শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

লোভের আগুনে পুড়ছে স্বদেশ

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, আত্মহত্যা ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। রাজধানীতে থানার (চড়ষরপব ঝঃধঃরড়হ) সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরও অপরাধ বা অপরাধীর সংখ্যা কমে নাই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অপরাধের কারিগরি কৌশলে হয়েছে পরিবর্তন। এলাকার প্রভাব-প্রতিপত্তি, জমি দখল, বাড়ি-ব্যবসা দখল প্রভৃতির জন্যে হয়ে থাকলে তা একটি ভিন্ন বিষয়, যা পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু যেখানে আইনশৃঙ্খলা মেইনটেইন করা অনিশ্চয়তায় থাকে, যেখানে মনুষের মধ্যে সীমা লংঘনের প্রবৃত্তি প্রকটভাবে দেখা দেয়, সেখানেই চলে হত্যাকান্ড। আরেক প্রকার হত্যা রাষ্ট্রীয় মদদে হয়ে থাকে যেমন- রোহিঙ্গাদের উপরে মিয়ানমার সরকারের হত্যাযজ্ঞ, এনআরসি বাস্তবায়নের জন্য মোদি সরকার কর্তৃক ভারতীয় মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ প্রভৃতি। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, আমাদের সমাজে পারিবারিক কলহের কারণেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন, সন্তান হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা প্রভৃতির মূল কারণ হলো সংসারে অভাব অনটন। জনগণ যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টনের অংশীদার হতো তবে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো না। দারিদ্র্যের কারণেই চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা হয়ে থাকে। ধনীর দুলালরা অনেকেই মাদক সেবন করে বটে, কিন্তু মাদক কারবারী যাদের র‌্যাব বা পুলিশ ক্রস ফায়ার করেছে তাদের মোটামুটি সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দারিদ্র্যের কারণে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে, দারিদ্র্যের জন্য তারা লেখাপড়া করতে পারে না এবং একই কারণে গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে তারা মাদক সাপ্লাইয়ার হিসাবে কাজ করে, বিনিময়ে পেট ভরে ভাত খেতে পারে।

সম্পদের সুষম বণ্টনে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে গরিব দিন দিন হচ্ছে পথের কাঙ্গাল এবং ধনীরা গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়। সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রশ্নে রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নাই। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চাই যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আদৌ রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছি কি?

অর্থ লোভী পাষন্ডরা অর্থ উপার্জনে সাধারণ মানুষের রক্ত যেভাবে চুষে খায়, তাতে মনে হয় টয়লেট থেকে কামড় দিয়ে টাকা তুলে নিতেও তাদের বিবেক কুণ্ঠিত হবে না। এক পাকিস্তানি নেতা যিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এক সময় বলে ছিলেন, ‘মুজে শরাব পিতে হায় জুরুর, লেকিন গরিবোকি খুন পিতা নেহি’ অর্থাৎ ‘আমি নিশ্চয় মদ খাই বটে, তবে গরিবের রক্ত পান করি না।’ আমাদের দেশে গরিবের রক্তপান কোনো ব্যাপারই নয়। যতদিন অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের কালো পথ রাষ্ট্র বন্ধ না করবে, ততদিন পর্যন্ত গরিবের রক্ত পান অব্যাহতই থাকবে। নীতিনির্ধারকদের অর্থাৎ যারাই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছেন তাদের খাই খাই অভ্যাসের কারণে বাংলাদেশ হয়েছে একটি সিস্টেম লসের দেশ, ব্যতিক্রম যা আছে তার সংখ্যা মাইক্রোসকোপে দেখতে হবে। এ দেশে যে কোনো অবৈধ কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্রই শেল্টার দিয়ে থাকে। এ দেশে আইন দু’ ভাগে প্রয়োগ হয় বিধায় টাউট, বাটপার, অর্থ পিচাশরা সরকারি দলের আশ্রয় খোঁজে, আর সরকারি দল করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশ তাদের গায়ে হাত দেয় না। তবে যখন সীমা লংঘনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন বিধি বাম হলে হয় বিপত্তি। ফলে শুরু হয় অভিযান, কোথাও লোক দেখানো, কোথাও জেনুইন অভিযান, যা নির্ভর করে অভিযানকারী কর্মকর্তার উপর। কিন্তু কিছুদিন পার হলেই মুখ থুবড়ে পড়ে সে অভিযান। হাঁক ডাক যতই হোক, যত গর্জে তত বর্ষে না।

একটি জনগোষ্ঠির সার্বিক স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক সীমারেখার উপর নির্ভরশীল নয়। তবে ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকাই সার্বভৌমিকতার মূল উপাদান। রাষ্ট্র সার্বভৌমিকভাবে স্বাধীন হলেও সর্বস্তরের জনগণ যদি এর সুফল ভোগ করতে না পারে তবে সে স্বাধীনতার সুযোগের অপব্যবহারে সৃষ্টি হয় শ্রেণি বৈষম্য। সে বৈষম্যের কষাঘাতে বাংলাদেশ এখন রক্তাক্ত, অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাধীনতার সুফল এখন ডুমুরের ফুল মাত্র। একপেশে বা অনৈতিক শাসন ব্যবস্থা কোনদিনই সমষ্ঠিগত কল্যাণ বয়ে আনে না। সংবিধানের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’ কিন্তু সে মতে, জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি বাস্তবায়নের জন্য বিগত ৫০ বছরে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারে নাই। রাষ্ট্রীয় সাহায্য যথা বয়স্ক ভাতা, ভিজিবি কার্ড, ত্রাণ, অনুদান, দান-খয়রাত প্রভৃতি এবং অন্যদিকে একজন নাগরিককে স্বনির্ভর বা স্বচ্ছল করার পদক্ষেপ নেয়া এক কথা নয়। রাষ্ট্রীয় সাহায্য বা দান-খয়রাত বা রিলিফের দুর্নীতির কথা বাদ দিলেও প্রতিটি নাগরিককে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এ পদক্ষেপ কোনো সামাজিক সংগঠন বা এনজিও দ্বারা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কিছু এনজিও এ মর্মে কিছু পদক্ষেপ নিলেও কোনো কারণে তাদের পদক্ষেপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এনজিও ঋণ গ্রহণকারীদের সুদের বোঝা অনেক বহন করতে হয় বলেই অনেক ঋণ গ্রহীতাই স্বচ্ছলতার পরিবর্তে পা পিছলে পড়ে যায়। যারা সফল তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এখন বা সাম্প্রতিকালে যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন বা করছেন তারা কেউই সেবার উদ্দেশ্যে করছেন না। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলে। এখন হাসপাতালের মতই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি লাভজনক একটি ব্যবসা। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় কোনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক বেতন দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, যা একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এক মাসের খরচের সমতুল্য। সম্প্রতি করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি ইতালিতে গিয়েছিল। কিন্তু ইতালি বিমান বন্দরে পজেটিভ সনাক্ত হওয়ায় ফিরতি বিমানে তাদের বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানো হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে যারা করোনা সম্পর্কিত ভুয়া বা জাল রিপোর্ট দেয় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যে বিবেক বিক্রি করে অঢেল বিত্তশালী হওয়া, বিত্তশালী হওয়ার নেশায় কিছু মানুষ তাদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

সমাজে ভদ্র চেহারার লোক হিসাবে পরিচিত যারা তারা প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় কর্ণধার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তোলার জন্য লোক দেখানো কিছু জনহিতকর কাজ করে এবং এ ছবিগুলিই দুর্বৃত্তায়ন করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। অযাচিত ছবি বা ফটো সেশনের বিষয়ে কর্তাব্যক্তিদের আরো সচেতন থাকা দরকার। আমাদের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার সুযোগে রাজনীতি দুর্বিত্তদের পকেটস্থ হওয়ায় কোনো ধারাবাহিকতা ছাড়াই অর্থের প্রভাবে যে কোনো দুর্বৃত্ত যে কোনো সময় রাজনীতিতে ঢুকে গোটা পরিবেশকে কলুষিত করে ফেলেছে।

সাধারণ মানুষ এখন দাঁড়াবে কোথায়? লাজ ফার্মাকে দেশে একটি বিখ্যাত ও বুনিয়াদী ঔষধ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মানুষ জানতো। তাদের ঔষধের দোকান থেকে মেয়াদবহিভর্‚ত ঔষধ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। বর্তমানে সমাজে বিশ্বাস করার মতো কোনো জায়গা আর রইলো না। এর মূল কারণও বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার নেশা, যে নেশায় পুড়ে যাচ্ছে দেশ ও জাতি।

দেশে অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ কোথাও অনৈতিকতা আবার কোথাও অঢেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার নেশা। আইন করে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না, পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না, যতক্ষণ না রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২০ জুলাই, ২০২০, ১১:৫৭ এএম says : 0
There is only one way to solve all the crime is to rule our country by the Law of Allah..
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন