শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নিম্নমানের সুরক্ষা পণ্য কিনছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

দায়সারা ওষুধ প্রশাসন মান যাচাইয়ের সুযোগ নেই, বেশিরভাগ নকল পণ্যই বিক্রি হচ্ছে মিটফোর্ড ও অনলাইনে হুমকিতে পড়বে জনস্বাস্থ্য, বাড়বে করোনার ভয়াবহতা- বিশেষজ্ঞদের অভিমত

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২০, ১২:০০ এএম

স্বাস্থ্য খাতের ওষুধসহ জীবনরক্ষাকারী সকল পণ্যের নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। মহামারি করোনার এই দুর্যোগকালীন সময়ে তাদের অবস্থা তথৈবচ। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে চালানের টাকা জমা দিয়ে পণ্য আমদানিপত্র অনুমতিপত্র নেয় আমদানিকারকরা। যাতে মানসম্পন্ন পণ্য আমদানি করা হয় তাও নিশ্চিত করার দায়িত্বও প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু কোনরকম একটি আমদানি অনুমতিপত্র দিয়েই কাজ শেষ করছে অধিদফতর। আর অনুমতি পত্র নিয়ে অনেকেই আনছেন মানহীন পণ্য। অধিদফতর নিজেদের দায় এড়াতে অনুমতি পত্রের নিচে শর্ত দিয়ে দিচ্ছে সকল দায়ভার আমদানিকারকের। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ৫টি আইএসও (আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা) সার্টিফাইড প্রতিষ্ঠানের ল্যাবে পরীক্ষা করার নির্দেশনাও দিয়ে দেয়। যা আমদানির পর পরীক্ষা করতে বলেছে অধিদফতর। যদিও দু’একটি প্রতিষ্ঠান আমদানির পূর্বেই ল্যাবে পরীক্ষা করে জীবন রক্ষাকারী এ সব পণ্য আনলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের মান যাচাই ছাড়াই লোভের বশবর্তী হয়ে নকল বা নিম্ন মানের পণ্য দেদারছে আমদানি করছে। যা রাজধানীর ফুটপাত থেকে শুরু করে ফার্মেসি ও অনলাইন বাজারে দেদারছে বিক্রি করছে। 

এদিকে স¤প্রতি আইনশৃঙ্গলা বাহিনী মানহীন নকল পণ্য বিক্রি বন্ধে দু’একটি অভিযান চালালেও অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয় থেমে নেই। পাশাপাশি অধিদফতর আমদানি অনুমতি দিয়েই শেষ; পণ্য আমদানির পর তার মান নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিদফতর শুধুমাত্র আমদানি অনুমতিপত্র এবং আমদানির পরে মান যাচাই পরীক্ষার নির্দেশনা না দিয়ে যে সব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে তার মান যাচাইয়ে পণ্যের সঙ্গে সনদ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সুর্নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে অধিদফতরকে। নির্দেশনায় অবশ্যই আমদানি পণ্যের সনদ কাস্টমসকে দেখিয়ে পণ্য ছাড় এবং পরবর্তীতে পণ্য ক্রয়কারি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেখে ক্রয়ের বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে। অন্যথায় করোনা থেকে জীবন রক্ষাকারী এসব পণ্য আমাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিবে বলে মনে করেন তারা। পাশাপাশি জনজীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে করোনা মহমারী।
সূত্র মতে, আমদানি অনুমতি পত্র নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিম্নমানের পণ্য আমদানির পর কোন ধরণের মান যাচাই বা পরীক্ষা না করেই বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। যদিও দেশে এসব সুরক্ষা সামগ্রীর মান পরীক্ষার কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই আমদানি অনুমতিপত্রের সাথে যে দেশ থেকে পণ্য আমদানি হচ্ছে সেই দেশের মান পরীক্ষার সনদ দেয়ার নিয়ম রাখার দাবি জানিয়েছেন মূল আমদানিকারকরা বা মানসম্মত পণ্য আমদানিকারকরা। এদিকে অধিদফতর আমদানির পর পরীক্ষার কথা বলায় অনেক আমদানিকারক আমদানির পর পরীক্ষা করে ত্রুটি পেলেও পণ্যটি আর ফেরত না পাঠিয়ে চুপিসারে বিক্রি করছে। কারণ পরবর্তীতে এসব নিম্নমানের পণ্যের মান যাচাইয়ের কোন সুযোগ নেই। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমদানির পূর্বেই ল্যাবে পরীক্ষা করে পণ্য আনছে বলেও দাবি করেছেন। তবে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই পণ্যের মান যাচাই ছাড়াই এ সব জীবন রক্ষাকারী নিম্নমানের পণ্য আনছে। আর আমদানির পর বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তারা অনুমতি পত্র দেখে ট্যাক্স রেখে পণ্য ছেড়ে দিচ্ছে। আমদানিপত্র থাকায় তারাও পণ্যের মান ঠিক আছে কিনা এ সনদ নিয়ে কথা বলতেও পারছেন না। এসব নিম্নমানের পণ্যের মূল বাজার হচ্ছে অনলাইন ও রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকা। এছাড়াও অনুমতিপত্র দেখিয়ে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করছে অসাধু এই চক্রটি। ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোও অধিদফতরের পণ্যের মান যাচাইয়ের সনদ দেখার নিয়ম না থাকায় এসব নিম্নমানের পণ্য কিনে কর্মকর্তা-কর্মচারী বা করোনার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা হিসেবে প্রদান করছেন। করোনা থেকে জীবন রক্ষার জন্য এসব পণ্য সরবরাহ করা হলেও ঘটছে উল্টো। এসব পণ্য ব্যবহার করে মহামারি এ ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত মনে করে স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চালিয়ে নিজে এবং অন্যকে আক্রান্ত করছে।
এদিকে নিম্নমানের পণ্য দেদারছে আমদানি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো হলেও বিপাকে পড়েছেন মানসম্পন্ন আমদানিকারক ও সাধারণ মানুষ। সঠিক আমদানিকারকরা অধিক দামে মানসম্পন্ন পণ্য কিনে পুঁজি খোয়াতে বসেছেন। কারণ বাজার অবৈধভাবে আমদানিকৃত নকল সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে ভরে গেছে। যার ফলে পণ্যের দাম নেমেছে অর্ধেকে। এতে মূল আমদানিকারকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। পুঁজি ওঠাতে পারবেন কিনা এ নিয়ে হাতাশার মধ্যে আছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চায়নার বিখ্যাত গুয়াডং জিয়াংজু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এমসিকন নামক ব্যান্ডের নকল পণ্য দিয়ে ছেয়ে গেছে অনলাইন বাজার। গ্লোবাল ফেস মাস্ক ট্রেডিং, মাস্ক বিডিসহ বিভিন্ন অনলাইন ঘুরে দেখা যায় এই পণ্যটি অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। যেখানে কোম্পানিটির ওয়েবসাইট পণ্যটির মূল্য ১ লাখ পিসের জন্য ৩ দশমিক ৩০ চাইনিজ ইয়ান, ৫০ হাজার পিসের জন্য ৪ দশমিক ৩০ ইয়ানের কথা। এর মানে কোন আমদানিকারক পণ্যটি বিমানে আমদানি করলে তার খরচ পড়বে ৫৫-৭৫ টাকা। সেখানে খোলা মার্কেটে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।
চায়নার কোম্পানিটির সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, তারা ২০ লাখ পিস মাস্ক আমেরিকায় রফতানি করেছিলো। পণ্যটির ৯৫ ভাগ মান ঠিক থাকার পরেও আমেরিকান কাস্টমস পণ্যটি ফেরত পাঠালে বাংলাদেশি মালিশা ইন্টারন্যাশনালের মালিক ইঞ্জিনিয়ার শেখ কোরবান আলী তাদের অফিসে ধর্ণা দিয়ে পণ্যটি কিনে নেন। যার ফলে তারা পণ্যটি কম দামে সেল করেছেন মালিসার কাছে। এছাড়া বাংলাদেশে ভাস্ট বাংলাদেশসহ আরও তিনজন আমদানিকারক তাদের কাছে থেকে সরাসরি পণ্য কিনেছে, বাকি সব পণ্য নকল। তাদের উৎপাদিত পণ্যে তারা বাংলাদেশে কোন সেল এজেন্ট অথরাইজড ডিস্ট্রিবিউটরশীপ দেননি।
ইতোমধ্যে মালিশা তাদের অথরাইড ডিস্ট্রিবিউটর দাবি করে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এ বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠান চীনা পত্রিকায় প্রকাশ করেছে তাদের কোন সোল এজেন্ট বাংলাদেশে নেই। কিছু অসাধু লোক তাদের কোম্পানির সুনাম ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সাবধান হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে গ্রাহকদের অনুরোধ করেছে।
এদিকে মালিশা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে কোন প্রকার অনুমতিপত্র ছাড়াই রিজেক্টেড ২০ লাখ মাস্ক কিনে কাস্টমসের চোখ এড়িয়ে কমদামে বাজারজাত করায় বিপাকে পড়েছে এমসিকন থেকেই বেশি দামে মানসম্মত পণ্য কেনা আমদানিকারকরা।
যদিও ওষুধ প্রশাসনের অনুমতিপত্র ছাড়া কিভাবে এসব নকল মাস্ক বাংলাদেশে আসলো এ নিয়ে ওষুধ প্রশাসনের কোন মাথাব্যথা নেই। শুধু তাই নয় এ সকল অনুমোদনহীন জীবন রক্ষাকারী পণ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কিনছে দেদারসে।
স¤প্রতি অগ্রণী ব্যাংক প্রায় ৩ হাজার ইনফ্রারেড থার্মোমিটার কিনেছে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রতিটি পণ্যের মূল্য দিয়েছে প্রায় ৩ হাজার ১শ’ টাকা। সরবরাহকরী প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদনহীন এ সকল পণ্য সরবরাহ করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এমনকি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি কোন আমদানিকারকের কাছ থেকে পণ্য কিনেছে তাও জানে না ব্যাংকটি। পণ্যটি ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে নাকি অবৈধ চ্যানেলে এসেছে তাও খতিয়ে দেখতে পারেনি ব্যাংকটি।
অথচ বিল দিচ্ছেন সরকারি টাকায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ের ক্রয় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম মোল্ল্যা বলেন, এ সকল পণ্য ক্রয় করার সময় অনুমোদনহীন বা অনুমোদিত পণ্য কিনতে হবে এমন কোন প্রজ্ঞাপন ওষুধ প্রশাসন দেয়নি। তাই আমরাও যাচাই-বাছাই করিনি, পরবর্তীতে ক্রয়ের সময় এ বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা বলেন তিনি। যদিও শুধু অগ্রণী ব্যাংকই নয়; সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই এ সকল অনুমোদনহীন নকল পণ্য ক্রয়ের হিড়িক পড়েছে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের আসলে কিছু করার নেই। আমদানিপত্র দেখালেই পণ্য ছেড়ে দিতে হয়। পণ্য যাচাইয়ের পৃথক কোন সনদ দেখানোর বিষয়ে নির্দেশনা থাকলে হয়তো ব্যবস্থা নেয়া যেতো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক ইহেতেশামুল হক দুলাল বলেন, ওষুধ প্রশাসন যেহেতু দেশের একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান তাই তাদের উচিত বাজারে মানসম্মত পণ্যের যোগান নিশ্চিতে প্রজ্ঞাপন বা চিঠি দিয়ে কাস্টমসকে জানিয়ে দেয়া। তাদের অনুমতি পত্র ছাড়া কোন পণ্য ছাড় না করা। পাশাপাশি একই প্রজ্ঞাপনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদনহীন পণ্য কিনতে নিরুৎসাহিত করা। এছাড়া ওষুধ প্রশাসনের উচিত যারাই আমদানির অনুমতি পত্রের জন্য আবেদন করবে তাদের পারফরমার ইনভয়েস (পিআই’র) উপর ভিত্তি করে নয়, এলসি বা টিটি ডকুমেন্ট জমা নিয়ে আমদানিকারক যে দেশ থেকে এসব জীবন রক্ষাকারী পণ্য আমদানি করবেন সেই দেশেরই আইএসও সার্টিফাইড ল্যাবসমূহের রিপোর্ট নিয়ে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত হয়ে আমদানির অনুমতি পত্র দেয়া।
এছাড়াও তিনি করোনার কবল থেকে দেশকে দ্রুত মুক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি যেসব নকল ও মানহীন পণ্য দেশের বাজারে আছে তা দ্রুত জব্দ করে ভুয়া আমদানিকারকদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেন। সার্বিক বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন