শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বানভাসিদের দুর্ভোগ চরমে

বন্যার্তরা পাচ্ছে না খাবার ও বিশুদ্ধ পানি ঘর বাড়ি ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে উঁচু বাঁধে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম

বৃষ্টি আর ভারতের পানির ঢলে কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। রংপুর কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা, জামালপুর, বগুড়া এবং সুনামগঞ্জে কয়েক লাখ পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট। বাড়িঘরে পানি ওঠায় গবাদিপশু নিয়ে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ অথবা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। একদিকে বানের পানিতে তলিয়ে গেছে জমির ফসল অন্যদিকে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ভিটে মাটি সব।
ভারতের আসাম প্রদেশ থেকে বন্যার পানি এসে ঢুকছে বাংলাদেশের নদ-নদীতে। এই কারণে জামালপুর, সুনামগঞ্জ ও সিলেটসহ দেশের অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি হতে পারে। এতে চলতি সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত পানি বেড়ে বন্যা আরও কয়েক জেলায় বিস্তৃত হবে। সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, সিলেট ও সুনামগঞ্জের পাশাপাশি টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া এবং নেত্রকোণাসহ আরও কয়েকটি জেলা বন্যা কবলিত হতে পারে।

বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, লাগাতার বর্ষণ ও ভারতীয় ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়কান্দি ও ধুনট উপজেলার নতুন নতুন চর এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গতকাল চরের বহু মানুষ আগাম সতর্কতা হিসেবে বাড়িঘর ছেড়ে যমুনার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সারিযাকান্দিতে ৭৯ টি ছোট চড় চরের মধ্যে ৭ টি ইউনিয়নের ২৫ টি চরের ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। চরাঞ্চলের মানুষ গৃহপালিত পশুসহ নৌকায় করে বাড়ির আসবাবপত্র নিয়ে ছুটছে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের দিকে। ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নে ১২ টি গ্রামের বহু ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। এই ইউনিয়নের আউস ধান, পাট, আখসহ বিভিন্ন ফসলে ক্ষতি হয়েছে। সারিয়াকান্দি চরগুলোর ৫০২০ হেক্টর পাট, ২৩৭৭ হেক্টর আউশ, ৫৬ হেক্টর আউশ বীজতলা, ১৫ হেক্টর জমির ভ‚ট্টা , ২ হেক্টর জমির মরিচ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, যমুনা নদীর পনি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারনে প্রতিদিনই নতুন নতুন ও চরাঞ্চলের ফসলী জমি, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট প্লাবিত হচ্ছে। ঘর-বাড়ি ছেড়ে পানিবন্দি মানুষ শহর রক্ষা বাঁধের উপর অশ্রয় নিচ্ছেন। এছাড়া অভ্যান্তরীন নদ-নদীর পানিও বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদীতীরবর্তী ৫টি উপজেলার ৩০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুল ইসলাম বলেন, পানিতে প্রায় ১ হাজার হেক্টর পাট ও সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর তিল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, এ জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবার্তত রয়েছে। গতকাল ধরলার পানি ব্রীজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৭১ সেন্টিমিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি হু হু করে বাড়তে থাকায় এ দুটি নদীর অববাহিকার ৫০টি চরগ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় জলার ৫৫টি ইউনিয়নের সাড়ে তিনশ চর ও নদী সংলগ্ন ৩৫৭ গ্রামের দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদী ভাঙ্গনে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ঘরবাড়ি হারিয়েছে ৫শ পরিবার। ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ ৩৭ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। প্রবল স্রোতে টিকতে না পেরে অনেকেই রাস্তা, বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। তবে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটের পাশাপাশি বৃষ্টির কারণে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে। তিস্তার ভাঙনে উলিপুরের নাগরাকুড়া টি বাঁধের বøক পিচিংসহ ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে সারডোব, নুনখাওয়া মোগলবাসা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ ১৫টি স্পটে। পানির চাপে বাঁধ ভেঙে রৌমারী উপজেলা শহর প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার তিনটি পয়েন্টের মধ্যে গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া গেজ পয়েন্ট গত চব্বিশ ঘণ্টায় ২১ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে এই পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানিবৃদ্ধির সাথে সাথেই গোয়ালন্দের দুটি ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার পরিবার।

গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে জামালপুর জেলায়। এখানে ছয়টি উপজেলায় প্রায় ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৮০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী তীরবর্তী ২৫টি ইউনিয়ন তলিয়ে গেছে। রাস্তাগুলো পানির তলায় চলে যাওয়ায় এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ফসলের মাঠ ডুবে যাওয়ার পর গোলায় জমা রাখা শষ্যও নষ্ট হয়েছে অনেকের। জামালপুর জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় একশরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

জামালপুরের জেলা প্রশাসক এনামুল হক বলেন, ‘জেলায় বন্যা কবলিতদের জরুরি সেবা দানের জন্য ৮টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। সাড়ে ৪ শ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যা হয়তো কমানো যাবে না, তবে ক্ষতিগ্রস্থদের দুঃখ-দুর্দশা কমানোর চেষ্টা চলছে।

সুনামগঞ্জ জেলায় পানি না কমলেও পানিবন্দি সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। এই প্রায় সব সড়কই ৫ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। ফলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়াবাজার ও জামালগঞ্জ উপজেলার মানুষজন। জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স‚ত্রে জানা যায়, এই জেলার দুর্গতদের জন্য ১২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১২’শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৪১০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ২৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সিলেটেও বন্যা পানি বাড়তে শুরু করেছে। এর উপ-শহরসহ আশেপাশের ১০টি এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলাগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ভারতের মেঘালয়ের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে পানি বাড়ছে।
গেল কয়েকদিনে তিস্তা বেষ্টিত রংপুর জেলার নদীপাড়ের মানুষের আহাজারি বেড়েছে। তিস্তা নদীর স্বভাব সুলভ আচরণে ঘরবাড়ি হারিয়েছে অনেক পরিবার। চরাঞ্চলে পানিতে তলিয়েছে সবজি ক্ষেতসহ ফসলি জমি। তিস্তা ব্যারেজের সবকটি গেট খুলে দেওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে পানিবন্দি হয়ে আছে দুই হাজারেরও বেশি পরিবার। গেল ২৪ ঘণ্টায় রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি কিছুটা কমলেও বেড়েছে ভাঙন ঝুঁকি। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি। নদীগর্ভের খুব কাছাকাছি থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মক্তব নিয়ে চিন্তিত স্থানীয়রা। কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা চরে নদী ভাঙনে বিলীনের পথে চরের একমাত্র পাকা সড়কটি। এরইমধ্যে সড়কটির প্রায় ৬০০ ফুট ভেঙে গেছে। এই চরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একটি মসজিদ রয়েছে ভাঙনের মুখে। ওইসব এলাকায় খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির সংকটদেখা দিয়েছে। গঙ্গাচড়া ছাড়াও কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর, শহীদ বাগ ও নাজিরদহ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কিছু কিছু জায়গাতে পানি কমে আসলেও দুর্ভোগ কমেনি। ওই চারটি ইউনিয়নে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছেন। অসহায় এসব পরিবারের মানুষের মধ্যে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদি পশুর জন্য গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়নি। ফলে চরম বিপাকে পড়েছে বন্যা দুর্গত মানুষজন।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে পাঁচটি গ্রামে তিস্তার বন্যার পানিতে ভেসে গেছে প্রায় অর্ধশতাধিক মৎস্যচাষির স্বপ্ন। গত কয়েক দিন থেকে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের বিস্তর্ঢু নিচু এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে বাড়িঘর। ভেসে যায় মৎস্য খামারের পাশাপাশি অসংখ্য পুকুর।

রংপুর বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। গতকাল বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে রংপুর বিভাগীয় প্রশাসনের ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় বন্যা কবলিত মানুষদের দুর্দশা লাঘবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন