শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বন্যায় ভাসছে ১৮ জেলা

প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৩ পিএম, ২৯ জুলাই, ২০১৬

ইনকিলাব রিপোর্ট : দেশের আঠারটি জেলা ভাসছে বানের পানিতে। পানিবন্দি হয়ে ৫০ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। টানাবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা, তলিয়ে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত। রংপুর, নীলফামারি, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারিপুর, মুন্সিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা এবং ঢাকার আশপাশের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় খাদ্য, পানি ও জ্বালানি সঙ্কটে পড়েছে পানিবন্দী মানুষ। বিভিন্ন জেলায় পানিতে ডুবে নারী ও শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও সবজি বাগান। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে কাঁচা তরি-তরকারির বাজারে। পানি বৃদ্ধির কারণে অনেক এলাকার পুকুর, ডোবা, ঘের তলিয়ে গেছে। এতে করে এসব জায়গায় চাষ করা মাছ ভেসে গেছে পানির তোড়ে।
এছাড়াও বানের পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় অনেক এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে পানি উঠায় জামালপুরের সাথে ঢাকার ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পদ্মায় তীব্র স্রোত থাকায় আরিচা-দৌলদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, ব্রিজ, কালভার্ট, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেক এলাকায় শ্রমিকদের কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে অতি দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। দুর্গত কয়েকটি এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য। বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় বিশেষ করে প্লাবিত চরাঞ্চলগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেড়েছে চোরের উপদ্রব। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্র বিভিন্ন এলাকা থেকে গবাদিপশু, ছাগলসহ বাড়ী ঘরের মালামাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামের রৌমারিকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় যে হারে পানি বাড়ছে তাতে করে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় আরও কয়েকটি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০টি পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৫৪টি স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ৩২টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে। দু’টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ২টি স্থানের তথ্য পাওয়া যায়নি। আর ১৯টি স্থানে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার, গাইবান্ধায় ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১২১
সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার, কাজিপুরে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার, আরিচাতে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার, সিংড়ায় গুর নদীর পানি বিদপসীমার ১৩ সেন্টিমিটার, বাঘাবাড়িতে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার, এলাসিনে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার, তরাঘাটে কালিগঙ্গা নদীর পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার, গোয়ালন্দে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার, ভাগ্যকূলে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার, সুরেশ্বরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, জারিয়াজঞ্জাইলে কংস নদীর পানি বিপদসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রামে দুর্ভোগ বাড়ছে পানিবন্দি ৬ লক্ষাধিক মানুষ
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা : কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েণ্টে বিপদসীমার ৯৭ সে.মি ও ধরলার নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদ সীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে ও রাস্তা ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা চললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খাদ্য, খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি গবাদিপশুর আশ্রয় ও গো-খাদ্যের সংকটও তীব্র হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে বাঁধে ও খোলা আকাশের নিচে আশ্রিতদের দুর্ভোগ বাড়ছে। রৌমারী উপজেলা শহরের অধিকাংশ এলাকা ৩ দিন ধরে হাঁটু পানিতে ডুবে আছে। গত এক সপ্তাহে পানিতে ডুবে ও বন্যার পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রে ২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। তবে উজানে দুধকুমারে পানি স্থিতিশীল রয়েছে। এ সময়ে ধরলায় কমেছে ১২ সেন্টিমিটার।
কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আকতার হোসেন আজাদ জানান, ৯টি উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৭১৯টি গ্রাম এখন পানির নিচে। ১ লাখ ৫০ হাজার পরিবারের প্রায় ৬ লাখ ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত রয়েছে।
ঘাঘট তিস্তা ব্রহ্মপুত্রে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত
গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতা : ঘাঘট, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গাইবান্ধা জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি হয়েছে। শুক্রবার ঘাঘট নদীর পানি ৯০ সে: মি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ৯০ সে. মি. বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনও বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে এক সপ্তাহে এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া জেলার ৪টি উপজেলায় এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
এদিকে গাইবান্ধার সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্যাপুর, পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া, তিস্তা, ঘাঘট, নদীর তীর ঘেঁষে ৩২ টি ইউনিয়নে বন্যার কারণে ফসলী জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৬০ কি.মি বাঁধের ২০ টি পয়েন্টে ফাটল দেখা দেয়ায় এলাকার জনগণ আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র এডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলন জানান, গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের পৌর এলাকার কুটিপাড়া, ডেভিড কোম্পানীপাড়া ও গোদারহাটের ৮টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাঁধ দিয়ে পানি চুয়াচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে শহরবাসী আতংকের মধ্যে রয়েছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি হাট, তহসিল অফিস, ফুলছড়ি এবং সাঘাটার ভরতখালির হাট তিনটি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। হাটের উপর দিয়ে এখন নৌকা চলছে। বৃহত্তর ওই হাট তিনটি পানিতে ডুবে যাওয়ায় ওইসব এলাকার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেছে।
অপরদিকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি-সাঘাটা সড়কের ২০টি পয়েন্টে সড়কের উপর দিয়ে তীব্র বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ওই সড়ক দিয়ে ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার সাথে গাইবান্ধা জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে জনগণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
জামালপুরে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
জামালপুর জেলা সংবাদদাতা : জামালপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীতে আরও আট সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শুক্রবার সকালে বন্যার পানি বিপদ সীমার ১২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইতিমধ্যেই জেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এবং বন্যার পানিতে ডুবে ছয় শিশুসহ সাত জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, জেলার ৭টি উপজেলার ৪৮টি ইউনিয়ন এবং দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দহ উপজেলা সমূহের আভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে রেললাইনের ওপরে পানি উঠার কারণে জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার পথে ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। গতকাল ঢাকা থেকে রেলওয়ের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বৃহস্পতিবারে জামালপুরের ইসলামপুরে আইড়মারী গ্রামে বন্যা পানিতে পড়ে রাকিব ও ইয়াছিন নামে দুই শিশু মারা গেছে। একই দিন দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নে মোল্লাপাড়া একটি ব্রিজ থেকে আসিফ নামে ৫ম শ্রেণির এক স্কুল ছাত্র বন্যার পানিতে পড়ে নিখোঁজ রয়েছে। এছাড়াও আগের দিন বুধবার সরিষাবাড়ী উপজেলার সাতপোয়া ইউনিয়নের লাল মিয়ার শিশু কন্যা লায়লা আক্তার ও ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী ইউনিয়নের মুখশিমলা গ্রামে ছবেদ আলীর শিশু পুত্র সোলায়মান ও সাপধরী ইউনিয়নের সাইদুর রহমানের শিশু কন্যা ছাবিনা বন্যার পানিতে পড়ে মারা গেছে। একইদিন ইসলামপুরের পচাবহলা ফকিরপাড়া গ্রামের মৃত জহুরুল ফকিরের ছেলে সুরুজ্জামান (৫৫) বাড়ির পার্শ্বে মাছ ধরতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে।
ইসলামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নবী নেওয়াজ খান লোহানী বিপুল জানান, ইসলামপুরের যমুনাতীরবর্তী এলাকা বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসব এলাকার পানিবন্দিদের ঘরে ঘরে ত্রাণের জন্য হাহাকার এবং বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট চলছে। এছাড়াও গোখাদ্যেরও তীব্র সংকট চলছে। তিনি আরও বলেন, যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষগুলো বাড়িঘরসহ বন্যার তীব্র স্রোতে ভেসে যাবার উপক্রম হয়েছে।
লালমনিরহাটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা : তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি গত দু’দিনে লালমনিরহাট পয়েন্টে বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বাড়ী-ঘর ছেড়ে বাঁধের রাস্তা, স্কুলঘর, আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত বানভাসি মানুষ ধীরে ধীরে তাদের গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ী ফিরতে শুরু করেছে। একটানা ১৩ দিন ধরে তলিয়ে যাওয়া রোপা আমন ক্ষেত সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হওয়ায় চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত এলাকার কৃষক এখন দিশেহারা। বীজ তলায় চারা না থাকায় চলতি আমন মৌসুমে অধিকাংশ জমি খালি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বন্যা কবলিত এলাকার বানভাসি মানুষগুলোর পরিবারে পানিবাহিত ডাইরিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ত্রাণ সামগ্রীর পাশাপাশি ওষুধ সরবরাহ জরুরী হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য যে, এবারের বন্যায় জেলার ৫টি উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের ৪৯ হাজার ৮৬০টি পরিবারের ২ লক্ষ মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েন।
আরিচায় পানি বিপদসীমার ৫৬ সে.মি. উপরে
আরিচা সংবাদদাতা : মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচাঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ফসলি জমিসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে ও ডুবে গিয়ে এসব এলাকার হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আরিচা পিসিপোল নির্মাণ প্লান্ট (বিদ্যুতের খুঁটি তৈরির কারাখানা) পানি ঢুকে পড়ায় কর্তৃপক্ষ শুক্রবার থেকে কারখানাটি বন্ধ করে দিয়েছেন। শিবালয় উপজেলার এলাচীপুর এলাকায় আরিচা-দাশকান্দি পদ্মা-যমুনা বেড়ি বাঁধ কাম রাস্তা হুমকির মুখে। যে কোন সময় বাঁধটি ভেঙ্গে প্লাবিত হয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
বিআইডব্লিউটিএ’র আরিচা অঞ্চলের গেজ রিডার আলমগীর হোসেন জানান, যমুনা নদীর এ পয়েন্টে গত কয়েকদিন ধরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে শুক্রবার সকাল নয়টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১০.০১ মিটারে পৌঁছেছে। যা বর্তমানে বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জানা গেছে গত কয়েকদিন ধরে যমুনায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এর শাখা নদী ইছামতি, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আলিমুজ্জামান মিয়া জানান, জেলার এক হাজার হেক্টর আমন ধান, তিন হেক্টর রোপা আমনের বীজতলা ও পাঁচ হেক্টর শাক-সবজি’র জমি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
দিরাইয়ে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত : আতঙ্কে হাওরের জনগণ
দিরাই উপজেলা সংবাদদাতা ঃ দেশব্যাপী বন্যার আঁচড় লেগেছে দিরাইয়েও। বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সাধারণ মানুষের জনজীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। হাওরে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ডুবে যাওয়া বাড়িঘরে ঢেউয়ের তা-বে ভেঙে যাচ্ছে অনেক ঘরবাড়ি। ফলে আতঙ্ক নিয়ে দিন যাপন করছেন হাওরপাড়ের লোকজন। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য। তবে উপজেলা প্রশাসন বন্যা কিংবা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জানেন না বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, বেশ কয়েক দিনের টানা বর্ষণ আর উজান থেকে আসা পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে এর প্রভাবে দিরাই উপজেলার নদ-নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি শুরু হয়।
দিরাই উপজেলার দিরাই সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী জানান, বন্যায় ইউনিয়নের চ-িপুর ও চ-পুর গ্রামের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাছাড়া নাছনী, সরমঙ্গল, জারলিয়া, রাঙ্গামাটি, ছিতলিয়া গ্রামের প্রায় ২শত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুলঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ জানান, মাছ চাষিদের কিছু ক্ষতি ও কিছু সড়ক ডুবেছে, তবে ফিরাশির লোকজন জাল দিয়ে তাদের পুকুরগুলোকে রক্ষায় কাজ করছে।
সিরাজগঞ্জে পানি ঢুকছে লোকালয়ে
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি গতকালও ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। শুক্রবার সকালে শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
বন্যার পানি প্রতিনিয়িত বৃদ্ধির ফলে সিরাজগঞ্জের রানিগ্রাম বাঁধ চুয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বাঁধটি নিয়ে ভাঙন আতংকে ভুগছে স্থানীয়রা। এই বাঁধটির ভাঙন রোধে জরুরি মেরামত কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এদিকে জেলার ৬টি সিরাজগঞ্জ সদর, শাহজাদপুর, কাজিপুর, বেলকুচি, ও চৌহালী উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বসতবাড়িতে পানি উঠে পড়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু স্থানে মানবেতর জীবনযাপন করছে বানভাসি এই মানুষেরা। বন্যা দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, গোখাদ্য, ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ।
পদ্মায় পানি বিপদসীমার ৪০ সে.মি. উপরে
মাদারীপুর জেলা সংবাদদাতা : শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটের পদ্মা নদীতে অব্যাহত পানি বেড়ে বিপদসীমার ৪০ সে.মি. উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তীব্র ¯্রােত অব্যাহত থাকায় ফেরিসহ নৌযানগুলো ২ থেকে আড়াই কিলোমিটার উজান বেয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে গিয়ে দ্বিগুণ থেকে আড়াইগুণ সময় বেশি লাগছে। ফেরিগুলো শিমুলিয়া প্রান্তে প্রায় ২ আড়াই কিলোমিটার উজানে গিয়ে চললেও পারাপারে হিমশিম খাচ্ছে। ৩টি ডাম্ব ফেরিসহ ৪টি ফেরি বন্ধ থাকা ছাড়াও চলমানগুলো ফেরিসহ নৌযানগুলোও পারাপারে দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে।
এদিকে ফেরি চলাচলে অচলাবস্থার কারণে কাওড়াকান্দি ঘাটের ৬ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ লাইনসহ উভয় ঘাটে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়ে দূর্ভোগ চরম আকার ধারন করেছে।
বিআইডব্লিউটিসির কাওড়াকান্দি ঘাটের ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম মিয়া বলেন, ‘¯্রােতের তীব্রতার কারণেই ফেরি চলাচল ব্যহত হচ্ছে। তীব্র ¯্রােতের উপেক্ষা করে ডাম্প ও কে-টাইপের কয়েকটি ফেরি চলতে না পারায় দুর্ঘটনা এড়াতে তা বন্ধ রাখা হয়েছে।’
পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁর ভয়াবহ ভাঙন
শিবচর (মাদারীপুর) উপজেলা সংবাদদাতা : অব্যাহতভাবে পানি বেড়ে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা ও আড়িয়াল নদ রাক্ষুসী রূপ ধারণ করে শিবচরের ২টি ইউনিয়নের আড়াই শতাধিক ঘর বাড়ি ও অন্তত ৩শ’ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকিতে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাজারসহ বহু ঘরবাড়ি। শুধু নদী ভাঙনই নয় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে পদ্মার চরাঞ্চলের ৪টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার বাড়ি ঘর। বন্ধ হয়ে গেছে চরের সব স্কুল। স্কুলগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আহমেদও অবস্থাকে জরুরী অবস্থার সাথে তুলনা করেছেন।
বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
বগুড়া অফিস : মৌসুমি ভারী বর্ষণের সাথে ভারত থেকে আসা ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। যমুনা তীরবর্তী ৩ উপজেলা সোনাতলা , সারিয়াকান্দি ও ধুনটে বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে পানি বাহিত রোগের প্রকোপ। ৫০টির ও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় কার্যত তা অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী যমুনা নদীতে পানি এখন বিপদ সীমার ৯৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবো সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, পানি আরো বাড়বে এমনকি এবারে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
যমুনা তীরবর্তী ৩টি উপজেলা যথাক্রমে সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুটনের ২০টি ইউনিয়নে পানি বন্দী মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। সরাসরি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা সোয়া লাখের উপরে।
সারিয়াকান্দিতে বন্যা আরো অবনতি
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) উপজেলা সংবাদদাতা : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সারিয়াকান্দিতে পানি বিপদ সীমার ৩০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বৃদ্ধির ফলে যমুনা নদীর বন্রা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্ব এলাকায় ৬ ইউনিয়নে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী ও ৪২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে পানি উঠে পড়ায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. আবু সাঈদ জানান, যমুনায় পানি ২ থেকে ৩ দিন আরও বাড়তে পারে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ত্রাণ কর্মকর্তা সারওয়ার আলম বলেন, এরই মধ্য প্রায় ৫০ মে. টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বনার্তদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. রফিকুল আলম জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া একে বারে বন্ধ হয়নি। তবে স্থানীয় ম্যানিজিং কমিটির ব্যবস্থাপনায় পাঠদান কার্যক্রম সচল রয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Robiul Islam Rahi ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১১:২০ এএম says : 0
আসুন সবাই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ান...
Total Reply(0)
হোসাইন ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:৪৮ পিএম says : 0
ওই সব এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ ও মন্ত্রীরা কি করছেন ? তাদের পাশে দাড়ানোর মত কি কেউ নেই?
Total Reply(0)
শাহে আলম ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:৪৯ পিএম says : 0
আসুন আমরা যার যতটুকু সামর্থ আছে তা দিয়েই ওদের পাশে দাড়ই।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন