শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নতুন স্থাপনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

রজনী গন্ধা ফুলের সুবাসে সৃষ্টি হলো ইতিহাস

প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান-উজ-জামান : রজনী গন্ধা ফুলের সুবাসে সৃষ্টি হলো ইতিহাস। ব্রিটিশদের তৈরী লাল দালান হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগার এখন কেরানিগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে। গতকাল শুক্রবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাড়ে ৬ হাজার বন্দীকে কেরানিগঞ্জের নতুন এ আধুনিক কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। নতুন কারাগারে প্রবেশকালে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে বন্দীদের বরন করেন কারা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে দিয়ে পুরান ঢাকার সোয়া ২শ’ বছরের পুরনো কারাগারের ঠিকানা বদল হলো। বন্দী স্থানান্তরে নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট এলাকা ও মহাসড়কে পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব এপিবিএনের পাশাপাশি ২৪ প্লাটুন বিজিবি সদস্যও মোতায়েন করা হয়। নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগার এলাকার প্রবেশের চারপাশের রাস্তা বন্ধ এবং হানিফ ফ্লাইওভারে সাধারণ পরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা করে দেয়ায় জনসাধারণ দুর্ভোগের শিকার হন।
গতকাল ভোর থেকেই শুরু হয় বন্দী স্থানান্তর। এজন্য নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগারের চারদিকের রাস্তা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সাধারণ পথচারীদেরও এপথ ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। হানিফ উড়াল সড়কের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বন্দীদের। নিরাপত্তার স্বার্থে নাজিম উদ্দিন রোড থেকে পোস্তগোলা হয়ে রাজেন্দ্রপুরের নতুন কারাগারের রাস্তায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতি দফায় ৮টি প্রিজন ভ্যানের বহরের নিরাপত্তায় ছিলো পুলিশ ও র‌্যাবের আরও আটটি গাড়ি। সঙ্গে ছিলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স। নাজিম উদ্দিন রোড থেকে কেরানিগঞ্জের কারাগার পর্যন্ত ২শ’ গজ পর পর নিয়োজিত ছিলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
কারা কর্মকর্তারা জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আড়াই হাজারের বেশি সদস্য বন্দী স্থানান্তর কার্যক্রমের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। পুরনো কারাগারের আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এজন্য জনসাধারণকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সূত্র জানায়, ২৪ প্লাটুন বিজিবি সদস্যও বন্দী স্থানান্তরের কাজে সহযোগিতা করে। একজন কারা কর্মকর্তা জানান, মোট ২৫টি প্রিজন ভ্যান ব্যবহার করে বন্দী স্থানান্তরের কাজ চলে। প্রতি বহরে মোটামুটি সাড়ে ৩শ’ বন্দী নেয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান বলেন, ডিএমপির নেতৃত্বে এই বন্দী স্থানান্তরের কাজ চলে। ভোর ৬টা থেকে বন্দীদের স্থানান্তর শুরু হলেও আমরা ভোর সাড়ে ৪টায় নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে নিরাপত্তা-ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। মারুফ হাসান বলেন, এত সংখ্যক বন্দীকে একযোগে স্থানান্তর করার ঘটনাটি ঐতিহাসিক। এটা ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা, তাই আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। পুরো রাস্তা নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনোভাবে যাতে নিরাপত্তা বিঘিœত না হয়, এ জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি জানান, পুরো রাস্তায় ডিএমপিকে নিরাপত্তার দায়িত্বে সহায়তা করছে ঢাকা জেলা পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন ও বিজিবি।
কারাগার সূত্র জানায়, নাজিম উদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা নারী, শিশু, মানবতাবিরোধী অভিযোগে আটক ও দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের আগেই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে সরিয়ে নেয়া হয়।
প্রথম দফায় বন্দী স্থানান্তরের পর বেলা ১১টায় কারা অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলন সাংবাদিকদের কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বলেন, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ হাজার ৪শ’ বন্দী ছিলেন। গতকাল সকাল সূর্যোদয়ের পর ভোর ৬টা থেকে এই কারাগার থেকে বন্দীদের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরের কারাগারে স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়। তিনি আরো বলেন, কেরানীগঞ্জের কারাগারে বন্দীরা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন। সেখানকার পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের। কেরানীগঞ্জে কারাগারের বাইরে কোনো অবৈধ স্থাপনা, দোকানপাট ও সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে দেয়া হবে না। কেরানিগঞ্জের এ নতুন কারাগারে শুধুমাত্র পুরুষ বন্দীদের স্থানান্তর করা হয়েছে।
কারা সূত্র জানায়, বেলা ১১টা নাগাদ দুই হাজার, বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৪ হাজার ২শ’ ৩০ এবং সর্বশেষ রাত ৮টার মধ্যে সকল বন্দীকে নতুন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর কবির জানান, কারাগারের দাপ্তরিক আসবাব আগেই কেরানীগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন থেকে তিনি ও কারাধ্যক্ষ নতুন কারাগারে দায়িত্ব পালন করবেন।
সূত্র জানায়, নাজিমউদ্দিন রোডে ১৭ একর জমিতে ১৭৮৮ সালে গড়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। ভবনটিতে বন্দী ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৮২৬ জন। অথচ স্থানান্তরের আগে সেখানে ৬ হাজারেরও বেশি বন্দী ছিলেন। অপরদিকে কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগার ভবন দাঁড়িয়ে আছে ১৯৪ একরের বেশি জমির ওপর। এশিয়ার সর্বাধুনিক ও বৃহত্তম এ কারাগারে ধারণ ক্ষমতা ৫ হাজার হলেও ৮ হাজারের মতো বন্দী থাকতে পারবেন এখানে। গত এপ্রিলে নতুন এ কারাগার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাংলাদেশের পুরনো কারাগারগুলোর মতো কেরানীগঞ্জ কারাগারের দেয়াল লাল নয়। তুলনামূলকভাবে খোলামেলা এ কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অন্যগুলোর তুলনায় আধুনিক। ৬টি ছয়তলা ভবনে হাজতি এবং একই ধরনের দুটি ভবনে কয়েদিদের রাখা হবে এ কারাগারে। এসব ভবনের প্রতি তলায় ৪০টি করে কক্ষ; প্রতি কক্ষে ১৩ জন করে বন্দী রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এ কারাগার ঘিরে আছে ১৮ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর। তার ওপর দুই ফুট বৈদ্যুতিক তারের সেন্সর। প্রতিটি ভবনের রয়েছে আলাদা ছোট প্রাচীর।
কারা-মহাপরিদর্শক জানান, কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগারে মোট ৫৫৩ জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করবেন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দীদের জন্য এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আরও ২০০ কারারক্ষী থাকবেন।
এদিকে নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় কী হবে, তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে চলছে নানা গুঞ্জন। এ ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় হবে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতি জাদুঘর। ঐতিহাসিক মূল্য আছে, এমন ভবন সংরক্ষণ করা হবে, যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কারাগারের ভেতরে ১৭ একর জমি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী কারাগারের স্থানে মানুষের বিনোদনের জন্য পার্ক হবে। প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে কারাগারের কিছু ভবন সংরক্ষণ করা হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থানে পার্ক ও খেলার মাঠ গড়ে তুলবেন। উন্মুক্ত স্থান হিসেবে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা যাতে প্রাতঃভ্রমণ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করবেন। শিশু-কিশোরদের জন্য খেলার সুযোগ করে দেবেন। গতকাল মেয়র সাঈদ খোকন শুক্রবার বলেন, কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। জায়গাটি সিটি করপোরেশন পেলে অবশ্যই এলাকাবাসীর চাহিদা পূরণ করা হবে। তিনিও চান কারাগারের স্থানটিকে উন্মুক্ত স্থান হিসেবে রাখা হোক।
এদিকে আমাদের কেরানীগঞ্জ উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ভোর ৬টা থেকে প্রিজন ভ্যানে কয়েদী আসা শুরু করে। একটি বহরে ৮টি প্রিজন ভ্যানের সঙ্গে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারসার্ভিসের গাড়িসহ অন্যান্য সংস্থার ২১টি গাড়ি ছিল। আধা ঘন্টা পর পর পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড থেকে বন্দীদের নতুন কারাগারে নিয়ে আসে। ভোর ৬ টায় ২ হাজার ভিআইপি বন্দীদের নতুন কারাগারে স্থান্তর করা হয়। নতুন কারাগারের আশপাশে নিরাপত্তা চাদরে ডেকে দেয়া হয়। গাড়ি বহরের ছোট ছোট ৬টি প্রিজন ভ্যান সরাসরি প্রবেশ করলেও বড় দুটি প্রিজন ভ্যান প্রবেশ করতে পারেনি। দুটি বড় প্রিয়জন মূল ফটকের নামনে রেখে বন্দীদের পায়ে হেঁটে নামিয়ে কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হয়। গাড়ির বহর যখন প্রথম ফটকের সামনে আসে তখন বন্দীরা আনন্দ-উল্লাস করে। দায়িত্বরত ডিবি ইন্সপেক্টর অহিদুজ্জামান মোল্লা বলেন, কারার প্রধান ফটকটি নিচু হওয়ার কারণে বড় প্রিজন ভ্যান ঢুকতে পারেনি। তবে আমরা প্রধান ফটকের সামনে প্রিজন রেখে বন্দীদের ভেতরে প্রবেশ করাই। এতে সময়ের কিছুটা অপচয় হয়েছে। কারাফটকে প্রবেশের সময় উপস্থিত ছিলেন, এআইজি প্রিজন মো. সাজ্জাদ হোসেন, ডিএমপি অতিরিক্তি পুলিশ কমিশনার মারুফ হাসান, ডিপুটি জেলার আরিফ হোসেন, ডিআই প্রিজন একেএম ফজলুর করিম, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইমলাম, ঢাকা জেলা অতিরিক্তি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আযাদ খান প্রমুখ। বিকেল ৪টায় আইজি প্রিজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইত্তেকার উদ্দিন কারা পরিদর্শনে আসেন।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাজিরা দেবে জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ আসামিরা। গতকাল দুপুরে কারা অধিদফতরে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল (শুক্রবার) সকালে আমার কথা হয়েছে। আসামিদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। তবে কবে থেকে এ কাজ শুরু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলেন নি তিনি। সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বলেন, বন্দিদের কারাগারে রেখেই হাজিরা নিশ্চিতের জন্য এই প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনও অনেক পথ বাকি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন