আইনগত ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মান সমান। যদিও গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক রেজ্যুলেশনের সেসব আইনগত রক্ষাকবচ ও মূল্যবোধসমুহ কখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত ও রক্ষিত হয়নি। সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে বড় রাষ্ট্রগুলো ক্ষুদ্র ও দুর্বলদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারকে নিজেদের স্বার্থে পদানত রাখার প্রয়াস চালিয়েছে সব সময়। জাতিভেদে সেসব হেজিমনিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে একেকভাবে প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকান হেজিমনির বিরুদ্ধে কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকো যেভাবে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, ফিলিপাইন আরেকভাবে নিজেদের রক্ষা করেছে। পক্ষান্তরে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলো কোনোরকম প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ না করে সরাসরি আত্মসর্মপণের পথ বেছে নিয়েছিল। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ এবং আঞ্চলিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোটাই পশ্চিমাদের হাতে। পশ্চিমারা আঞ্চলিক মিত্রদের সাথে যোগসাজশ করে উদীয়মান আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোকে তাদের ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের উপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য কায়েমে একপ্রকার গোপণ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত করেছে। আরব ও ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের দখলদারিত্ব-আগ্রাসন, কাশ্মীরীদের উপর ভারতের নিপীড়ন-আধিপত্য, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর উপর ভারতের খবরদারি, পানিসমস্যাসহ অমিমাংসিত ইস্যুতে ভারতীয় স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নীরবতার নেপথ্যে রয়েছে পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গোপণ এজেন্ডা। চীন ও রাশিয়ার মত সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে সেখানেই ইতিমধ্যে একপ্রকার শক্তির ভারসাম্য তৈরী হতে শুরু করেছে। একইভাবে নিজেদের আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক কৌশলগত সুবিধার স্বার্থে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী চীন নীরব সহায়কের ভূমিকা পালন করছে। উইঘুরের মুসলমানদের বন্দীদশার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এ কারণেই অনেক বেশি ভোকাল। তবে পশ্চিমাদের সূচিত ইসলামোফোবিয়ার এই সময়ে মুসলমানদের উপর গণহত্যা বা, হংকং-তাইওয়ানে মেইনল্যান্ড চিনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে চীনের উপর ব্লেইম ও কূটনৈতিক দরকষাকষিতে যতটুকু সুবিধা অর্জন করা যায় তারা যেন ততটুকুই করছে।
উপমহাদেশের ল্যান্ডলক্ড কান্ট্রি নেপাল ও ভূটান সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় থেকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই ভারত নির্ভর। বিশেষত নেপাল বিশ্বের একমাত্র সাংবিধানিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ায় ভারতীয়রা নেপালকে মনস্তাত্তি¡কভাবে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই ভেবে এসেছে। সেই নেপাল হঠাৎ করেই ভারতের সব নাগপাশ উপেক্ষা-অগ্রাহ্য করে দীর্ঘদিনের অমিমাংসিত স্থল ও জলসীমায় লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি, লিপুলেখকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে তা পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নিয়েছে। দুর্বল-অনুগত নেপালের হঠাৎ এমন ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার এমন দু:সাহসের পেছনে চীনের উস্কানির কথা বলা হলেও আসল শক্তি হচ্ছে, নেপালি জনগণের স্বাধীনচেতা মনোভাব আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক দৃঢ়তা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপাল কেন এমন ভারত বিরোধী হয়ে গেল! নেপালিরা বরাবর কাশ্মীরের মত আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাধীন জাতি। তারা কখনো ভারতের অধীন ছিল না। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই নেপাল স্বাধীনতা লাভ করেছিল। নেপালের রাজপরিবার ছিল সেই স্বাধীন ঐতিহ্যেরই প্রতীক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন হেজিমনিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার এক মাইলফলক সন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই নাইন-ইলেভেনের তিনমাস আগে ২০০১ সালের ১ জুন নেপালের নারায়নহিতি রাজপ্রাসাদের সেই রক্তাক্ত,মমর্ন্তুদ হত্যাকান্ডের ঘটনা নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেই রাতে রাজপরিবারের মাসিক ভোজসভায় সংঘটিত সংহিংস ঘটনায় নেপালের রাজা বিরেন্দ্র ও রানী ঐশ্বরিয়াসহ রাজপরিবারের ৯ সদস্য নিহত হন। আপাতদৃশ্যে বিরেন্দ্রের পুত্র ক্রাউন প্রিন্সের গুলিতে তার মা-বাবাসহ রাজপরিবারের সদস্যরা মৃত্যুবরণ করেছে বলে তথ্য প্রকাশিত হলেও রাজপুত্র নৃপেন্দ্র নিজে রাজা হওয়ার জন্য, কথিত গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের কন্যাকে বিয়ে করার জন্য বা অন্য কোনো স্বার্থে এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকলে তিনি নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন কেন? সেসব অনেক রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে সাধারণ নেপালিদের ধারণা, রাজপ্রাসাদে সংঘটিত ম্যাসাকারে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। নব্বইয়ের দশকে নেপালে গণতন্ত্রের দাবিতে পিপল্স মুভমেন্টে ভারতের মদদ ছিল বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। এরপর রাজপ্রাসাদে হত্যাকান্ড এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে নেপালের রাজনীতিতে ভারতীয় প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবেই আঞ্চলিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলোতে ভারতের ভারসাম্যহীন ও অস্বচ্ছ ভূমিকা একটি আঞ্চলিক অনাস্থা ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। তারই খেসারত এখন ভারতকে দিতে হচ্ছে।
নেপালের রাজদরবারে ক্রাউন প্রিন্সের বিদ্রোহ ও রাজা-রানীর হত্যাকান্ডের ঘটনার ৮ বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার পিলখানায় বিডিআরের দরবার হলে বিডিআর সৈনিকদের কথিত বিদ্রোহে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে ঘটনায় বিদ্রোহ, হত্যা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শত শত বিডিয়ার জওয়ানের বিচার হলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা সেই ঘটনার নেপথ্য কুশীলবরা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছে। পিলখানা হত্যাকান্ডের পর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা, আগ্রাসী-আধিপত্যবাদী মনোভাব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাইন-ইলেভেন থেকে শুরু করে দেশে দেশে এ ধরনের প্রতিটি চাঞ্চল্যকর সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ডের ঘটনার পেছনে নানামাত্রিক হিসাব নিকাশ, গণমাধ্যম ওপিনিয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত রির্পোট, রাজনৈতিক ব্লেইমগেইম ও পাবলিক পারসেপশন গড়ে উঠতে দেখা যায়। এর দায়ভার শেষ পর্যন্ত হেজিমনিক ক্ষমতার অস্বচ্ছ ভূমিকার কুশীলবদের উপরই বর্তায়। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের ধারণা বা পারসেপশন শেষ পর্যন্ত একটি সম্মিলিত জনমতের জন্ম দেয়, যা সব সময়ই প্রবল প্রতিপক্ষ বা আধিপত্যবাদী শক্তির বিপরীতে থাকে। নেপালের ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকাকে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন তারা একটি প্রতিবেশী আঞ্চলিক পরাশক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বপক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ ঘটনার ইতিহাস রচনা করেছে। তবে ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টতে (এনসিপি) থাকা ভারতপন্থী নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলিকে গদিচ্যুত করার যে পরিকল্পনা করেছিল, নেপালের সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে সে প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়েছে। ভারত ও হিমালয়বেষ্টিত নেপালের জনগণ আবারো প্রমান করল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনই যেকোনো দেশে সরকারের মূল শক্তি। এ অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যত শক্তিশালী হোক না কেন, বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বিভাজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে খুবই দুর্বল শাসকে পরিণত হয়েছেন। অন্যদিকে নেপথ্য শক্তি হিসেবে যাই থাক, নেপালি জনগণের ঐক্য ও দেশপ্রেম প্রবল আঞ্চলিক পরাশক্তির বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির হাত ও হিম্মতকে শক্তিশালী করে তুলেছে। তিনি এখন ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে অমিমাংসিত বিতর্কিত এলাকাগুলোকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডা তৎপরতা রুখে দিতে অলির সরকার নেপালে ভারতের প্রায় সব টিভি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন নেপাল সরকারের জন্য এটা ছিল অনেক বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধের উত্তুঙ্গ সময়ে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী নেপালের নতুন মানচিত্র প্রকাশসহ নেপাল সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড ভারতকে অভাবনীয়-অপ্রত্যাশিত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের বৈরিতা নতুন করে বলার কিছু নেই। ভূটান-মালদ্বীপের মত দেশকেও আস্থায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে ভারত। নেপালের পর এবার শ্রীলঙ্কার সাথেও ভারতের দূরত্ব, টানাপোড়েন ও অনাস্থার বিষয়টি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে ভারত ও পশ্চিমাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। চীনের সহযোগিতায় গৃহযুদ্ধ দমনের পর থেকে শ্রীলঙ্কার নতুন পথচলায় বিশ্বস্ত সহযাত্রী চীন। অন্যদিকে চীনের বিপরীতে নিকট প্রতিবেশী ভারত কৌশলগত আস্থাপূর্ণ ভূমিকার বদলে আধিপত্যবাদী নীতি অব্যহত রাখায় নতুন টানাপোড়েন দেখা দেয়। শ্রীলঙ্কার সাথে বন্দর চুক্তির দ্বারপ্রান্তে এসেও তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে ভারত। সমুদ্র বন্দরের ইস্ট কন্টেইনার টার্মিনালের উন্নয়নে ৫০-৭০ কোটি ডলারের চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কা। কিন্তু পরিবর্তিত আঞ্চলিক বাস্তবতায় সে চুক্তি বাতিল বা পুর্নবিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসা। অপরপক্ষে চুক্তি বলবৎ করতে ভারতের পক্ষ থেকে অব্যাহত চাপের বিষয়টি তুলে ধরে শ্রীলঙ্কান লেবার ইউনিয়নের সচিব নাকি বলেছেন, আমরা ভারতের কোনো প্রদেশ নই। ‘আমরা স্বাধীন দেশ, তাদের কথা মানতেই হবে, এমন কোনো কিছু নেই’। পাকিস্তান ছাড়া ভারতের ছোট প্রতিবেশীরা আগে কখনো এমন স্বাধীনচেতা বক্তব্য দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এখন চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধে জড়ানোর পর প্রতিবেশীদের সমর্থন যখন ভারতের বেশি প্রয়োজন তখন একে একে সব প্রতিবেশী দেশ চীনের প্রতি আস্থা ও নির্ভরতার পথ ধরছে। পশ্চিমাদের সাথে কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তোলার পরও প্রতিবেশীদের সাথে এমন বিচ্ছিন্নতা ভারতের আধিপত্যবাদি নীতির বড় ব্যর্থতা।
চীনের মত অগ্রসর প্রতিপক্ষের সাথে আঞ্চলিক লড়াইয়ে নিকট প্রতিবেশীদের পাশে পাওয়ার প্রতিদ্ব›িদ্বতায় ভারত কখনো জেতার চেষ্টাই করেনি। হামবড়া-আধিপত্যবাদি মনোভাব নিয়ে আঞ্চলিক কূটনৈতিক-রাজনৈতিক লড়াইয়ে জেতা যায় না এটা ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা বুঝতে সক্ষম হয়নি। রাজতন্ত্র বিনাশ হওয়ার পর ভারতীয়রা সম্ভবত নেপালে একটি বশংবদ রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। রাজতন্ত্র বিলোপের পাশাপাশি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মূল স্পিরিটই ছিল ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধিতা। জনআকাক্সক্ষাকে আধিপত্যের চোখ রাঙানিতে বিভ্রান্ত করা যায়নি। ভারত বিরোধিতাই ছিল নেপালে ২০১৭ সালের নির্বাচনে নেপালি কমিউনিস্টদের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মূলমন্ত্র। আঞ্চলিক অংশিদারদের সাথে ভারতের বিদেশনীতি কখনো ইতিবাচক ছিল বলে চিহ্নিত করা যায় না। ভারতের পাকিস্তাননীতি, শ্রীলঙ্কানীতি, নেপালনীতি, ভূটান-মালদ্বীপেও ভারতীয় খবরদারি কূটনীতি সুবিধা করতে পারছেনা। তবে ভারতের বাংলাদেশ নীতি সবচেয়ে একপাক্ষিক,আক্রমনাত্মক হওয়ার পরও এখনো দুই দেশের ক্ষমতাসীনরা সম্পর্কের অনন্য উচ্চতা নিয়ে বাগাড়ম্বর করে চলেছেন। প্রতিদিনই সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশী নিহত হচ্ছে। অভিন্ন প্রায় সব নদীতে বাঁধ দিয়ে, একতরফা পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে, বাঁধের উজানে জমা হওয়া ঢলের পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের ফসলি জমি ও জনপদ ডুবিয়ে দেয়ার আগে বাংলাদেশকে নোটিশ করারও প্রয়োজন বোধ করে না তারা। এরপরও চলছে ভারতের হাজার কোটি ডলারের অবাধ বাণিজ্য, বিনা মাশুলের ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বাংলাদেশের সমুদ্র-নৌ ও স্থলবন্দর ও হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের অবাধ সুযোগ পাওয়ার পরও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বাংলাদেশীদের নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য ও হুমকি ধমকি চলছেই। অমিত শাহ বাংলাদেশীদের টারমাইটস বা উঁইপোকার সাথে তুলনা করে হুমকি দিয়েছেন। এভাবেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘অনন্য উচ্চতা’ বজায় রাখা হচ্ছে! বাংলাদেশ পাকিস্তানের মত বৈরি প্রতিবেশি নয়। নেপাল, ভূটান বা শ্রীলঙ্কাও নয়। অনেক বঞ্চনার শিকার হওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ কখনো ভারতের সাথে বৈরী মনোভাব পোষণ করেনি। বাংলাদেশের এই উদারতার মূল্য দিতে ভারত পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দশ গুণের বেশি। সম্প্রতি চীন বাংলাদেশকে ৫ হাজারের বেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার দিয়েছে। আর ভারত করোনার দোহাই দিয়ে স্থলপথে ভারতে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। পাটের মত ট্রাডিশনাল কৃষিপণ্যের উপর এন্টি-ডাম্পিং ট্যাক্স আরোপ করে ঠেকিয়ে রেখেছে ভারত। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে দেশের সরকার বা বিরোধিদল যেভাবেই সাড়া দিক না কেন। চূড়ান্ত ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফায়সালা শেষ পর্যন্ত জনগণের হাতেই থাকে। দশকের পর দশক ধরে নেপালের উপর ছড়ি ঘোরানো ভারতীয় আধিপত্যবাদি আচরণ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপাল মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের জনগণের মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। নেপালের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারত নেপাল থেকে বিদ্যুৎ না কেনা এবং অন্য কোনো দেশে রফতানি করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন চীনের সাথে যুদ্ধাবস্থায় নেপাল ভারতের সাথে অমিমাংসিত ভূ-খন্ড নিজেদের মানচিত্রভুক্ত করে ভারতের বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সব ধরনের বন্দর, নৌপথ, রাস্তা ও ট্রানজিট সুবিধা নিয়েও বাংলাদেশকে ন্যায্য-যৌক্তিক ট্রানজিট ফি থেকে বঞ্চিত করছে।অথচ ৬০ বছর ধরে প্রত্যাশিত এই ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার আগে বলা হয়েছিল ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট শুল্ক নিয়ে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। আমরা আমাদের সড়ক অবকাঠামো নির্মান ও রক্ষণাবেক্ষনে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছি, সেই অবকাঠামো ব্যবহার করে মূল ভূ-খন্ড থেকে ভারতের ৭ রাজ্যে পণ্য আনা-নেয়া করা হচ্ছে বিনা শুল্কে। ইতিপূর্বে আভ্যন্তরীন নৌ ও স্থলবন্দর দিয়ে শুরু হওয়া কথিত ট্রায়াল ট্রান্সশিপমেন্টের নামে বছরের পর বছর ধরে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিনাশুল্কে পণ্য পরিবহন চলেছে। এরপর যে পরিমান শুল্ক আরোপ করা হয়েছে তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল ট্রান্সশিপমেন্টের পর তা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সড়কপথে বিনাশুল্কে ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক বা ‘ট্রায়াল রান’ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, যেহেতু ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাবে, এ কারনে এসব ট্রানজিটে প্রশাসনিক শুল্ক দেয়া হবে না। ট্রায়াল রান কতদিন চলবে তারও কোনো নির্দ্দিষ্টতা নেই। আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৭৫ সালে ‘পরীক্ষামূলক’ ফারাক্কা বাঁধ চালুর কথা বলে কোনো চুক্তি ছাড়াই অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি আটকে দেয় ভারত। এরপর চুড়ান্ত চুক্তিতে পৌছতে ২০ বছর সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল। ততদিনে বাংলাদেশের শত শত শাখা নদী নাব্যতা হারিয়েছে। গত তিন দশক ধরে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে ভারতীয় প্রতারণার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এই হচ্ছে ভারতের বাংলাদেশ নীতি এবং দুই নিকটতম প্রতিবেশির অমোঘ বন্ধুত্ব।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন