শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

এ এক ভয়াবহ ব্যাপার। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিশ্বের নামী-দামী কোম্পানির ওষুধ নকল করা হচ্ছে এবং সেগুলো দেশের বিখ্যাত ও বড় বড় ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে। এসব দামী ওষুধ ক্যান্সার, হার্ট, কিডনি, ডায়বেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এগুলোই দেশে একটি শ্রেণী নকল করে বাজারজাত করছে এবং নামী ফার্মেসিগুলো তা বিক্রি করছে। রোগীরাও নিশ্চিন্তে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে না, এসব ভেজাল ওষুধ তাদের রোগকে আরও জটিল করে মৃত্যুর দিক ঠেলে দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের দুই নম্বর রোডের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত ওষুধের নকল, ভেজাল এবং ওষুধ তৈরির উপকরণ উদ্ধার করে। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে অরেক্সিন, হাইজিংক, ডায়ানাসহ ৬টি বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল। এগুলোতে বিদেশি কোম্পানির নাম, হলোগ্রাম, কৌটা নকল করে ব্যবহার করা হয়। মূলত এসব ওষুধে আটা-ময়দার মতো জিনিস দিয়ে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে তৈরি করা হয়। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, এসব ওষুধ উত্তরা, ফকিরাপুল, চকবাজার, টঙ্গি ও গাজীপুরে তৈরি করা হয় এবং তা রাজধানীর বড় বড় ফার্মেসিতে সরবরাহ ও বিক্রি করা হয়। এসব ফার্মেসির মধ্যে রয়েছে লাজ ফার্মা, আল মদিনা ফার্মা, তামান্না ফার্মেসি, ইসলামিয়া ফার্মা ইত্যাদি। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়, ওষুধ নকলের ভয়ংকর এক চক্রের সাথে এসব ফার্মেসির নাম জড়িয়ে রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ এসব বিদেশী ওষুধের নকলের সাথে জড়িত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে।

দেশে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতের বিষয়টি নতুন নয়। বহু বছর ধরেই চলে আসছে। মাঝে মাঝে র‌্যাব-পুলিশ অভিযান চালিয়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও কিছু ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বের হয়ে পুনরায় উৎপাদন শুরু করে। ফলে নকল ওষুধের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। এসব নকল ওষুধ সাধারণত গ্রামে-গঞ্জে ও শহরের পাড়া-মহল্লার ছোট-খাটো ফার্মেসিতে বিক্রি হয়। অনেকে এ বিষয়ে অবহিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত নামী-দামী ফার্মেসি থেকে আস্থার সাথে ওষুধ কিনতে যান। বিশেষ করে জটিল রোগীর জন্য আমদানিকৃত বিদেশী ওষুধ কেনার জন্য বড় ফার্মেসিগুলোই তাদের ভরসার জায়গা। এসব ফার্মেসি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ আমদানির মাধ্যমে বিক্রি করে। দেখা যাচ্ছে, তারাই বিদেশী ওষুধের নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি করছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাদেরও ভেজালকারিদের সাথে যোগসূত্র রয়েছে। তা নাহলে, এসব ওষুধ তাদের ফার্মেসিতে পাওয়ার কথা নয়। বিখ্যাত ফার্মেসিগুলো যদি এ অপকর্মে যুক্ত হয়, তাহলে মানুষ খাঁটি ও নির্ভেজাল ওষুধের জন্য কোথায় যাবে? ইতোমধ্যে এসব ভেজাল ওষুধ কিনে জটিল রোগীর কী অবস্থা হয়েছে, তা জানা না গেলেও তাদের রোগ যে অবনতির দিকে এবং কারো কারো মৃত্যু হয়েছে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। এর দায় নেবে কে? দেখা যাচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অনেক জায়গায় চরম অমানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। নকল ওষুধ, হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া, এমনকি করোনা শনাক্তের নকল সার্টিফিকেটসহ একের পর এক অকল্পনীয় অমানবিক ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। রিজেন্ট হাসপাতাল করোনামুক্ত হওয়ার ভেজাল সার্টিফিকেট দিয়ে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তা বিদেশে দেশের ভাবমর্যাদা ভুলুন্ঠিত করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অনেক মানুষেরই আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই আস্থাহীনতার কারণে যেসব মানুষের সামর্থ্য আছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী কিংবা অন্যদেশে গিয়ে চিকিৎসা কারাচ্ছেন এবং বিদেশ থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে আসছেন। এতে প্রতিবছর দেশ থেকে বিপুল অর্থ চলে যাচ্ছে।

যারা নকল ওষুধ তৈরি, সরবরাহ ও বিক্রি করছে এবং যথাযথ চিকিৎসা দিচ্ছে না, তাদের এ অপকর্মকে পরিকল্পিতভাবে মনুষ হত্যা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এ হত্যাকান্ড যেন কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। এই অপরাধের প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য যে ওষুধ প্রশাসন রয়েছে, তারা কি কাজ করছে, তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানটি লোকবলের অভাবের কথা বলে দায় এড়িয়ে যায়। র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ স্বউদ্যোগে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করলেও তা দুষ্টচক্র দমনে যথেষ্ট নয়। অথচ এ কাজ করার কথা ওষুধ প্রশাসনের। আমরা র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশকে ধন্যবাদ দিতে চাই, তারা জনকল্যাণে কাজটি করে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, নকল ও ভেজালকারীদের গ্রেফতার করা হলেও আইনের দুর্বলতার কারণে তারা বের হয়ে পুনরায় একই কাজ করতে থাকে। আমাদের কথা হচ্ছে, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী এবং বিপণনকারী দমনে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এদের দমনে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দিলেই হবে না, এ অপরাধকে মানুষ হত্যার শামিল হিসেবে গণ্য করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল ওষুধ খেয়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনার অনেক নজির দেশে রয়েছে। যথাযথ শস্তি নিশ্চিত করতে না পারায় ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারিরা পার পেয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আইনের দুর্বলতা বড় একটি কারণ হয়ে রয়েছে। এ দুর্বলতা রেখে ওষুধের নকল ও ভেজাল রোধ করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন, আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন