শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পানিবন্দি ৫০ লাখ

প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২৯ পিএম, ৩০ জুলাই, ২০১৬

ইনকিলাব রিপোর্ট : ভারতের ভেতর দিয়ে ধেয়ে আসা বানের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যার পানির চাপ সামাল দিতে না পেরে জলপাইগুড়িতে দেয়া গজলডোবা বাঁধ, মহানন্দা নদীতে দেয়া চাকমাঘাট বাঁধ, মনু নদীতে দেয়া কলসী বাঁধ ও গঙ্গা নদীর ওপর দেয়া ফারাক্কা বাঁধের সবক’টি গেট খুলে দিয়েছে। এসব গেট দিয়ে প্রবেশ করা পানির তোড়ে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ১৬ জেলার মানুষ ভাসছে বানের পানিতে। তবে ইনকিলাব প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, বানভাসি জেলার সংখ্যা ১৮টি। কিছু এলাকায় বন্যার পানি হ্রাসের সাথে নদী ভাঙ্গন তীব্র হয়েছে। যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এবং তীব্র স্রোতের সাথে ঘূর্ণন থাকায় সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ হুমকির মধ্যে রয়েছে। বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে এই আতঙ্কে এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে জামালপুরের সাথে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি জেলায় বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। নীলফামারীতে টেপাখাগিবাড়ী ইউনিয়নে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি ভেঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কুড়িগ্রামে ৫৩ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তীব্র স্রোতে জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, শিবালয় ও দৌলতপুরেও চলছে নদী ভাঙ্গন। টাঙ্গাইলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ধলেশ্বরী ও যমুনা নদীর পানিতে নাগরপুর উপজেলার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। এই উপজেলার ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উজানের পানি গড়িয়ে যতই ভাটির দিকে আসছে ততই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত জেলাগুলোতে ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৪ লাখ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। মারা গেছেন ১৪ জন। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছয় শতাধিক। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৭ জন। বন্যার কারণে অনেক ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তলিয়ে গেছে বন্যাকবলিত ৭২টি উপজেলার বাড়িঘর, ফসলী জমি, পুকুরের মাছ। কাজ আর খাদ্যের অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গত মানুষ। মিলছে না প্রয়োজনীয় গো-খাদ্যও। পানিবন্দি এলাকায় চোরের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ রাতে পালা করে পাহারা দিচ্ছে চোর-ডাকাত প্রতিরোধে। এরপরও বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় খবর আসছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, এ পর্যন্ত ১৩ হাজার টন জিআর চাল ছাড় করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে নয় হাজার ১০০ টন। আর ছাড়ের জন্য অধিদফতরে চাল মজুদ আছে ৩ হাজার ৯০০ টন। মন্ত্রণালয় থেকে জিআর ক্যাশ হিসেবে ছাড় করা হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। জেলা পর্যায়ে থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তিন কোটি সাড়ে সাত লাখ টাকা। আর অধিদফতরে বর্তমানে অবশিষ্ট আছে ২ কোটি সাড়ে ৪২ লাখ টাকা। তবে বন্যাকবলিত এলাকার ঘুরে আমাদের প্রতিনিধিরা জানায়, প্লাবিত এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় নামমাত্র সাহায্য পৌঁছেছে। এসব এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা দেখলেই মানুষ দৌড়ে আসছে খাবারের জন্য। দেশের বেশ কয়েকটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর মধ্যে রয়েছে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, ধরলা, দুধকুমার, পদ্মা, ঘাঘট, করতোয়া ও সুরমা। নদীগুলোর মোট ১৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা মোকাবেলায় ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া গতকাল (শনিবার) বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ত্রাণের অভাব নেই। তিনি বন্যা কবলিত এলাকার মানুষদের দুর্দশা লাঘবে সরকারের পাশাপাশি দল-মত নির্বিশেষে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০টি পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৫৪টি স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ৩২টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে। দু’টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ২টি স্থানের তথ্য পাওয়া যায়নি। আর ১৯টি স্থানে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানায়, কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার, গাইবান্ধায় ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার, কাজিপুরে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার, আরিচাতে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার, সিংড়ায় গুর নদীর পানি বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার, বাঘাবাড়িতে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ১০২ সেন্টিমিটার, এলাসিনে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার, তরাঘাটে কালিগঙ্গা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার, গোয়ালন্দে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার, ভাগ্যকূলে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার, সুরেশ্বরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, জারিয়াজঞ্জাইলে কংস নদীর পানি বিপদসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ত্রাণমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, চলমান বন্যায় দেশের ১৬ জেলার ৫৯টি উপজেলায় প্রায় চার লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। আর মারা গেছেন ১৪ জন। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছয় শতাধিক।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জানান, মোট ১৬ জেলার ৫৯টি উপজেলার ৩০৯টি ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত বন্যা কবলিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংখ্যা তিন লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৬টি। আর মানুষের সংখ্যা ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৫ জন। এতে সম্পূর্ণ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৩১৪টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ হাজার ৩৭১টি। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৮৮টি।
সারাদেশে এ পর্যন্ত বন্যা কবলিত হয়ে ১৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে রংপুরে একজন, কুড়িগ্রামে দু’জন, গাইবান্ধায় চারজন ও জামালপুরে সাতজন মারা গেছেন। তবে উত্তরাঞ্চলে বন্যা কমতে শুরু করলে দক্ষিণাঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
মায়া বলেন, বন্যা কবলিত জনগণের জন্য সহায়তা কার্যক্রম ও আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রিত লোকসংখ্যা সাত হাজার ৩৭৫ জন। এ ছাড়া বন্যা কবলিত এলাকায় মোট ৩৪৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। আট হাজার প্যাকেট ও পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট প্লাবিত জেলাগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মলনে জানানো হয়, এ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে ১৩ হাজার টন জিআর চাল ছাড় করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নয় হাজার ১০০ টন। আর ছাড়ের জন্য অধিদফতরে চাল মজুদ আছে ৩ হাজার ৯০০ টন।
মন্ত্রণালয় থেকে জিআর ক্যাশ হিসেবে ছাড় করা হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। জেলা পর্যায়ে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন কোটি সাড়ে সাত লাখ টাকা। আর অধিদফতরে বর্তমানে অবশিষ্ট আছে ২ কোটি সাড়ে ৪২ লাখ টাকা।
জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ
জামালপুর জেলা সংবাদদাতা : জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৮ সেন্টিমিটার হ্রাস পেলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ উপজেলা সমূহের যমুনা তীরবর্তী ১৫টি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি ভয়বহ আকার ধারণ করেছে। মেলান্দহ, বকশীগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলা সমূহের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। বন্যার কারণে জেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়াও ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ উপজেলা সমূহের আভ্যন্তরীণ প্রায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেলপথের সকল ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে বস্ত্র ও পাট প্রতি মন্ত্রী মির্জা আজম এমপি গত দুইদিন জেলার বন্যাকবলিত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে দুর্গতদের সার্বিক সহযোগিতার আশ^াস দিয়েছেন।
জামালপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার জহরুল হক জানান, মেলান্দহ থেকে ইসলামপুর রেলপথের কয়েকটি পয়েন্টে লাইনের উপর দিয়ে বন্যার পানি উঠায় শুক্রবার রাত ৮টা থেকে জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যার পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার এই সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে। ফলে এ রোডে চলাচলকারী ব্রহ্মপুত্র এক্সেপ্রেস, কমিউটার-১, কমিউটার-২ ট্রেন ঢাকা থেকে জামালপুর জংশন স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করবে।
মেলান্দহ উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান চান জানান, মেলান্দহ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ পানি পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বন্যার্তদের সাহায্যে এপর্যন্ত মাত্র ৮০ টন চাল দেওয়া হয়ে যাহা চাহিদার তুলানায় অত্যন্ত কম।
সরিষাবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম জানান, বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ইতিমধ্যেই পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। যমুনার ভাঙনে পিংনা ইউনিয়নের ১২০টি বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে এবং বন্যার তীব্র স্রোতে বিভিন্ন সড়ক ভেঙ্গে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে পড়েছে আন্তঃজেলা সড়ক যোগাযোগ।
কুড়িগ্রামে দুর্ভোগ চরমে
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা : কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি নেই। ১৩তম দিনে বানভাসির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬ লাখে। পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৭টি ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ বন্যার সাথে লড়াই করছে। খাদ্য ও পানির তীব্র সংকটের পাশাপাশি বন্যার্ত মানুষ পড়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। নেই নিরাপদে সন্তান প্রসবের কোন ব্যবস্থা। শনিবার চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ছিল বিপদসীমার ৮১ সেন্টিমিটার উপরে এবং কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানিছিল বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার উপর।
রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে শুক্রবার সীমান্ত এলাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চরনতুন বন্দরে অবস্থিত রৌমারী স্থলবন্দর, গবাদি পশুর করিডর ও রাজিবপুরের বালিয়ামারী বর্ডার হাট ডুবে গেছে। সেই সীমান্তে পাঁচটি বিজিবি ক্যাম্পের চারপাশে পানি উঠেছে। ফলে বিজিবি জোয়ানরা এখন পানিবন্দি।
চিলমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলী বীরবিক্রম জানান, চিলমারীতে বুরুজের পাড় নামক স্থানে ভোরে কাঁচকোল বাজার সড়ক ভেঙ্গে প্রায় ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়। পানির তোড়ে ভেসে গেছে ৮টি ঘর। এতে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল এবং নতুন করে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাপারীর বাজার এলাকার সাথে কাঁচকোল বাজার এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাড়িঘর ভেসে যাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে ঐ পরিবারগুলো।
বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
গাইবান্ধায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে
গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতা : ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ২২.৫১ সে. মি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ২০.৬০ সে. মি. বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের সিংড়িয়ার রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী ইউনিয়নের সিংড়িয়া পয়েন্টে শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় বন্যার পানির তোড়ে বাঁধটি ভেঙ্গে গেছে। হঠাৎ করে বাঁধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় রতনপুর গ্রামের অনেক মানুষের বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র ও মজুদ ধান-চাল বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এতে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া, উদাখালি, উড়িয়া এবং সদর উপজেলার বাদিয়াখালী ও বোয়ালি ইউনিয়নের বিস্তৃত এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে এসব এলাকার ৫০ হাজার মানুষ এখন নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার অধিকাংশ বাড়ি-ঘর হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত। এছাড়া এসব এলাকার রোপা আমন, আমন বীজতলা, পাট, শাক-সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে বন্যার পানির তোড়ে ফুলছড়ি উপজেলার চন্দ্রনস্বর গুচ্ছ গ্রামটি নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বন্যাকবলিত গৃহহীন পরিবারগুলো ফুলছড়ি উপজেলা হাইস্কুল মাঠে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার পানির তোড়ে রতনপুর-বাদিয়াখালি সড়কের হাজিরহাট সংলগ্ন ব্রিজটি ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া কাতলামারি, সিংড়িয়া, উদাখালী, গুণভরি সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় ফুলছড়ি উপজেলার সাথে গ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
বগুড়ার ১শ’ কি.মি. বাঁধ হুমকিতে
বগুড়া অফিস : কেবল পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে মেরামতি কাজের দায়িত্ব দেয়ার পরিণতিতে বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি থেকে ধুনট উপজেলা পর্যন্ত ১শ’ কিলোমিটার ব্যাপী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৫টি পয়েন্টে বন্যার পানি বাঁধ চুঁয়ে চুঁয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ধুনটের ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের শিমুলবাড়ী স্পট ঝুঁকির মাত্রাটা বেশী। এর আগেও ২০০২ সালে সেখানে বাঁধের পাানি চুঁয়ে চুঁয়ে রাতের আঁধারে ভয়াবহ ভাঙ্গনের ফলে শত শত ঘরবাড়ি এবং মানুষ বন্যার পানিতে ভেসে যায়। ধুনট উপজেলাসহ শেরপুর, গাবতলী, সারিয়াকান্দির একাংশ এবং সিরাজগঞ্জের কাজিপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলা প্লাবিত হয়। সেই স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে এলাকার মানুষকে। অনেকেরই আশংকা, হয়তো বন্যা ও যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে শিমুল বাড়ি’ ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শনিবার পানি না বাড়লেও এখনও যমুনায় পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি এরকম থাকলে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। সোনাতলা থেকে উপজেলা পর্যন্ত ১শ’ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৫টি স্পটে বন্যার পানি বাঁধ চুয়ে পূর্বপাশের নদীর পানি পশ্চিম পাড়ের শস্যক্ষেত ও জনপদে প্রবেশ করছে। ধুনটের ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শ্যামল তালুকদার জানান, ‘‘শিমুলবাড়ী যে জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চুঁয়ে পানি পশ্চিম পার্শ্বে আসছে সেখানে ২০০২ সালে একইভাবে পানি চোঁয়ানোর পর বাঁধ ভেঙ্গে ধুনট, কাজিপুর, শেরপুরসহ অন্যান্য উপজেলা প্লাাবিত হয়ে ফসলি জমিসহ বাড়ীঘর ভেঙ্গে গিয়েছিল। শিমুলবাড়ী গ্রামের মহুবর জানান, শুধু বস্তা ফেলে আগেও পানি চোয়ানো বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাঁধ রক্ষা করতে পারেনি। এবারও একই জায়গায় পানি চোঁয়াচ্ছে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। কেননা এর আগে ওই জায়গায় ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে আমরা বাড়ী থেকে নিজের কাপড়টাও নিতে পারিনি। ধান চাল বাড়ীঘর সবকিছু বন্যার পানিতে ভেসে গিয়েছিল।’
এদিকে এই মারাত্মক ঝুঁিকপূর্ণ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ করে পানি চোঁয়ানো বন্ধের নামে লাখ লাখ টাকার বিল হাতিয়ে নিচ্ছে পাউবো’ কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিন বলেন, পছন্দের ঠিকাদার নয় যে প্রতিষ্ঠান জরুরি কাজ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে সেই প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেয়া হচ্ছে।
টাঙ্গাইলে দুই শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা : অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে টাঙ্গাইল সদর, ভূঞাপুর, কালিহাতী ও নাগরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে চারটি উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। গবদি পশু নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বন্যা কবলিতরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া, হুগড়া, মামুদ নগর, মগড়া, কাতুলি ইউনিয়নের অন্তত ত্রিশটি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। এর মধ্যে কাকুয়া, চরপৌলী, কারিগরপাড়া, মোল্লাপাড়া, সরকারপাড়া এলাকা প্রায় পুরোটা তলিয়ে গেছে।
কালিহাতী উপজেলার সল্লা, গোহালিয়াবাড়ী, দুর্গাপুর ইউনিয়নের বেলটিয়া, শ্যামসৈল, আলীপুর, আফজালপুর, বিনোদ লুহুরিয়া, বিয়ারা মারুয়া, কুর্শাবেনু, জোকারচরসহ অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বন্যাকবলিতরা।
নাগরপুর ইউনিয়নের ভাড়রা, দপ্তিয়র, ভাদ্রা, মোকনা, সহবতপুর, গয়হাটা ইউনিয়নের মধ্যে শাহজানী, শাখাইল, পাচপাড়া, গণকগ্রাম, খাসঘুনিপাড়াসহ প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভূঞাপুর উপজেলা। এই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নেই বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে গাবসারা ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম, অর্জুনা ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত। এছাড়াও গোবিন্দাসী ইউনিয়নের পাঁচটি, নিকরাইল ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম এবং অলোয়া ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম পানিবন্দি হয়েছে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ বলেন, যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে অভ্যন্তরীণ প্রায় দশটি নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর থেকে নাগরপুর পর্যন্ত প্রায় একশ’ কিলোমিটারজুড়ে শতশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিন-রাত কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
ভাঙনে দিশেহারা সিরাজগঞ্জবাসী
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী এখন ফুঁলেফেপে যৌবন ফিরে পেয়েছে। পানি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে নদী তীরবর্তী ৫টি উপজেলার মধ্যে ৩টিতে ভাঙন অবহ্যাত গতিতে চলছে। সর্বশান্ত বর্ন্যাত মানুষেরা এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের দুঃখের যেন কোন শেষ নেই। প্রতিবছর নদী ভাঙে, সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করে কিন্তু ভাঙন রোধ হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী ও একশ্রেণির স্বার্থবান ঠিকাদারদের অবস্থার উন্নতি হলেও নদীপাড়ের ভাঙন কবলিত মানুষের ভাগের কোন পরিবর্তন হয় না। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, সদর ও চৌহালী উপজেলার প্রায় কয়েক হাজার হেক্টর ফসলী জমি ও শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। বাস্তহারা এসব মানুষ খোলা আকাশের নীচে ঝুঁপড়ি তুলে বসবাস করছে। চার উপজেলার সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে আদিবাসী পল্লী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-বাজারসহ হাজার হাজার হেক্টর ফসলী, বসতভিটা জমি ও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে বর্ষার মৌসুমে ভাঙন আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ফান্ড না থাকায় ভাঙনরোধে আমাদের কিছুই করার নেই।
এলাকা ঘুরে জানা যায়, কাজিপুর উপজেলার মেঘাইঘাট, শুভগাছা ও নাটুয়ারপাড়া ৪নং ওয়ার্ডে গত ১ সপ্তাহে ৪০০ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। ৩শ’ একর ফসলী জমি, ৪টি মসজিদ, ১টি স্কুল ও ১টি ঈদগাহ মাঠসহ অনেক স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়াও সদর উপজেলার পৌরসভা সংলগ্ন বিয়ারা এলাকার আদিবাসী পল্লী, চরমালসাপাড়া, বাঐতারা, ছোনগাছা ইউপির বালুঘুগরি, পাঁচঠাকুরি, বাহুকা, ইটালি, চৌহালী উপজেলার খাসকাউলিয়া, চৌদ্দরশি, উত্তর খাসকাউলিয়া, চরজাজুরিয়া, দক্ষিণ খাসকাউলিয়া, খাসপুকুরিয়া, মেটুয়ানী, বিনানুর, চরসলিমাবাদ এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, যমুনার পানি ডানতীরে আঘাত হানছে। একারণে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ভাঙনের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
পাবনায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দী
পাবনা জেলা সংবাদদাতা জানান, প্রবল বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা ও পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ৩টি উপজেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বড়াল নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভাঙ্গুড়া উপজেলার চলনবিল এলাকা, খানমরিচ, অষ্টমনিষা ও দিলপাশার ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় তীব্র বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত খানমরিচ ইউনিয়নের দোহারী, ময়দানদিঘী, সাতবাড়িয়া, দুধবাড়িয়া, বড়পুকুরিয়া, গোবিন্দপুর, শিয়ালবাড়িয়া, পরমান্দপুর গ্রাম, দিলপাশার ইউনিয়নের হাট উধুনিয়া, কাজিটোল, চাচকে এবং অষ্টমনিষা ইউনিয়নের রুপসী, তারাপূর, গদাইরুপসী, বাশবাড়িয়া গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। রুপসী প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যা কবলিত হয়ে পড়ায় আপাততঃ পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এলাকাবাসী জানান, গত কয়েক দিন আগে থেকে হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে এবং এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। প্রতি ২৪ ঘন্টায় গড়ে প্রায় এক থেকে দেড় ফুট পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যায় এসব এলাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যা প্লাবিত হওয়ায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে উপজেলার উত্তরমেন্দা গ্রামে পানিতে ডুবে আকাশ (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে, বেড়া উপজেলার ঢালার চর এলাকার প্রায় ২০ গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে বলে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কোরবান আলী আমাদের এক সূত্রকে জানিয়েছেন। চাটমোহর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
চরভদ্রাসনে আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দি
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে উপজেলা পদ্মা নদী পয়েন্টে বন্যার পানি বিপদ সীমার ৮৬ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে ফরিদপুর পাউবো জানিয়েছে। এতে উপজেলায় প্রায় আড়াইহাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বানভাসী গৃহস্থালীর গরু ছাগল পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে বা অনেকে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া উপজেলার জনচলাচলের ২৪টি রাস্তা, ১০টি কালভার্ট, ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে চলমান বন্যায় উপজেলার জনজীবন থমকে দাঁড়িয়েছে।
উপজেলার চরহরিরামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওবায়দুল বারী দীপু জানান, বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। প্রায় পরিবারের বসতঘরে পানি ঢুকেছে। এতে পরিবারের সদস্যরা শিশু, বৃদ্ধ ও গরু ছাগল নিয়ে কর্মহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এছাড়া ইউনিয়নের জনচলাচলের ১২টি রাস্তা ৬টি কালভার্ট ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে ডুবে গিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে।
চরঝাউকান্দা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোঃ ফরহাদ হোসেন মৃধা জানায়, পদ্মার পাড় এলাকায় বেড়িবাঁধহীন ইউনিয়নের সব পরিবার পানিতে ডুবে রয়েছে। ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াল রূপ নিয়েছে। চরাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসরত প্রায় ৫শ’ পরিবারের ঘরের মধ্যে দিয়ে পানি চলাচল করছে। দুর্গতরা ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচাল পেতে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
আরিচায় ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি
আরিচা সংবাদদাতা জানান, মানিকগঞ্জের আরিচাঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ভাঙন এবং ফসলি জমিসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফলে নীচু এলাকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এবং বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। যে সব বিদ্যালয়ের আঙিনায় পানি প্রবেশ করেছে সে সব বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশেষ করে জেলার শিবালয়, দৌলতপুর ও হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদের বাড়ি-ঘর ডুবে গিয়ে খাবার সঙ্কটসহ বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত কোন ত্রাণ সামগ্রী পায়নি বলে পানি বন্দি লোকজন জানান।
বিআইডব্লিউটিএর আরিচা কার্যালয়ের গেজ রিডার আলমগীর হোসেন জানান, যমুনা নদীর এ পয়েন্টে এক সপ্তাহ ধরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে শনিবার সকাল নয়টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১০ দশমিক ১১ মিটারে পৌঁছেছে। যা বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জানা গেছে, যমুনায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এর শাখা নদী ইছামতি, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারী, বাঁচামারা, বাঘুটিয়া, জিয়নপুর ও খলসী ইউনিয়নের ইসলামপুর, বাসাইল, মুন্সিকান্দি, জোতকাশি, বেপারীপাড়া, ফকিরপাড়া, রাহাতপুর, চুয়াডাঙ্গা, হাজিপাড়া, কাচারীপাড়া, উত্তরখন্ড, অহেল আলীর পাড়া, গোবিন্দপুর, নকের আলী মাদবরপাড়া, বাঘপাড়া, মন্ডলপাড়া, বড়টিয়া, আমতলী, কাটাখালি ও বৈন্যা এলাকায় ভয়াবহ নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। শাখা নদী তীরবর্তী শ্রীধরনগর, কুস্তা, ঘিওর, মাইলাগি, জাবরা, তরা, বেউথা, নয়াকান্দিসহ প্রভৃতি নতুন নতুন এলাকাও পড়েছে ভাঙনের মুখে। অনেক স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহে পানি ঢুকে পড়েছে। নি¤œঞ্চলের বাড়ি-ঘর ইতিমধ্যে ডুবে গেছে।
শিবচরে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে দুর্ভোগ বাড়ছে
শিবচর উপজেলা সংবাদদাতা : অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধিতে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৭০ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। বানভাসিদের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য নুর-ই আলম চৌধুরীর উদ্যোগে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০ মে.টন চাল, দেড় লাখ টাকার শুকনো খাবার ও নগদ এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গতকাল পানি বৃদ্ধির ফলে পদ্মার চরাঞ্চল ছাড়াও আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী এলাকায় দুর্ভোগ ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদের প্রবল পানির তোড়ে উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্ব কাকৈরে বাজার রক্ষা বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধের প্রায় ১শ’ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে বহেরাতলা বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হুমকিতে রয়েছে। একই নদের ভাঙ্গনে সন্ন্যাসীরচর, পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ির ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের ৪টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে ঘরের মধ্যেই মাচা তৈরি করে বসবাস করছেন। এসকল এলাকার ফসলি মাঠ, টিউবওয়েল, স্কুলেও পানি ঢুকে পড়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। গো খাদ্যের সংকট।
বাসাইলে শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন
বাসাইল উপজেলা সংবাদদাতা : টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ঝিনাই নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ভাঙ্গনের কারণে কাঞ্চনপুর, হাবলা ও কাশিল ইউনিয়নের কাশিল, দাপনাজোর, কামুটিয়া, নথখোলা, থোপিয়া, বালিনা ভৈরপাড়া, আদাজানের মানিকচর, কাঞ্চনপুর কাজিরাপাড়া, সোনারচরসহ বিভিন্ন এলাকার নদী তীরবর্তী বিদ্যুতের খুঁটি, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ অনেক ঘরবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই শতাধিক ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে বলে জানা যায়। প্রায় আড়াই শতাধিক পরিবার ভিটাবাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শুক্রবার রাত থেকে কাশিল কেবিএন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি ভবনে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এতে যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে ভবনটি। স্কুলের ভবনটি রক্ষা করার জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল ইসলাম স্থানীয়দের নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গাছের গুঁড়ি ও বালির বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বারবার আবেদন জানানোর পরও স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিবছরই এলাকার লোকজন নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে নদী তীরের অধিবাসী আমিনুর বলেন, আমার প্রায় ২০ শতাংশ জায়গা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। দুইটি ঘর সরিয়ে নিয়েছি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও বাসাইলের ঝিনাই নদীর তীরবর্তী কেবিএন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন, খেলার মাঠ, বাজার, ঘরবাড়ি ছাড়াও নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় অনেক কৃষকের ঘরবাড়িসহ আবাদী জমি নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। কেউ কেউ তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
কাজিরাপাড়ার কৃষক ওহাব আলী বলেন, আমি ৩টি ঘর সরিয়ে নিয়েছি। আমার ভিটাবাড়ির সম্পূর্ণ জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন থাকার জায়গাটুকুও নেই। ঘর-ভিটা হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব।
সুন্দরগঞ্জে বন্যা দুর্গতদের করুণ দুুর্দশা
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সংবাদদাতাঃ
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দুর্গতদের মাঝে করুণ দুর্দশা বিরাজ করছে। তারা না পারছে খেতে, না পারছে চলাফেরা করতে। গত কয়েকদিনের বন্যায় উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্রে বন্যার্তরা আশ্রয় নিয়ে করুণ দুর্দশায় দিনাতিপাত করছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, কাপাসিয়া এলাকায় বাঁধ ও রাস্তার উপর খোলা আকাশের নিচে রান্না-বান্নার কাজ করছে গৃহবধূরা। রান্নার পানির জন্য যেতে হয় ১ অথবা ২ কিলোমিটার দূরে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দায়িত্বে নিয়োজিত এসও মোনায়েম হোসেন জানান, তিস্তা নদীর পানি একটু কমেছে। বর্তমানে পানি ২৪ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার পয়েন্টে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপদ সীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচে।
কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জু মিয়া জানান, যে ত্রাণ পেয়েছি তা দিয়ে বানভাসি অর্ধেকের কম লোককে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তার ইউনিয়নে অনেক ত্রাণের প্রয়োজন। ত্রাণের জন্য মানুষ হা-হা-কার করছে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন