মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাসৃষ্ট মন্দা মোকাবেলায় একসাথে কাজ করতে হবে

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

লকডাউনের কারণে বিশ্বের সকল দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এ সময়ে অর্থনীতি ব্রেকডাউন করেছে। শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যাতায়াত বন্ধের কারণে সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে সর্বত্রই অচলাবস্থা এবং অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি হয়েছে। আর যেহেতু প্রতিটি দেশ একে অপরের সাথে যুক্ত এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল তাই মন্দায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের জোয়ার ভাটা, হিমালয় আর মেরু অঞ্চলের বরফ গলায় সারাবিশ্বের পানির স্তর যেমন প্রভাবিত হয় ঠিক তেমনি করোনার প্রভাবে সৃষ্ট মন্দায় সারা বিশ্ব প্রভাবিত হয়েছে। করোনাভাইরাসে সৃষ্ট বিপর্যয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন আজ বাধাগ্রস্ত এবং সবাই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে পরিবর্তন আসবে এবং তারা ব্যয় সংঙ্কুচনের নীতি গ্রহণ করবে। তারা ভবিষ্যতে বিলাসী জীবনযাপন পরিত্যাগ করতে শুরু করবে এবং ন্যূনতম যা প্রয়োজন কেবল তা কিনতেই অর্থ ব্যয় করবে। ফলে বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদা কমতে থাকবে এবং এর কারণে ঐসব পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কীভাবে মন্দার সৃষ্টি হয়, দু’একটি উদাহরণ দিলে তা আরো পরিষ্কার হবে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোর লোকজন আগের মতো বেশি করে কাপড় কিনবে না। আগে যেখানে একজন সচ্ছল লোক বছরে বারটি জামা কিনত, সেখানে খরচ কমানোর জন্য সে এখন হয়ত বছরে আটটি জামা কিনবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাজারে কাপড়ের চাহিদা কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাজারে কাপড়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ বা অন্য যেসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে/ইউরোপে কাপড় রপ্তানি হয়, সেসব রপ্তানিকারক দেশের রপ্তানির পরিমাণ কমে যাবে। ফলে পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে জনবল ছাঁটাই করবে। এসব জনবল বেকার হবে। এদিকে কাপড়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় সুতা উৎপাদন কারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সমস্যায় পড়বে। লোকসান এড়াতে স্পিনিং এবং টেক্সটাইল মিলগুলোও লোকজন ছাঁটাই করবে। এভাবে গার্মেট, স্পিনিং এবং টেক্সটাইলসহ ব্যাকওয়ার্ড শিল্পে জড়িত সবাই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি এবং দেশ থেকে বিদেশে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কাস্টমস এবং বন্দরের আয়ও কমে যাবে। ফলে রাজস্ব আয়ও কমে যাবে। এদিকে সিএন্ডএফ এজেন্টদের কাজ কমে যাবে। পরিবহন ব্যবসায় নিয়োজিতদের আয়ও কমে যাবে। একইভাবে খরচ কমাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের লোকেরা চিংড়ি মাছ খাওয়া কমিয়ে দেবে। আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহেই কয়েকবার চিংড়ি দিয়ে খাবার খেত এখন সেখানে মাসেই দু’একবার খাবে। ফলে ওই সব দেশে চিংড়ির চাহিদা কমে যাবে এবং বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি কমে যাবে। এতে চিংড়ি শিল্পে জড়িতদের সবারই জীবনে মন্দা সৃষ্টি হবে। এদিকে মানুষ তার ব্যয় সঙ্কুচন করতে গিয়ে বেড়ানো কমিয়ে দেবে। ফলে পর্যটন শিল্পেও মন্দা চলবে। এর প্রভাবে হোটেল ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা সবই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। আয় কমে যাওয়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে নতুন করে বাড়ি তৈরি করা এবং অ্যাপার্টমেন্ট কেনা কমিয়ে দেবে। ফলে ইট, রড, সিমেন্ট, বালি, টাইলস, বাথরুম ফিটিংস, দরজা- জানালাসহ হাউজিং ব্যবসায় জড়িত সব ব্যবসায়ে মন্দা সৃষ্টি হবে এবং এ শিল্পে জড়িত লোকজন সমস্যায় পড়বে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ রেমিট্যান্স নির্ভর দেশ। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ দেশের আয়ের অন্যতম বড় উৎস। প্রায় আশি লক্ষ মানুষ বিদেশে কর্মরত আছে। তাদের পাঠানো টাকায় সচ্ছল তাদের পরিবার এবং সচল দেশের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু করোনার প্রভাবে বিদেশ থেকে প্রচুর বাংলাদেশি কাজ হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছে। তারা এক প্রকার বেকার হয়ে পড়েছে। আবার বিদেশে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় নতুন করে বিদেশে যাওয়ার সংখ্যাও কমে গেছে। এই সমস্যা কিন্তু সহসাই দূর হবে না। এই সেক্টরেও একটা বির্পযয় নেমে আসবে এবং এই সেক্টরে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি, বিমান কর্তৃপক্ষসহ সবারই ইনকাম কমে যাবে। এর প্রভাব কিন্তু ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর আয় কমে গেছে এবং তাদের জীবন কষ্টে পড়েছে। পাশাপাশি দেশে ফরেন রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণও কমে যাবে, ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সংকট উত্তরণে সবাইকে কাজ করতে হবে। অতি দ্রত এদেশের লোকজন যেন আবারো বিদেশ যেতে পারে এবং তারা যেন বিদেশ গিয়ে কাজ করতে পারে, সে জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আরো বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। লকডাউনের কারণে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং একটি বিপর্যয় নেমে এসেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন না থাকায় রিক্সাচালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, হকারসহ সবার ইনকাম কমে গেছে। যারা দিন মজুর এবং যারা দিনে এনে দিনে খায়, তারা খুব সমস্যায় পড়েছে। দোকান-পাঠ বন্ধ থাকায় দোকানের কর্মচারী এবং তাদের পরিবার কষ্টে আছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়েছে। লকডাউনের সময় বাস, লঞ্চ, স্টিমার বন্ধ থাকায় এ সেক্টরে জড়িত সবার ইনকামই কমে গেছে। লকডাউনের সময়ে দুধ বিক্রি করতে না পারায় ডেইরী ফার্মের মালিকরা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুরগীর বাচ্চা বিক্রি করতে না পারায় হ্যাচারী মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে সকল পেশা এবং সকল শ্রেণির মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে দুই/তিন মাস লকডাউন শেষে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই এখন লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছে। জুনের শুরু থেকেই অর্থনীতির কর্মকান্ড পুনরায় শুরুর মাধ্যমে জীবন যাত্রা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। এখন সব কিছু আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে। মূলত এর কোন বিকল্প নেই। লকডাউন শেষে এখন অর্থনীতির চাকা সচল হওয়া শুরু হয়েছে এবং এখনই সমস্যাটা প্রকটভাবে দেখা দেবে। লকডাউনের কারণে বিশ্বের সকল দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এই ক্ষতির পরিমাণ কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট এই অর্থনৈতিক মন্দার পরিমাণ ২০০৯ সালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার থেকেও বেশি। এখন সবাইকে বহু দিন ধরে এই ক্ষতির বোঝা বইতে হবে। তবে বেশি সংকটে পড়বে গরিব রাষ্ট্রসমূহ আর বেশি কষ্ঠ পাবে গরিব মানুষেরা। ধনী রাষ্ট্রসমূহের পক্ষে অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যতটা সহজ গরিব রাষ্ট্রসমূহের পক্ষে তা ততটাই কঠিন। তাই এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সবাইকেই একযোগে কাজ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএফসি, আইডিবি, এডিবিসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। তাদের ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জি-৮-সহ বিশ্বের সকল ধনী রাষ্ট্রসমূহকে মানবতার স্বার্থেই গরিব রাষ্ট্রসমূহকে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। ইউএসএইড, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে সিএসআর এর অংশ হিসাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে। এই অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে বেইল আউট প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের সময় দিতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করার জন্য বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ নীতিমালাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং বিদ্যমান ঋণের পুনর্গঠন করতে হবে। তবে এই সুযোগে কেউ যেন অপ্রয়োজনীয় ঋণ নিতে না পারে সে বিষয়টিকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কৃষির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং কৃষি খাতে বাজেট আরো বাড়াতে হবে। সকল ব্যাংকের সকল শাখা থেকে কৃষকরা যেন সহজ শর্তে ঋণ পায় সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এনজিওসমূহকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির পাশে দাঁড়াতে হবে। ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য গ্রাহককে সময় দিতে হবে। মোট কথা অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং অর্থনীতিকে গতিশীল করতে যা করা দরকার তাই করতে হবে। সরকারকে প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন সংশোধন করতে হবে। কারণ, প্রয়োজন আইন মানে না। তবে কোন অবস্থায়ই শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যাবে না এবং মানুষকে বেকার করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহকেও আজ এগিয়ে আসতে হবে। যার যত উদ্বৃত্ত আছে তাই আজ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। ধনী ব্যক্তিদের আজ গরিবের পাশে দাঁড়াতে হবে। সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে অসচ্ছল ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আজ মানবতার কল্যাণে কাজ করতে হবে। আসুন, আমরা অধিকতর মানবিক হই। এখন কোনো রাজনীতির সময় নয়, এখন কোনো বিভেদের সময় নয়। এখন হচ্ছে সংকট উত্তরণের সময় এবং টিকে থাকার সময়। এখন কোনো লাভ-ক্ষতি হিসাবের সময় নয়, এখন হচ্ছে মানবতাকে বাঁচানোর সময়। যার যা আছে তাই নিয়েই আজ এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুর্দিনে টিকে থাকলেই সুদিন আসে। তাই দুর্দিনে টিকে থাকতে হয়। অস্তিত্বের লড়াইয়ে আসুন সকলে মিলে শ্লোগান ধরি,
‘সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন