ইসলাম একই সাথে একটি ধর্ম, একটি জীবন ব্যবস্থা, একটি অতুলনীয় সভ্যতা। যেহেতু মানবজাতির জন্য তাদের মহান স্রষ্টা ইসলামকেই জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করেছেন, অতএব এর কোনো তুলনা হয় না। দীর্ঘ প্রায় দেড় হাজার বছর বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলাম।
একশ বছর ধরে ইসলাম বাস্তবায়িত না থাকায় পৃথিবী ও মানব সভ্যতা ধ্বংসের খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে প্রায়। মানুষ নিজেদের ধ্বংস করার এত আয়োজন করেছে যে, ইচ্ছায় বা ভুলক্রমে মানব সভ্যতা ধ্বংস করে দেয়া এখন কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। এ অবস্থা থেকে মানুষের মুক্তি কেবল ইসলামই দিতে পারে।
নবী করিম (সা.) থেকে পরবর্তী চার খলীফা সুশাসন ও ন্যায়বিচারের যে সব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা মানবজাতির জন্য চিরন্তন সম্পদ। এর মধ্যে অল্পেতুষ্টি ও আপস একটি বড়গুণ। সমঝোতা ও শান্তিপ্রিয়তা মানুষের জীবনে অনেক সাফল্য এনে দেয়। অপরদিকে জেদ, অহঙ্কার ও অনমনীয়তা মানুষকে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঈমান ও নীতির ব্যাপারে মানুষকে আপোষহীন হতে হবে। তবে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ধৈর্য, ত্যাগ, তুষ্টি, সমঝোতা, সংলাপ অবলম্বন করে টিকে থাকতে হবে।
ক্ষমা, ঔদার্য ও ভালোবাসার মাধ্যমে শত্রæকেও জয় করতে হবে। এসব কথা কোরআন হাদীসেরই মর্মবাণী। মানুষ যদি নিজের জীবনে এসব প্রয়োগ করে তাহলে জীবন যুদ্ধে সে পরাজিত হবে না। বিবাদের চেয়ে সমঝোতা যে উত্তম, এবিষয়ে একটি উদাহরণ ইসলামের ইতিহাস থেকে পেশ করছি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের মানুষ নিজেদের দিন-দুনিয়া, ক্ষমতা, রাজনীতিসহ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে এ উদাহরণ থেকে উপকৃত হতে পারবেন।
এক ব্যক্তি নগরীর মসজিদে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, এসময় অপর ব্যক্তি এসে তার সাথে একই দস্তরখানে নিজের খাবার নিয়ে বসলেন। ঘটনাক্রমে তৃতীয় এক ব্যক্তিকে মসজিদে বসে থাকতে দেখে তারা দু’জনই তাকে খাবারে ডাকলেন। প্রথম ব্যক্তির ছিল ৫ টি রুটি। দ্বিতীয় ব্যক্তির ৩ টি রুটি। তৃতীয় জনের কিছুই ছিল না। তারা মুসলমানের সৌজন্য হিসেবে কোনো বানিজ্যিক চিন্তা ছাড়াই সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করলেন।
যখন বিদায়ের পালা তখন তৃতীয় লোকটি আগের দু’জনকে ৮ টি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে চলে গেলেন। তখন ৫ রুটির মালিক বললেন, ভাই তুমি ৩ টি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যাও, আমি ৫ টি রেখে দেই। মুসাফির ভাই হিসেবে তাকে আমরা দাওয়াত করলাম, আবার তিনি আমাদের টাকাও দিয়ে গেলেন।
তখন ৩ রুটিওয়ালা বলল, এ টাকা তো তিনি রুটির দাম হিসেবে দেননি। এমনিতেই দিয়েছেন, সুতরাং টাকা সমানভাবে ভাগ হবে। আপনার ৪ টি স্বর্ণমুদ্রা আর আমার ৪ টি। কিন্তু প্রথমজন বললেন, তিনি ৮ রুটি দেখেই ৮ টি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছেন। আমরা যেমন তাকে দাওয়াত করেছিলাম এখন উল্টো তিনিই আমাদের খানা খাইয়ে দিলেন। তবে এ বিষয়টি সহজে সমাধান হলো না। দু’য়েকজন যারা ঘটনাটি শুনলেন তারা বললেন, যেহেতু রুটি ৮ টি, স্বর্ণমুদ্রাও ৮টি তাহলে আপনারা আপোষ করে নিন। সমঝোতার মাধ্যমে ৫টাকা ও ৩টাকা নিয়ে নিন। সমান চাওয়ার প্রয়োজন কি? আপনাদের কারও তো ব্যবসার উদ্দেশ্য ছিল না। টাকা পাওয়ার আশাও ছিল না।
যেহেতু ওই ভাই রুটির পরিমাণ দেখেই টাকা দিয়েছেন, তাহলে রুটি হিসেবেই তা ভাগ হওয়া উচিত। কিন্তু ৩ রুটিওয়ালা কিছুতেই কারও কথা মানতে রাজি নন। তার গুঁয়ার্তুমি দেখে ৫ রুটিওয়ালাও ১ টি স্বর্ণমুদ্রা ছেড়ে দিতে রাজি হচ্ছিল না। তখন ৩ রুটিওয়ালা এ নিয়ে আদালতে গেল। ঘটনাক্রমে এটি ছিল মুসলিম খেলাফতের প্রধান বিচারালয়। বিচারপতি ছিলেন, হযরত আলী রা.।
ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি ৩ রুটিওয়ালাকে বললেন, যেভাবে কথা হয়েছে সেভাবেই তুমি মেনে নাও। ৩ টাকা নিলে অনেক লাভবান হবে। সমঝোতার পথ সবসময়ই সুন্দর। হিসাব বা বিচার অনেক সময় লাভজনক হয় না। উপস্থিত সবাই হযরত আলী রা. এর কথায় সন্তুষ্ট হয়ে সমঝোতা মানলেও ৩ রুটিওয়ালা গোঁ ধরে বসল। লাভ ক্ষতি যাই হোক আমার ন্যায় বিচার চাই। হযরত আলী (রা.) তখন রায় দিলেন, বললেন, ৫ রুটিওয়ালাকে ৭ টাকা দিয়ে দাও আর ৩ রুটিওয়ালা পাবে ১ টাকা।
বিচার শুনে সবাই হতভম্ভ। কিন্তু নবী করিম (সা.) এর চতুর্থ খলীফা মহাজ্ঞানী ও মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ট বিচারপতি হযরত আলী (রা.) এর ন্যায় বিচার নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ কোনোদিনই ছিল না। তিনি ছিলেন খোদাদত্ত বিচার ক্ষমতার অধিকারী। তখন ৩ রুটিওয়ালা বলল, হযরত আমি এক টাকাই নিলাম এবং সন্তুষ্টচিত্তে আপনার বিচার মেনে নিলাম। কিন্তু আমার আবেদন এই যে, আমাকে ১ টাকা পাওয়ার কারণ ও এমন অভাবনীয় হিসাবটি বুঝিয়ে দেয়া হোক।
তখন হযরত আলী (রা.) বললেন, তোমাদের মোট রুটি ছিল আটটি। খেয়েছো ৩ জন মিলে। অর্থাৎ রুটিগুলি ২৪ টুকরা হয়েছে। প্রত্যেকে যদি ৮ টুকরা করে খেয়ে থাকো, তাহলে তোমার ৩ রুটির ৯ টুকরা থেকে পথিক মাত্র ১ টি টুকরা খেয়েছে। আর অপরজনের ৫ রুটির ১৫ টুকরা থেকে পথিক খেয়েছে ৭ টুকরা। এ হিসাবেই আমি অঙ্ক করে টাকা ভাগ করে দিলাম। ওই ব্যক্তি সরল মনে তোমাকে ৩ টাকা নিতে বলেছিল, আর তুমি ১ টাকাও ছাড় না দিয়ে সমান ভাগ নিতে চেয়েছিলে।
এ ছিল সহজ ও আপোষের ব্যাপার। অন্য মানুষেরাও এমনকি আমিও তোমাকে সমঝোতা মেনে নিতে বলেছিলাম, কিন্তু তুমি হিসাবের পাওনা আর সুবিচার ইত্যাদি বলে মামলাটি আদালতে তুলেছ। আর বিচার যখন হয় তখন তা অঙ্কের বাইরে যায় না।
অতএব, যত মামলা আপোষ ও সমঝোতায় শেষ হয় ততই ভালো। আদালতে গড়ালে তা নীতি হিসাব প্রমাণ ও বিধানের আলোকেই শেষ হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘সমঝোতাই উত্তম’।- আল কোরআন। উপস্থিত সবাই খুশি হলো, এমনকি ৩ রুটিওয়ালাও আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে বলল, হযরত টাকা যদিও আমি কম পেয়েছি, তথাপি আপনাকে দেখে ও আপনার কথা শুনে সারাজীবনের জন্য মহামূল্যবান শিক্ষা ও উপদেশ লাভ করলাম। আমি ধন্য। এতে বোঝা গেল সমঝোতা বিবাদের চেয়ে সবসময়ই উত্তম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন