগার সদর দফতরের সামনের অংশ; ২২ নম্বর ওয়ার্ডের গণকটুলী সিটি কলোনির সামনের এলাকা; ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের নবাবগঞ্জ পার্ক; ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঝিগাতলা কাঁচাবাজার মসজিদের পাশের এলাকা; ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বংশাল ২৮ কে পি ঘোষ স্ট্রিট কসাইটুলী; ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আগাসাদেক রোড, আগামাসি লেন, আব্দুল হাদি লেন, বাংলাদেশ মাঠের সামনের রাস্তা, মাজেদ সরদার রোড ও সিক্কাটুলী; ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিরা বাজার, সিদ্দিক বাজার ও আলু বাজার; ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওলাদ হোসেন লেন ও নবরায় লেন; ৭, ৩৯ ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিয়াজান গলি, মাদরাসা গলি, ঋষি পাড়া, কে এম দাস লেন সংলগ্ন রাস্তা, আরকে মিশন রোড ও অভয়দাস লেন গোপীবাগ বাজার রোড এবং ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ধলপুর স্টাফ কোয়ার্টার ও ১৪ নং আউটফল ধলপুর ওয়াসা রোড। এসব এলাকায় ইতোমধ্যে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে সমস্যাপ্রবণ কয়েকটি এলাকার পানিবদ্ধতা দূর করেছি। এছাড়া প্রায় প্রতিটি এলাকার অলিগলিতে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে পানি নিষ্কাশনের বড় বড় ড্রেনের মালিক ঢাকা ওয়াসা। আমাদের ড্রেনের মাধ্যমে ওয়াসার ড্রেনে গিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এখন পানিবদ্ধতা হবে নাকি হবে না তা নির্ভর করছে ওয়াসার ড্রেন বা বক্স কালভার্টের ওপর।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঢাকাকে পানিবদ্ধতামুক্ত করতে হলে বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। কোন এলাকার পানি কোন পথ দিয়ে কীভাবে আউট করতে হবে সে বিষয়ে আগে সব সংস্থার যৌথ পরিকল্পনা করতে হবে। এরপর কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একেক এলাকা নিয়ে একেক বছর সমস্যায় হতেই থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন