বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

উপার্জন : হালাল-হারাম

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

সম্প্রতি ইনকিলাবের জনৈক পাঠক জানতে চেয়েছেন, আমি এক ব্যক্তিকে একটি কাজ করে দেয়ার জন্য অগ্রিম কিছু টাকা দিয়েছি, কিন্তু সে কাজটি করেনি আর আমাকে টাকাও ফেরৎ দেয়নি। এভাবে টাকাটা আত্মসাৎ করা তার জন্য বৈধ বা হালাল হয়েছে কিনা? অপর একজন উপার্জনে হালাল-হারাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করেছেন।

প্রথম প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না, কোন কাজের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে কাজটি না করায় সে যেমন ওয়াদা খেলাফ করেছে, তেমনি কাজটি না করে গ্রহণ করা অর্থ মালিককে ফেরৎ না দিয়ে আত্মসাৎ করায় তা হারাম হয়েছে। মালিক এর দাবি না ছাড়লে শেষ বিচারের দিন আল্লাহর হুজুরে তাকে এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং আত্মসাৎকৃত অর্থের বিনিময়ে ঐ মালিককে নিজ আমলনামা থেকে নেকী দিয়ে দায় পরিশোধ করতে হবে। এটা হক নষ্ট করা। কেউ কারো কোনো হক নষ্ট করলে তাকে রোজ কিয়ামতে নিজ নেকী প্রদান করে দায়মুক্ত হতে হবে।

রাসূলুল্লাহ স. বলেন, কিয়ামতের দিন সে লোক হবে চরম দুর্ভাগা, যে লোক হাশরের ময়দানে নেকী বোঝাই আমলনামা নিয়ে উপস্থিত হবে, বিচারকালে দেখা যাবে যে, অনেক পাওনাদার তার পাশে উপস্থিত। মহাবিচারক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তখন ঐ ব্যক্তিকে পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করে দিতে বলবেন, কিন্তু তখন তো তার কাছে কোন টাকা পয়সা বা আত্মসাৎকৃত বস্তু থাকবে না, কী দিয়ে পাওনা পরিশোধ করবে? আল্লাহ পাক বলবেন, তোমার আমলনামা থেকে নেকী দিয়ে পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করতে থাক। লোকটি পাওনাদারদের এক এক করে নেকী দিতে থাকবে। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়াবে, দেখা যাবে যে, তার আমলনামায় আর কোন নেকী অবশিষ্ট নেই কিন্তু পাওনাদার এখনও রয়ে গেছে। তখন আহকামুল হাকেমীন আল্লাহ হুকুম দিবেন ঐ সব পাওনাদারের আমলনামায় যে গুনাহ আছে তা তোমার আমলনামায় নিয়ে এসে দায় শোধ কর। এভাবে নিজের সমুদয় নেীক হারিয়ে, নিজের গুনাহ ও অপরের গুনায় তার আমলনামা যখন বোঝাই হয়ে যাবে তখন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

শ্রমিককে যেমন তার শ্রম দিয়ে পারিশ্রমিকের অর্থ হালাল করতে হবে তেমনি মালিককেও শ্রমিকের পাওনা যথাযথভাবে কাজ শেষ হবার সাথে সাথে, ঘাম শুকোবার আগেই মিটিয়ে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন শ্রেণীর লোকের বিরোধিতা করব, তার মধ্যে শেষ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলো সে ব্যক্তি, যে কোনো শ্রমিককে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজে নিযুক্ত করল, কাজটি তার থেকে পুরোপুরি বুঝে নিল কিন্তু তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করল না (বুখারী)।

শ্রমিককে তার মালিকের কাজ করতে হবে দক্ষতা ও বিশ^স্ততার সাথে, পূর্ণ সামর্থ্য দিয়ে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তোমার মজদুর হিসেবে উত্তম হবে সে ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ^স্ত (২৮.সূরা ক্বাসাস-২৬) ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের মধ্যে ঐ শ্রমিককে ভালবাসেন, যে তার কাজ উত্তমরূপে, নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করে (বায়হাকী)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, যে শ্রমিক আল্লাহর হক আদায় করে এবং তার মালিকের হকও আদায় করে, সে দ্বিগুণ সাওয়াব লাভ করবে (বুখারী, ইবনে মাজাহ)। শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ না করে কাজে নিয়োগ করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছন (মুসনাদে আহমাদ)।

মোট কথা, শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম যেমন গুরুত্ব আরোপ করেছে তেমনি অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে পালনের জন্যও শ্রমিককে তাকিদ দিয়েছে।

রুজি-রোজগারে হালাল-হারামের পরিসর ব্যাপক। জীবন ধারণের জন্য রুজি-রোজগার অপরিহার্য। তবে তা হতে হবে হালাল, তা উপার্জন ও আহরণের পন্থা ও পদ্ধতিও হতে হবে হালাল, শরীয়তসম্মত। শরীয়ত গর্হিত রুজি-রোজগার হারাম। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালে নাজাত পেতে হলে অবশ্যই হারাম পথে উপার্জন যথা- সুদ, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা, অবৈধ পদ্ধতিতে ব্যবসা, অপসংস্কৃতির মাধ্যমে উপার্জন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, জবর দখল, মজুদদারি, কালোবাজারি ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। এমনকি সন্দেহজনক উপার্জনের পথও পরিহার করা আবশ্যক।

বিশ্বনবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া অন্যকিছু কবুল করেন না (মুসলিম)।

তিনি আরও বলেছেন, যে দেহের গোশত হারাম মাল দ্বারা গঠিত তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, তার জন্য জাহান্নমই হচ্ছে উপযুক্ত ঠিকানা (মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকী)।

নবীজী স. বলেছেন, যে ব্যক্তি দশ মুদ্রায় একটি কাপড় খরিদ করল যার মধ্যে একটি মুদ্রা হারাম উপায়ে অর্জিত, যে পর্যন্ত ঐ কাপড় পরিধানে থাকবে তার নামাজ কবুল হবে না (আহমাদ)।

তিনি আরও বলেছেন, কোন বান্দা হারাম উপায়ে অর্জিত অর্থ দান-সদকা করলে তা কবুল হবে না, ঐ অর্থ নিজ কাজে ব্যবহার করলে তাতে বরকত হবে না, ঐ অর্থ উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে গেলে তা তার জন্য জাহান্নামের পুঁজি হবে। আল্লাহ মন্দের দ্বারা মন্দ দূর করেন না। হ্যাঁ, ভাল দ্বারা মন্দ দূর করে থাকেন। খারাপ খারাপকে বিদূরিত করতে পারে না (আহমাদ, শরহে সুন্নাহ)।

ইসলামে হালাল উপার্জনের ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশি। আল্লাহ পাক বলেন হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু তা হতে তোমরা আহার কর (২.বাকারা : ১৬৮)।

হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দান করেছি তা থেকে আহার কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর (২. বাকারা : ১৭২)।

নামাজ আদায় হয়ে গেলে তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে (হালাল রুজি অন্বেষণে) ছড়িয়ে পড় (৬২. সূরা জুময়া : ১০)।

রাসুলে পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হালাল রজি অন্বেষণ করা অন্যান্য ফরজের পরে একটি ফরজ (বায়হাকী)।

তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি সারাদিন কাজ করে অবসন্ন দেহে সন্ধ্যায় উপনীত হয়, রাতে তার সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে (তাবরানী)।

বিশ্বনবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন দ্বারা তার পরিবার প্রতিপালনে সচেষ্ট থাকে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সমতুল্য (বায়হাকী, তাবরানী)।

তিনি আরও ইরশাদ করেছেন, সত্যবাদী, আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে।

তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় স্বীয় আত্মমর্যাদা রক্ষা, নিজ পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণ ও প্রতিবেশীর প্রতি দয়া দাক্ষিণ্যের লক্ষ্যে দুনিয়ার হালাল জিনিসসমূহ অর্জন করতে চাইবে, সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে এরূপ অবস্থায় যে, তার মুখমন্ডল পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় সমুজ্জ্বল ও আলোকমন্ডিত হবে (তাবরানী)।

উপার্জনের ক্ষেত্রে বেধতার ব্যাপারে মনের মাঝে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগলেও আল্লাহর মকবুল বান্দাগণ কীভাবে তা পরিহার করে চলতেন ইসলামের ইতিহাসে তার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তার মধ্য থেকে এখানে আমরা ইমাম আযম আবু হানিফা রহ.- এর জীবনের দুটি ঘটনা উল্লেখ করছি। তিনি একজন বড় রেশমী বস্ত্র ব্যবসায়ীও ছিলেন। একদা তাঁর ব্যবসায়ের অংশীদার হাফস ইবনে আব্দুর রহমানকে বিক্রয়ের জন্য কাপড়ের একটি লট পাঠান এবং বলে দেন যে, এই লটের মধ্যে একটি কাপড়ে সামান্য ত্রুটি রয়েছে। বিক্রয়কালে সে যেন ক্রেতাকে অবশ্যই তা অবহিত করে। হাফস কাপড়ের ঐ চালানটি লটসহ বিক্রি করেদেন কিন্তু একটি কাপড়ে যে ত্রুটি রয়েছে, তা বলতে ভুলে যান। হযরত ইমাম আযম যখন তা অবহিত হলেন, তখন ঐ লটের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ গরীব দুঃখীকে দান করে দিলেন। আর একবার জনৈক মহিলা তার নিকট একখানা রেশমী বস্ত্র বিক্রয় করতে এলে তিনি তার মূল্য জিজ্ঞাসা করলেন, মহিলা বললেন, একশত মুদ্রা। ইমাম সাহেব বললেন, এর মূল্য আরও বেশি হবে। মহিলা দাম যত বাড়ান ইমাম সাহেব বলেন, এর দাম আরও বেশি। মহিলা চারশ মদ্র পর্যন্ত বাড়িয়ে চাইলে ইমাম সাহেব বললেন, না, এর দাম আরও অধিক হবে। মহিলা বললেন, আপনি কি আমার সাথে মশকারা করছেন? ইমাম সাহেব বললেন, না, আপনি দরদাম করার জন্য একজন অভিজ্ঞ লোককে ডেকে আনুন। মহিলা তাই করলেন। সে লোকটি বলল, এর দাম পাঁচশত মুদ্রা হবে। ইমাম সাহেব তখন পাঁচশত মুদ্রা দিয়ে কাপড়টি কিনে নিলেন।

এরই নাম সততা, আমানতদারী ও তাক্বওয়া। এমন সত্যবাদী, আমানতদার বিশ্বাসী ব্যবসায়ীরাই পরকালীন জীবনে নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথী হবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ১২ জুলাই, ২০২০, ৮:০৫ পিএম says : 0
What is about our Murtard/Taghut government who steals billions of Dollar our money... Which Jahannam they will go????????????????
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন