বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশ কয়েকজন যাত্রীর করোনা ধরা পড়ার পর ঢাকা থেকে একের পর ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে জাপান, কোরিয়া ও সর্বশেষ বন্ধ করেছে ইতালি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নেয়া কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বহির্বিশ্বে। এমনকি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে। ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় বিদেশ ফেরত প্রায় দেড় লাখ অভিবাসীর বিদেশ ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতে করে করোনার মধ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়বে বাংলাদেশ।
কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ নিয়ে সম্প্রতি ইতালিতে যাওয়া বাংলাদেশীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ইতালি সরকার। এমনকি বুধবার ঢাকা থেকে রোমে যাওয়া ১২৫ বাংলাদেশীকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গত এক মাসে ইতালি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে যাওয়া অর্ধশতাধিক বাংলাদেশির শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। ফলে তুরস্ক ফ্লাইট চালুর কথা বললেও এখন নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। আরব আমিরাত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়েও স্থগিত করে রেখেছে। সব মিলে আকাশপথে একের পর এক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে পড়ছে বাংলাদেশ।
বিদেশে যাওয়ার পর বিমানবন্দরেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের শরীরে করোনা শনাক্ত হচ্ছে কেন, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি দায়িত্বশীল কেউ। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষারোপ করছে। কর্মকর্তাদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বিমান যাত্রীদের নির্ভুলভাবে করোনাভাইরাস শনাক্তের প্রক্রিয়ায় গলদ আছে। দেখা যাচ্ছে, করোনা রোগী ভুয়া সনদ নিয়ে সুস্থ সেজে উড়োজাহাজে উঠে পড়ছেন। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় গত ২১ জানুয়ারি থেকে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ওই সময় থেকে বিদেশফেরত সব যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। একই সঙ্গে যাঁদের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকবে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকার নিয়ম করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২১ মার্চ থেকে চীন ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সরাসরি যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় বেবিচক। ১৫ জুন থেকে যুক্তরাজ্য ও কাতারের সঙ্গে বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এরপর ২১ জুন এই তালিকায় যুক্ত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৩ জুলাই থেকে ঢাকা-ইস্তাম্বুল পথে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায় টার্কিশ এয়ারলাইনস। তবে নিষেধাজ্ঞাকালীন বিশেষ ও ভাড়া করা ফ্লাইটে প্রবাসীরা দেশে আসতে শুরু করেন।
যাত্রীর শরীরে করোনা ধরা পড়ায় ঢাকা থেকে ফ্লাইট বন্ধ করেছে জাপান, কোরিয়ার পর ইতালি।
ইমিগ্রেশনের সূত্র বলেছে, ১ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত বিমানের একাধিক ভাড়া করা ফ্লাইটে ইতালি, জাপান, পর্তুগাল, স্পেন গেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে শুধু ইতালিতেই গেছে পাঁচটি ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটে ১ হাজার ৩৬১ জন বাংলাদেশি গেছেন। সর্বশেষ ৬ জুলাই ২৭৬ জন যাত্রী নিয়ে রোমে যাওয়ার পর ২১ বাংলাদেশির শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এ ঘটনায় আগামী এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে ইতালি। এই নিষেধাজ্ঞার সময় কোনো চার্টার্ড ফ্লাইটও বাংলাদেশ থেকে যেতে পারবে না বলে ইতালি জানিয়ে দিয়েছে।
বেবিচকের একজন কর্মকর্তা জানান, আগাম সতর্কতা হিসেবে তুরস্ক সরকার বাংলাদেশে টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চলাচল ১৫ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করেছে। দুবাই ও আবুধাবিতে ৬ জুলাই থেকে বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইট চালুর সময় নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু আরব আমিরাত সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার কারণে সেটি স্থগিত করে দিতে বাধ্য হয়েছে বিমান বাংলাদেশ। এর আগে ১১ জুন বিশেষ ফ্লাইটে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার পর ১৮ প্রবাসী বাংলাদেশির শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। এ ঘটনায় বাংলাদেশিদের প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দক্ষিণ কোরিয়াও।
শুধু তা–ই নয়, ১০ জুন বিমানের চার্টার্ড ফ্লাইট জাপান যাওয়ার পর ৪ বাংলাদেশিকে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো চার্টার্ড ফ্লাইট যেতে দেবে না বলে জানিয়ে দেয় জাপান। চীনের সঙ্গে সরাসরি বিমান চলাচল করলেও ১১ জুন ঢাকা থেকে গুয়াংজুতে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের ১৭ যাত্রীর করোনা শনাক্ত হয়। এরপরই চীন সরকার বাংলাদেশে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসকে এক মাসের জন্য ফ্লাইট চলাচলের নিষেধাজ্ঞা দেয়।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণের সময় এসব যাত্রীর শরীরে করোনার কোনো লক্ষণ ছিল না। তাদের কাছে করোনা পরীক্ষার সনদও ছিল।
বিমানবন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহারিয়ার সাজ্জাদ বলেন, বিদেশে যাওয়ার সময় যাত্রীর জ্বর বা করোনা উপসর্গ আছে কি না, আমরা বিমানবন্দরে তা পরীক্ষা করি। কিন্তু সব দেশে কোভিড সনদ থাকা বাধ্যতামূলক নয়। একেক দেশের একেক ধরনের নিয়ম। তিনি বলেন, আক্রান্তের ৪-৫ দিন পর কোভিড ধরা পড়ে। বাসা থেকে বিমানবন্দরে আসা বা ফ্লাইটে থাকার সময়ও কেউ করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে নেগেটিভ হলেও বিদেশে যাওয়ার পর অনেকে করোনা পজিটিভ হতে পারেন।
একজন কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো করোনা সনদ গ্রহণ করবে না। সেখানে যাওয়ার পর যাত্রীর করোনা পরীক্ষা করানো হয়। পজিটিভ বা নেগেটিভ যে রিপোর্ট আসুক, তাকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে একই নিয়ম। ইতালিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে করোনা সনদ রাখার নিয়ম ছিল না।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, কোনো দেশ করোনা সনদ বাধ্যতামূলক করুক আর না করুক, আমাদের উচিত এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করা। কোনো করোনা রোগী যাতে উড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে একের পর এক সব রুট বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কিছুই করার থাকবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন