শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

মহানগর

শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : জাতির আশা-আকাঙ্খা পূরণে চাই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ

মোহাম্মদ আবদুল অদুদ | প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০২০, ১০:১৫ এএম

আজ বুধবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষে পদার্পণ করলো। এদিনটি জমকালোভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কাটানোর কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষীয় ঔদার্যয়ের সীমাবদ্ধতা ও করোনাময় পরিবেশ পন্ড করে দিলো সবকিছু। তারপরও গণতন্ত্র, মুক্তবুদ্ধি চর্চার সূতিকাগার হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটি এখন আমাদের প্রেরণা উৎস ও চেতনার বাতিঘর বলে মনে করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সচেতন দেশবাসী।

বাঙালি জনগণের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ইংরেজ শাসনামলের প্রথম থেকেই জোরদার হতে শুরু করে। ইতিপূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান পূর্ববঙ্গে ছিল না। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল নেতারা তাই দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বঙ্গভঙ্গ রদের পর এই দাবি আরও সক্রিয়ভাবে জোরদার হতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯২১ সালে শুরু হলেও এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানার জন্য আমাদের আরেকটু পেছনে যেতে হবে।

বাঙালি নাগরিক সমাজের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের দীর্ঘ বোঝাপড়ার ফসল এই বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ রদের অল্প কিছুদিন পরেই ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। সময়টি ছিল ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দতীপনার সৃষ্টি করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন, প্রগতিশীল চিন্তা চেতনায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজ।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১২ সালের ২৭ মে গঠিত হয় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট নাথান কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয় নাথান কমিশনের ওপর। ভালো খবর হলো, ১৯১৩ সালে নাথান কমিশনের ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হয়। কিন্তু এর পরবর্তী বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের পথে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই যুদ্ধ। তবে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও নাগরিক সমাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন ইতিবাচক রিপোর্ট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ধাপ তৈরি হয়ে যায়। অবশেষে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০’ পাস হয়। ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এই বিলে সম্মতি প্রদান করেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সব সন্দেহের অবকাশ ঘটে। এই আইনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইনটির বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে আমাদের এ অঞ্চলের খেটে-খাওয়া মানুষের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তারা হলেন, স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ। যদিও প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি তারা এখনও সেভাবে পাননি। এমনকি শিক্ষক-শিক্ষার্র্থীদের অনেকে জানেন না তাদের গর্বের এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা কারা?কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার কথা আজ না হয় না-ই বললাম।

শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটতে থাকে। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ ভূমিকা রাখে ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামকে সংগঠিত করতে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কার্জন হল প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়। ভাষা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপদান করতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে। ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই গৃহীত হয়। ভাষাশহীদ আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। ভাষা আন্দোলন শুধু নয়, বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই। ’৬২–এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১–এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি যুক্ত। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। মার্চ মাসজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন–সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেই প্রথম আক্রমণ চালানো হয়। সংগ্রামী মনোভাবের কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে বলা হয়ে থাকে, সাধারণত দেশ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বাঙালি ও বাঙালিরই ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই সবার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। দেশের ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি—প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনস্বীকার্য অবদান রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো প্রতিবছর দেশের সর্বাধিক গ্র্যাজুয়েট এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তৈরি হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন ছাত্র। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। বছরের পর বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নেতৃত্বের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদবি থেকে শুরু করে শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতিসহ দেশের প্রতিটি সেক্টরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অবাধ বিচরণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

এত সব গর্বের পাশাপাশি বেশ কিছু সমস্যারও মুখোমুখি হতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। প্রতিবছর সাত হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, এর ফলে শিক্ষার্থীদের আবাসনসংকট নিয়ে কর্তৃপক্ষকে প্রতিবছরই সমস্যায় পড়তে হয়। তবে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথে যথেষ্ট অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। নতুন হলসহ আবাসিক হলগুলোর ভবন সম্প্রসারণে একটি মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে। গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সেশনজটের মুখোমুখি হতে হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে হলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাইকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে, গবেষণাকাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে এবং এ খাতে বাজেট বৃদ্ধিরও প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে র‌্যাংকিংয়ে আরও অগ্রসর হতে হবে, সেজন্য কতৃপক্ষীয় ভূমিকা রাখতে হবে আরও জোরদার। আজ কোনো অভিযোগ নয়। স্বপ্নের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেশের আপামর জনসাধারণের আশা-আকাঙ্কার প্রতীক হতে সচেষ্ট থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে।

দেশের এত সব অর্জনের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ৯৯ পেরিয়ে ১০০ বছরে পদার্পণ করছে। দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ দিন দিন দেশকে আরও সমৃদ্ধ করবে, জাতির আশা-আকাঙ্খা পূরণে গৌরবময় ভূমিকা রাখবে, এজন্য চাই কতৃপক্ষীয় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সমগ্র দেশবাসীর যেন এটাই প্রত্যাশা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
হিরন ১ জুলাই, ২০২০, ১০:৪৭ এএম says : 0
It's really worth mentioning that DU is a place for democracy and to stand agaist any sort of crisis of the nation...but vis- a- vis the expectations of the people of all walks of life is that most prominently, in terms of research and creating knowledge, it (DU) should have at least to certain leve. So in this auspicious moment of founding anniversar, without furthermore delay to achiev, for which it has established.
Total Reply(0)
হিরন ১ জুলাই, ২০২০, ১০:৫২ এএম says : 0
I wish it’s every success of the century old educational Institute (DU) to fulfill the long cherished demand of the people to be a centre of excellence in terms of research and wisdom having sagacious Academia.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন